এতদিন মানব দেহ নিয়ে কাটাকাটি, ঘাঁটাঘাঁটি করার পর, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মানবদেহ নিয়ে কিছু লিখি।
নিজের দেহটাকে জানলে, সত্যি বলছি, পৃথিবীতে অনেক কিছু না-জানার দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ ঘুচে যেত, লোভ হিংসা ঘৃণার পাপভার অনেক কমে যেত মানুষের!!
কখনো কখনো ইচ্ছে করে চিৎকার করে সবাইকে বলি : ভাই রে ভাই- সব শরীর একই রকম! ভেতরে অন্ততঃ কোন ব্যবধান নেই! তোরা না দেখেছিস তো কি, আমি বা আমরা বদ্যিরা অন্ততঃ দেখেছি, জেনেছি- চুলের মাথা, নখ থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের কোটি কোটি নিউরনের মধ্যেও কি সুন্দর সহাবস্থান! অথচ আমরা …
মাঝে-মাঝে অবাক হয়ে ভাবি- আমাদের কপাল ভালো যে, এইসব কোষ কলা অঙ্গ সংগঠনের কোন পতাকা নেই, জাত-পাত ধর্ম-বর্ণ নেই! এঁদের শরীর কোন নির্দিষ্ট রং-এর আবরণ নেই!
শুধু কাজের তফাৎ ছাড়া, এঁরা একটি বৃহৎ শরীরের অংশ মাত্র!
যাঁদের মিলিত প্রয়াসে- সমবেদনায়, সহযোগিতায়, সমোচ্চারিত উল্লাসে, অনুপ্রেরণায়, চৌকিদারিতে, লজ্জায়, হিংসায়, ঘৃণায়, বিরোধিতায়, মারামারিতে কত জটিল কূটনৈতিক সামরিক অসামরিক কার্যকলাপ, কত গৃহযুদ্ধ লেগে থাকে, কত মৌ সাক্ষরিত হয়, কত প্রেমালাপ চলতে থাকে, কত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, কত শত্রু জন্ম নেয়, কত শত্রু বাকিদের সমবেত একতার কাছে হেরে যায়!
এত সবকিছুর পরও বেঁচে থাকে একটা দেহ! সেটা দেহের জয়!
বেঁচে থাকাই সব। মৃত্যুর পর শরীরের এই এতকিছুর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না!
একটা শরীর একটা রাষ্ট্র। প্রতিটি পদক্ষেপে যদি বলতে থাকি, দেখবেন এই শরীরের ভেতরে আপনি মহাভারত খুঁজে পাবেন!! মানে ঐ যে মহাভারত সম্বন্ধে বলে- যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে; মানব শরীর নিয়ে বলতে গেলেও ঠিক একই কথা বলা যায়! বলা যায় – যা নেই এ খাঁচায়, তা নেই বসুধায়!
কিন্ত সমস্যা হলো, দেহের সেই ভেতরটাকে মানে অ্যানাটমি নিয়ে কি লেখা যায়? একে তো ল্যাটিন গ্রীক সহ নানা বিদেশী শব্দে বোঝাই, তার উপর ইংরেজি। সাধারণের জন্য সেটা বিরক্তির চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাবে।
এবার দ্বিতীয় সমস্যা হলো: অ্যানাটমি ছাড়া আমি শরীরের অস্তিত্ব মানতে পারি না! এমনিতে জ্ঞান নেই বেশি, সঠিক ধারণা নেই কোন রকম আধ্যাত্মিক মতবাদ চিন্তা চেতনা বিষয়ে!
তাই আমি, অ্যানাটমিকেই দেহতত্ত্ব ভাবি।
তাই দেহতত্ত্বের সামান্য জ্ঞান নিয়ে ভেবেছিলাম- গল্প লিখবো! ভেবে খাতা কলম থুড়ি মোবাইল নিয়ে বসেছিলাম! কিন্ত সমস্যা হলো- লিখতে গিয়ে দেখলাম কোন লেখাই দাঁড়াচ্ছে না!!!
ওই যে কবিতাখানা- সময় মতো না দাঁড় করালে পরে আর দাঁড়ায় না!!
লিখবো কি নিয়ে? মনে মনে ভাবলাম, অ্যানাটমির বাইরে একটা শরীর ভাবতে হবে!
একদম সেই লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সূক্ষ্ণ দেহধারণের মত!! সে দেহ আমার অজান্তেই আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, উড়ে যাবে, সাঁতার কাটবে, রোদ পোহাবে, বৃষ্টিতে ভিজবে, ক্রিকেট খেলবে, গান গাইবে, নাচবে, বন্ধুর পাছায় থাপ্পড় মারবে, বুকে জড়িয়ে ধরবে, শত্রুকে মিত্র বানাবে, রাজনীতি করবে, দেশ কাল সীমানার বাইরে গিয়ে সে বলবে- মানুষে মানুষে কোন ব্যবধান নেই!!!
কিন্ত আমার সে ক্ষমতা নেই! তেমন দেহতত্ত্বের আধ্যাত্মিক গূঢ় রহস্য শেখানোর জন্য গুরুও নাই, তাই গুরুত্ব ও নাই! দেহতত্ত্ব বোঝার জন্য Grey’s অ্যানাটমিই (অ্যানাটমি নামক সাবজেক্ট এর ধর্মগ্রন্থ বলা হয় এই বইকে) ভরসা আমার বা আমাদের।
তবু ইচ্ছে করে- একটা মৌলিক গল্প লিখতে! খোঁড়ার পাহাড় চূড়ায় ওঠার শখ আর কি!!!
কোন কালেই তাঁর ওঠা হয়ে ওঠে না, আর আমারও গল্প লেখা হয়ে ওঠে না!!!
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো- নিজের কিছু না থাকলে, যাঁর কাছে আছে, তাঁর থেকে সেটা নিতে চাইবে! যদি সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে তো ভালো, না হলে একটুখানি বাঁকিয়ে … হে হে হে .. ন্যায় অন্যায় বোধটাই আপেক্ষিক!
যাকগে …. এসব ফালতু বিষয়।
বীরেন্দ্র সহবাগের নাম সবাই শুনেছেন আশা করি। শুনেছি, তিনি ব্যাট করতে করতে, নামী দামী বোলারদের পিঠের থুড়ি বলের ছাল তোলার কাজ করতে করতে গান গাইতেন!! কি অবস্থা ভাবুন!! অন্যদের যখন পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে, তখন তিনি কিশোর কুমারের গান গাইছেন – নীলে নীলে অম্বর পর, চাঁদ যব..
কি জানি নীল অম্বরে তিনি আরতি সহবাগকে দেখতে পেতেন কিনা!!! এই ঘটনাটা পড়ার পর থেকে আমার হয়েছে এক দোষ! কাজ করতে করতে এক কানে গুঁজে নিই হেডফোন। একটা গান সিলেক্ট করে রাখি। যেই ফাঁকা পাই অমনি পজ্ বাটনটা ছুঁয়ে দিই!
গান না জানলেও আমার গান শোনার অসুখ বহুদিনের। কিন্ত হয়ে ওঠে না। এখন একটা ব্লুটুথ হেডফোন পেয়েছি। ঝামেলা কম। আদ্যিকালের লোকদের মত গানের ক্ষেত্রে আমার কতগুলো চয়েস আছে। জানি লোকে শুনলে কি বলবে- প্রচণ্ড ব্যাকডেটেড। কেয়া ফারাক পড়তা হ্যায়?
আমি শুনতে থাকি পুরানো দিনের গান। আমি শুনতে থাকি লোকগান। আমি শুনতে থাকি লালন গীতি। আমার মন ব্যাটারির রিচার্জ হয়ে যায় এতে!
কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক কলি গেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। রোগীরা আমাকেই না হাসপাতালে ভর্তি করে দেয় – এই ভয়ে গেয়ে উঠি না! তবে নিজের উপর ভরসা ছিলই – একদিন না একদিন ঠিক গেয়ে উঠতে পারবো – জাত গেল জাত গেল বলে ……
এই সেদিন ও কাজ করার ফাঁকে শুনছিলাম লালন গীতি। বিশ্বাস করুন, মন ভালো থাকে। কি জানি কেন, লালন গীতির গভীর অর্থ না বুঝলেও, একটা কথা বুঝি – দেহতত্ত্ব নিয়ে অসাধারণ জ্ঞান না অর্জন করলে ওসব গান তিনি লিখতে পারতেন না। আমাদের মত তুচ্ছ মানুষের কাছে দেহের এত অজানা রহস্য কই আর ধরা দেয়? আমরা জানতেই বা চাই কোথায়?? সেই সাধনা কোথায় আমাদের?? বরং না জানাতেই আমাদের গর্ব! না জেনেই আমরা কত্তো কত্তো কেলেঙ্কারি করে ফেলি!!! সেরকম এক কেলেঙ্কারি নিয়ে একটুখানি লিখবো।
কাজের ফাঁকে গানটা সবে চালিয়েছি। সহকারী এসে বললো – স্যার রোগী আছে। গান বন্ধ করে দিলাম। রোগী টেবিলে। আমি চেয়ারম্যান!
একজন বছর বত্রিশের মহিলা রোগী। বললেন – ডাক্তার বাবু একটু ভালো করে পুরা পেট দেখবেন! কি জানি কি হয়েছে! পেটের মধ্যে কি একটা যেন নড়েচড়ে!
বলা বাহুল্য, পেটের এই নড়াচড়া রোগের নানাবিধ নাম আছে। কারো পেট গুলিয়ে ওঠে, না গড়াগড়ি করে, কারো চাকতি বা বলের মত ঘোরে, কারো দৌড়াদৌড়ি করে, কারো কপকপিয়ে ব্যথা হয়, কারো বিষ হয়, কারো আন্চান লাগে, কারো বমি পায়, কারো কামড়ে ধরে (এগুলো রোগীদের থেকে শেখা)।
হাসির কথা নয়- নানা রকম রোগে এমন সত্যি সত্যি ই মনে হয়!!! আমরা বিভিন্ন রোগের সে গূঢ় রহস্য জানি! সবাইকে বলে দিলে ডাক্তারের সংখ্যা বেড়ে যাবার ভয় আছে, তাই বলবো না!! হে হে হে
যাইহোক, আমি রোগীকে বললাম – আপনার এর আগে কি কি হয়েছে বলুন। কাগজ দেখান।
– ওসব কাগজ কোথায় পাবো? আর ছবি তুলতে ওসব লাগবে কেন??
এই একটি দোষ! কাগজ দেখাবো না!! আরে বাবা আমি তো আর এনআরসি র জন্য কাগজ চাইছি না! বাকি সব কাগজ, যেগুলো দরকারও নেই, সেগুলো সযত্নে রাখা যায়, কিন্ত চিকিৎসার কাগজ কোনকালেই রাখা যাবে না!!! আর রাখলেও তা ডাক্তারের কাছে আনা যাবে না!!!
– না হলে তো হবে না!! এটা তো আর কমলা স্টুডিও নয় যে টুক করে একটা সেলফি তুলে প্রিন্ট করে আপনাকে দিয়ে দেব!!
সবাই হেসে উঠলো।
বললাম- এটা হাসির কথা নয়। বলুন, আপনার কি কি হয়েছিল!
মহিলা শুরু করলেন : সাড়ে সাত বছর আগে অ্যাপেন্ডিক্স, চার বছর আগে গল ব্লাডার, সাত মাস আগে সিজার অপারেশন হয়েছে!
– আর কিছু অসুখ? কোন ওষুধ খান?
– না।
– খাওয়া দাওয়া ঘুম, পায়খানা প্রস্রাব ঠিকমত হয় তো?
– হা।
– ব্যথাটা কখন হয়? খাবার আগে না পরে?
– সবসময়। সবসময়ই নড়েচড়ে আর হালকা মিষ্টি মিষ্টি ব্যথা হয়!
এই আর একখান কথা!! ব্যথা, সে আবার মিষ্টি!! মেডিকেল সায়েন্স পড়ে সতেরো রকম ব্যথা যদিও বা জেনেছি, মিষ্টি ব্যথা কি তা জানা হয়নি!
তবুও ভালো, ব্যথাও কখনো কখনো মিষ্টি হয়!! আমাদের মতে- এই মিষ্টি ব্যথা ততটা তীব্র নয়। এবং সাধারণত ওষুধ ছাড়াই সেরে যায়!
– কড়া মিষ্টি না হালকা? হাসলাম।
রোগীসহ বাকিরা হেসে উঠলো। – হালকা হালকা ।
মনে মনে বললাম : এ ব্যথা কি যে ব্যথা – জানে কি আনজনে! সজনি আমি বুঝি …
– তা এই হালকা মিষ্টি ব্যথা আর নড়াচড়া কতদিন চলছে বলুন? আপনার ঋতুস্রাব ঠিক মতো হয়?
– কি যে বলেন! জানেন না বাচ্চা হবার পর ওসব বন্ধ থাকে! এই তো সাত মাস হলো বাচ্চা হয়েছে!
– জানি। আপনি বলুন আগে আপনার ঋতুস্রাব ঠিকমতো হতো কিনা।
– হ্যাঁ। ঠিকমতো হতো।
– আচ্ছা। এবার বলুন, এই কাটা দাগ বরাবর ব্যথা হয় কি??
– না তো।
সিজার অপারেশনের কাটা দাগ বরাবর ব্যথা হয় অনেকেরই। এটা খুব কমন। কিন্ত সে ব্যথা নড়েচড়ে না, তেমন মিষ্টি ও নয়! সবার হয়ও না।
ভাবলাম, সিজারের কোন রকম কমপ্লিকেশন হতে পারে। পেটের ভেতর নানা রকমের আলাদা কারণ ও হতে পারে। কতকটা পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে, কতগুলো কারণ ধরা পড়বে না। রোগীর ক্লিনিক্যাল কন্ডিশন দেখে বুঝতে হবে।
যাই হোক, বললাম শুয়ে পড়ুন টেবিলে।
উপরের পেট দেখলাম। না, তেমন কিছু নেই।
মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মিষ্টি ব্যথা। দেহতত্ত্ব। কি হতে পারে?
সত্যি বলছি, কখনো কখনো আমরা কারণ খুঁজে পাই না। তখন অসহায় বোধ করি। প্রচলিত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের যতটা শিখিয়েছে, তাতে সব রোগের সব কিছু চোখে দেখে বা মেশিনের সাহায্যে বলে দেব, এমন বাবাজী-মার্কা দাবি আমরা করতে পারি না। বলা ভালো, আমাদের সেই দাবি করা মানায় না। বিজ্ঞান সেটা অ্যালাউ করে না! প্রতিদিন এমন কোন না কোন রোগী আমরা পাই, যাঁদের সমস্যা ঠিকঠাক আমাদের অর্জিত জ্ঞানের সাথে মেলে না। আমরা বিকল্প পথ ভাবি। কখনো একটা ওষুধ সাময়িকভাবে ব্যবহার করতে বলি, অন্য পরীক্ষা করাই, অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠাই। সেটাই নিয়ম।
মানছি, তাতে সাধারণ মানুষের কতকটা অসুবিধা হয় সন্দেহ নেই, কিন্ত আমাদের হাতে পায়ে শেকল। বিজ্ঞান জলপড়া তেলপড়া আর চিনির দানার মত সহজ নয়!
মনে মনে ভাবছি, যদি আমি আজ এনার মিষ্টি ব্যথার কারণ না বুঝতে পারি, আমার দেহতত্ত্ব জ্ঞানে যদি না কুলোয়, তাহলে কি করবো। পরবর্তী পরীক্ষা করানো যেতে পারে। কখনো কখনো এমনও হয় অপারেশন করে, মানে পেট কেটেও দেখতে হয় কি অসুবিধা। অবাক হবার কিছু নেই! কখনো কখনো ডাক্তার পেট কেটে দেখতে চাইতে পারেন আসল সমস্যা কি!
এটা প্রমাণিত সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই সেটা খুব কাজে দেয়। রোগীর সমস্যাও দূর করা হয়! কোন কোন ক্ষেত্রে আবার কিছুই পাওয়া যাবে না!!!
এবার সাধারণ মানুষ এবং দেহতত্ত্ব বিজ্ঞানী মিডিয়া এসব খবরকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে বেড়ায়- দরকার ছাড়া অপারেশন করেছে ডাক্তার, অতএব গাফিলতি!!!
বেচারা ডাক্তার সেটা বুঝিয়ে বলার আগেই তাঁর দিকে উড়ে আসে চড় থাপ্পড় চেয়ার টেবিল জুতো বিষ্ঠা!!
আর আইন কানুন বিচার প্রশাসন নেতা, যাঁদের কাছে এই দেহতত্ত্ব জ্ঞানের সামান্যটুকুও নেই, তাঁরা ও বলতে থাকেন- এটা কেন করা হলো, ওটা কেন করা হলো, ব্যাখ্যা কি?
বলি কি, দেহতত্ত্ব যদি এতই সহজ হতো, তাহলে ডাক্তার লালন ফকির হয়ে যেত!!! অথবা বাবাজী সেজে নানা রকম মহৌষধি ব্যবহার করা শেখাতো!!!
যাইহোক, পেটের নিচের দিকে ইউএসজি প্রোব রাখতেই প্রায় উল্টে পড়ে যাবার জোগাড়।
কতকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সম্ভব!সম্ভব! পৃথিবীতে সবই সম্ভব!! আর আমাদের দেশে তো আরোই!! দেহতত্ত্ব না জানিলে ….
বললাম, আপনার আগে ক’টা বাচ্চা?
– চারটে! একটা সিজার, তিনটে নর্মাল। একটা মারা গেছে।
– হুম। ছেলে ক’টা??
– দু’টো।
বুঝলাম, এ দেশে দেহতত্ত্ব জেনে লাভ নেই!! দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ডাক্তার চেষ্টা করবে মানুষকে একটুখানি পরিষেবা দিতে। যত দেবে তত বেড়ে যাবে চাহিদা। তত বেড়ে যাবে রোগীর লাইন। তত কমে যাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ। তত বেড়ে যাবে সব কিছুর দাম। তত বেড়ে যাবে ডাক্তার পেটানো। তত বেড়ে যাবে ডাক্তারকে শারীরিক মানসিক আঘাত দিয়ে পঙ্গু করে তোলা।
বেড়ে যাবে হিংসা ঘৃণা যুদ্ধ রক্ত বোমা আগুন নিয়ে খেলা! তত বেড়ে যাবে ধর্ম বাবাজী ভণ্ড গোঁসাই জ্যোতিষী অপবিজ্ঞান অবিজ্ঞান!! আমরা হাহুতাশ করবো। একদল ফায়দা লুটতে নেমে পড়বে।
কোন পথ নেই!!
ধ্যাত্তেরিকা!! দেহতত্ত্ব জেনে লাভ নেই আমার!!!
বললাম – আপনার মিষ্টি ব্যথা কমার কোন লক্ষণ নেই !!
মহিলা উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছেন- কি হয়েছে ডাক্তার বাবু?? বড় সমস্যা??
– হুম বড় সমস্যা। আপনার মিষ্টি ব্যথার কারণ গোকুলে বাড়ছে!!! আপাতত কমার কোন লক্ষণ নেই।
– কি হয়েছে বলুন??
– না না তেমন কোন অসুখ নয় এটা (বলতে পারিনি যে, এটা সবচেয়ে বড় অসুখ!)। আপনার ভয়ের কিছু নেই। (আসলে ইনি বা এনার মত মানুষের পরিবারের লোকেদের আর কিসের ভয় !! ভয় তো এই দেশটার!!)
– তাহলে নড়েচড়ে কি জিনিস??
ঠিক এই সময় আমার মনে পড়লো লালনগীতি!!! কি কেলো!!! ভাবছি গানটা চালিয়ে দেব কিনা!!! ঠিক হবে কি?? আচ্ছা, কাজটা সেরে নিই।
মনে পড়লো লালনগীতির লিরিক্স !
“আমার পেটখানায় কে বিরাজ করে।
জনম ভরে একদিনও তারে দেখলাম না রে।।
নড়েচড়ে নিচের পেটে দেখতে পাইনে এই নয়নে”
(দুঃখিত, গানটা বিকৃত করলাম বলে)
দেহতত্ত্ব না জানলে যা হয় আর কি!!!
– সাড়ে ছয় মাসের দুই বাচ্চা আপনার পেটে ! তাঁরা মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে একটুখানি হাতাহাতি লাথালাথি করে এই যা!!
হেসে ফেললাম। সবাই মিলে !
হাসা উচিত ছিল কিনা কে জানে! এও তো আমার নিজের দেহতত্ত্ব !! সেই যে গানখানা- “আমি এক ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউলে আমার আপন দেহ”!
জানতে আর জানাতে পারলাম কই – কেন আমি হাসি, কেন আমি কাঁদি!!
মহিলা টেবিল থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। এমন চোখ করে তাকালেন আমার দিকে যে ভয় পেয়ে গেলাম!!
তাড়াতাড়ি বললাম- উঠবেন না উঠবেন না!
মহিলা বলতে শুরু করলেন- কি বলছেন আপনি?? ভালো করে দেখুন।
এমন ভাব করলেন যেন ব্যাটা ডাক্তারই কালপ্রিট!!!
ভাবলাম একবার বলেই ফেলি- এতে ডাক্তারের হাতও নেই, মাথাও নেই!!! এ যে দেহতত্ত্বের খেলা!!
আসলে আমাদের সব কিছু বলা মানায় না। অথচ মানালে, বলতে পারলে হয়তো বলতাম অনেক কিছুই!!!
বললাম- আমার মেশিন আর আমার ডাক্তারি নলেজ বলছে, আপনার পেটে যমজ বাচ্চা আছে। তাদের নড়াচড়াই আপনি অনুভব করেন। কোন রকম ভুল হবার চান্স নেই!!!
সবক্ষেত্রেই, অর্জিত জ্ঞান সঠিকভাবে ব্যবহার করলে ভুল হয় না !
মহিলা প্রথমে যতটা অবাক হয়েছিলেন, এক মুহূর্তে সেটা কাটিয়ে সবাক হয়ে উঠলেন। বুঝতে পারলেন আমি ভুল বলছি না। কিন্ত পরক্ষণেই যেটা করলেন সেটা আরো বিস্ময়কর!
– কোথায় কোথায়? একটু দেখাবেন??
বললাম : এই দেখুন দু’টো মাথা। বাকিটা দেখানো যাবে না!!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম – মহিলার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত অপ্রাকৃত হাসি। সে হাসির আড়ালে চাপা পড়ে গেল একটু আগের উদ্বেগ, অবিশ্বাস। চাপা পড়ে গেল আরো অনেক কিছু! সে আর আমার বলা উচিত না! বুঝে নিতে হবে !!!
কাজ শেষ হলে নেমে দাঁড়ালেন। সৃষ্টিকর্তা বলে যাকে মানেন, তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন- বাচ্চাগুলা ভালো থাকে যেন!
স্বামী এলেন। তিনিও খুশি।
বাহ্ বাহ্। এই না হলে …
আমি অন্য রোগী দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ মহিলার কি হলো কে জানে, এসে জিজ্ঞেস করলেন : আচ্ছা ডাক্তার বাবু, এমন কি করে হতে পারে??? আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না এতদিন!!
বললামঃ এটা হয় । যাঁদের অনেকগুলো বাচ্চা হয়, একটা সময় তাঁদের শরীরে বাচ্চা হবার লক্ষণ গুলো আর তেমন করে ফুটে ওঠে না। প্রথম বার প্রেগন্যান্ট হলেও এমন হয় কখনো কখনো ।
– কিন্ত বাচ্চা হবার পর তো …
বুঝে গেলাম। বললাম- এটা একটা সমস্যা। বাচ্চা হবার পর অনেকের এই সমস্যা হয়। তার জন্য দরকার নিয়ম মতো চলা, একটুখানি পড়াশোনা করা, দরকারে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। পরীক্ষা করানো।
– কিন্ত …
– কোন কিন্ত নেই এতে! শরীর নিয়ে একটুখানি জানা দরকার!! কখন কি করা যায়, কখন করা যায় না, সব জানতে হয় ।
অবাক হয়ে দেখলাম – মহিলার কোন টেনশন অব্দি নেই!! পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা নিয়ে একটা পরিবার কিভাবে চলতে পারে, তাদের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে সেই , তাঁরা আদৌ সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে কিনা – এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই!!!
অথচ কি অবাক কাণ্ড, আমার টেনশন হচ্ছে!!
কি জানি, এরপরও হয়তো আবার এরকম পেটের মধ্যে নড়াচড়া করতে করতে আসবে এক বা একাধিক সন্তান! হয়তো হাজারো মহিলার পেটে এমনি করে নিজের অজান্তেই চলে আসছে ভবিষ্যৎ বিহীন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম! একটা দেশের একশো পঁয়ত্রিশ কোটি জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জানেই না এই দেহতত্ত্ব! জানেই না এমন মিষ্টি ব্যথার কারণ হতে পারে প্রেগন্যান্সি!!! শুধু জন্ম দিয়ে যাঁরা গর্বিত, তাঁরা দেহতত্ত্ব দিয়ে করবে টা কি???
না, কারো এ বিষয়ে মাথা ব্যথা অব্দি নেই!!
মাথা থাকলে তবেই তো মাথা ব্যথা- এমন বলবো না, বরং বলবো মাথা আছে। অব্যবহৃত। সব জেনেশুনেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের দেশের নেতাদের এ বিষয়ে হিরন্ময় নীরবতা লক্ষণীয় ।
এ দেশের মানুষের দেহতত্ত্ব সম্বন্ধীয় ধারণা বোঝা আমার দ্বারা সম্ভব নয় বুঝলাম।
হায় রে !!
কেন যে ডাক্তারি পড়লাম!!!
একটা মিষ্টি ব্যথা ক্রমশঃ কড়া তেতো বিষাক্ত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ছে আমার চিন্তা চেতনায়। ব্যথা এ দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে। সে ব্যথা এই অনাগত সন্তানদের জন্য। ব্যথায় অবশ হতে হতে কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলছি।
আমি কি সূক্ষ্ণ দেহ ধারণ করতে চলেছি???
টের পেলাম বুকের ভেতর বাম পাশে কে যেন নড়েচড়ে উঠলো। ডাক্তার মাথা তাকে এক জোর ধমক দিল! চুপ, হতভাগা বেয়াদব কসাই ডাকাত অসুর!!! একদম চোখ খুলে তাকাবি না!!! ভেবে নে, তুই এখন সূক্ষ্ণ দেহ ধারণ করেছিস!!!
চাপ তাপ ব্যথা বেদনা প্রেম ভালোবাসা ঘৃণা সব হারিয়ে ফেলেছিস!! সঅঅঅব!!!
আমি পজ্ করা লালনগীতি খানা চালিয়ে দিলাম –
সবার সামনেই গেয়ে উঠলাম- আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে ….
সত্যি খুব ভালো লাগলো। মনে হচ্ছে দু একদিনের মধ্যে রাধাকৃষ্ণ তত্ব নিয়ে কিছু লিখবো। শুনেছি যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে এই দেহভান্ডে – যদিও এর ব্যাখ্যা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। তাও একটা ব্যর্থ চেষ্টা না হয় করবো। হরেকৃষ্ণ …….