ডা অনির্বাণ জানার স্মৃতিচারণের আজ সপ্তম পর্ব। করোনা অতিমারী, লকডাউন, আম্পান…ডক্টরস ডায়ালগের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করেছে। আগের পর্বগুলির সূত্র দেওয়া হল তাই সপ্তম পর্বের আগে।
- https://thedoctorsdialogue.com/day-of-a-doctor/
- https://thedoctorsdialogue.com/from-rammam-to-joldhaka/
- https://thedoctorsdialogue.com/miraculous-escape-from-a-jeep-accident/
- https://thedoctorsdialogue.com/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a6%a6-%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%95%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%87-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a7%87/
- https://thedoctorsdialogue.com/mother-in-memory/
- https://thedoctorsdialogue.com/anirban-jana-memoirs/
একটা বয়সে পৌঁছে যাওয়ার পর অনেক নির্লিপ্তভাবে অতীতের দিকে তাকানো যায়। আজকের ‘আমি’র থেকে সে অনেক আলাদা, অপরিণত। শীতের রাতে কফির কাপ হাতে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আলগোছে রাঙা ভাঙা চাঁদের দিকে তাকিয়ে যখন হারানো আমি’কে খুঁজে বেড়াই তখন কোথাও যেন মন বলে এটা তো হবার ছিল। “There’s nowhere you can be that isn’t where you’re meant to be…” জন লেনন মনের ভেতর বলে ওঠে।
অথচ সেই আমিটার কি ভয়ংকর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ছিল। জলঢাকা থেকে বদলি হয়ে এলাম ব্যান্ডেল থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে। পিজি এন্ট্রান্সে সেবার চান্স না পাওয়ায় একটা মনকষ্ট তো ছিলই, তার ওপর সেই কাটা ঘায়ে দেবার জন্য সবার কাছে নুনের অফুরন্ত সাপ্লাই ছিল। বিদ্যুৎপর্ষদের সিএমও সাহেব বললেন “বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি। বউ আর বই একসাথে যায়না।” বাবা ভীষণ অনুতপ্ত – “ইসস, গতবছর রিকাউন্সেলিং-এ ডিসিএইচ আসছিল, এ সুযোগ কি আর আসবে?”
জানি তাঁরা সবাই আমার শুভানুধ্যায়ী। তাঁদেরও আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবু যেন মনে হতো বড়ো অবজ্ঞার পাত্র হয়ে গিয়েছি। কথাগুলো কোনোভাবে স্ত্রীর কানে যেতো। সে বেচারি যেন মরমে মরে থাকতো। সে বছরই বাবার হার্টের কিছু সমস্যা ধরা পড়লো। মায়েরও সুগার ধরা পড়লো সে বছর।
কিন্তু সবথেকে কষ্ট পেলাম অরিজিতের কথায়। অরিজিৎ আমার স্কুল বেলাকার বন্ধু। খুব স্পষ্ট বক্তা। আর কিছুটা নির্ভীকও বটে। ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে আমরা থাকতাম। মনে আছে বড়ো মহারাজ স্বামী সোমানন্দ ক্লাস নিচ্ছেন – ‘মনের ব্যায়াম’। মনঃসংযোগ বাড়ানোর ক্লাস। সমস্ত বাহ্যিক চিন্তাভাবনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনে দুই ভুরুর মাঝখানে মনকে স্থির করা। বড়ো একটা শতরঞ্জিতে আমরা ক্লাস সেভেনের ছেলেরা বসে আছি। সামনে বড়ো মহারাজ ধ্যানস্থ। আমরাও যে যার মতো মনকে দুই চোখের মাঝখানে আনার চেষ্টা করছি। হঠাৎ কোমরে মারাত্মক খোঁচা। ক্লাসের সবথেকে দুষ্টু ছেলে প্রসূন ঠিক আমার পেছনে ধ্যানমগ্ন। মুখে মিচকে হাসি। আমি আবার ঠেলেঠুলে মনটাকে কোমর থেকে দুভুরুর মাঝখানে তুললাম। আমার পাশে বসেছিল অরিজিৎ। কিছুক্ষণ পরে অরিজিতের চেঁচামেচি – “আমার চুল টানলি কে শীগগির বল, নইলে অনর্থ হয়ে যাবে।”
কেউ কোনোদিন মহারাজের ক্লাসে টুঁ শব্দ করার সাহস পায়নি, সেখানে অরিজিতের এহেন চিৎকার। মহারাজ তাঁর আয়ত চোখ খুললেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বন্ধ করে নিলেন।
মহারাজ ঠিক সময়ে ক্লাস শেষ করে চলে গেলেন। আর কি আশ্চর্য, হেডস্যার প্রায় সঙ্গেসঙ্গে ক্লাসে ঢুকে আমাদের তিনজনকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সিসি ক্যামেরা বিহীন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে হেডস্যার কিকরে আমাদের মতো মনুষ্যেতর প্রাণীদের কীর্তিকলাপ টের পেলেন কে জানে! পুরো ঘটনা নির্ভীকভাবে অরিজিৎ বলে গেল। আমি বেকসুর খালাস পেলাম। প্রসূনের ‘মনের ব্যায়াম’-এর পর ‘কানের ব্যায়াম’-এর ক্লাস শুরু হ’ল।
চিরকালই অরিজিৎ স্পষ্টবক্তা। ও প্রায়শই আমাদের বাড়ি ঘুরতে আসতো। একবার মাকে বলে বসলো “কাকিমা, তুমি অনির্বাণের থেকে আমাকে ছোটো ডিম ভেজে দিয়েছো।” মা সঙ্গেসঙ্গে প্লেট দুটো বদলে দিয়েছিল। ও আমার পরের বছর জয়েন্টে চান্স পেয়েছিল। ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করার সাথে সাথে অপথ্যালমোলজিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করে। তারপর সাউথ ইন্ডিয়াতে চলে যায়। সেখান থেকেই বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল একদিন।- “আসলে তুই কোনও দিনই স্ট্যান্ডার্ড ছেলে ছিলিনা। ভাগ্যক্রমে ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে গিয়েছিলি। আর পিজি এন্ট্রান্সে লোক হাসাতে বসিস না।” চোখে জল চলে এসেছিল। অর্ধাঙ্গিনীকে বলেছিলাম, সে তখন সন্তানসম্ভবা। দুঃখ ভাগ করে নিয়েছিলাম সেইদিন।
ব্যান্ডেলে আসার পর একটা সুবিধা হয়েছিল। ওখানে স্বপনদার সাথে দেখা। ডিপিএম করছে। সাথে সাথে পিজিরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেশ সাহায্য করতো। ব্যান্ডেলে বিদ্যুৎপর্ষদের ছোট হাসপাতাল, দশজনের মতো ডাক্তার। কাজের চাপ সেরকম ছিলনা। আর কাজও ভাগ করে নেওয়া যেতো। ফলে মোটামুটি পড়াশোনা করতে পারছিলাম। ভৌমিকদা, সাঁতরাদারা সবরকম সাহায্য করতেন।
এরমধ্যে আমাদের পুত্রসন্তান হ’ল। সিজার করলেন ডাক্তার বেলাল হোসেন। এমারজেন্সি অপারেশন। তড়িঘড়ি করে পৌঁছলাম ওদের কাছে। ওটি থেকে বেরিয়ে অর্ধচেতন অবস্থাতে স্ত্রী আস্তে আস্তে বললো যে ওর বাবার চেম্বারে একটা নতুন হ্যারিসন বই আছে। অর্থাৎ, আমি যেন অযথা সময় নষ্ট না করি।
পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়না ফেলে আসা পথটা এতটা অনায়াস ছিলো। অনেক চোখের জল, অনেক ঘাম মিশে আছে তথাকথিত সাফল্যের পেছনে। এটাই কি সাফল্য? আজ সারাদিনের পরিশ্রম, ক্লান্তির পর যখন অন্যরকম টেনশন তাড়া করে তখন মনে হয় “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই…….”। অপারেশনের কমপ্লিকেশন বা কিছু অনভিপ্রেত পেশাগত জটিলতা মনের শান্তি কেড়ে নেয়, কেড়ে নেয় রাতের ঘুম। ল্যাপটপের নীল আলো বলে “হেথাকে তুরে মানাইছেনা রে”। মনে হয় এই দিনটার জন্য সেদিনের পরিশ্রমটা ছিল না।
সেদিন তেরোই ফেব্রুয়ারী। কলকাতায় কোনো একটা কাজে গিয়েছিল বাবা। রেজাল্ট দেখে সেখান থেকেই ফোন করে- “খুব ভালো র্যাঙ্ক হয়েছে। মনে হচ্ছে তোমার পছন্দের সাবজেক্ট পেয়ে যাবে।”
সেদিন অনেক রাতে অরিজিতের ফোন। মা ধরেছিল। মায়ের একপাশের কথা কানে আসছিলো – “তুই ঠিকই বলেছিলি, অনির ভেতরের বারুদটা ভিজে যাচ্ছিল। ওকে কাঁদিয়ে দিয়ে ভালোই করেছিলি।… না, না, ও আজ পর্যন্ত জানেনা….. নে, ফোনটা তোর বন্ধুকে দিচ্ছি – কথা বলে নে।”
গলার কাছে কান্নার দলা আটকে আসে। মাকে জিজ্ঞেস করি – “সত্যি, মা?” মা জানতো আমার ভেতরে জেদ জাগানোর জন্য অরিজিৎ অপমান করেছিল।
ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপতে চাপতে কানে রিসিভার ধরে বলি – “তোর মতো বদমাশ বন্ধু আছে বলে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, অরিজিৎ।”
এত ভালো হয়েছে লেখা টা যে কি বলবো, এই গল্প আমাদেরও মনোবল বাড়াবে, অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো ।
ধন্যবাদস্বাতী?
দারুন লেখনী অনিরুদ্ধ। আরো ও পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।অভিনন্দন জানাই।
প্রতিবারের মতোএবারেও আমার নাম ভুল লিখেছেন। তবে নামে কি আসে যায়….??
ডাক্তার সাহেব, আপনার শুধু এই সিরিজ নয়, অন্যান্য লেখা গুলোর ও প্রশংসা করার ভাষা আমার রসদে নেই। শুধু বলি, অপার মুগ্ধতা নিয়ে আপনার লেখা পড়ি এবং পরেরটা পড়ার অপেক্ষায় থাকি। আর মন বলে যে, আপনাকে বলি- ঐ সার্জিক্যাল ছুরি- কাঁচি ছেড়ে দিয়ে শুধুই কলম তুলে নিন। বাগ্ দেবী তাতে বোধ হয় খুশিই হবেন ! অবশ্য সেক্ষেত্রে আমরা একজন দক্ষ ও দরদী ডাক্তার সাহেবের অভাব বোধ করবো। আপনার লেখা ধার করে বলি, অরিজিতের মত বন্ধু আছে বলে যেমন নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে, ঠিক তেমনই আপনার লেখা পড়ে নতুন করে আবার সাহিত্য পড়তে ইচ্ছে করে! ভালো থাকবেন, ডাক্তার সাহেব!
অনেক ধন্যবাদ দাদা। আপনার প্রশংসা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। ♥♥♥
আপনার এই গল্পটা যে আমার কতটা উপকারে লাগলো, বলার ভাষা নেই। “সফলতার চূড়ান্ত শিকড়ে পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় ” আপনার গল্প আমায় মনে করিয়ে দিল।।।।অসংখ্য ধন্যবাদ Sir আপনাকে ???