কেন/ কোথায়/ কীভাবে মাত্রাতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় সে বিষয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। স্বাভাবিকভাবেই এমন কিছু কথা আসবে যেগুলো অনেকেরই পছন্দ হবে না। একে, একে আসি-
১.
গবাদী পশুর খাদ্যে, মাছ কিংবা মুরগী চাষের জায়গায় অজস্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। কীভাবে আসে কিংবা কারা জোগান দেন সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বৃথা। এই খুল্লমখুল্লা নৃশংসতা (শব্দটা ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করছি) সবার চোখের সামনেই চলে।
২.
পাশ করা ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়াই উমুক দাদা, তমুক কাকা, পাড়ার গুমটি দোকান ইত্যাদি সব জায়গাতেই চাইলে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। অথচ, আইন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক পাশ করা ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা নিষিদ্ধ।
৩.
মোড়ে মোড়ে মেডিক্যাল কলেজ আর বিভিন্ন ধরনের পেছন দরজার কল্যাণে ডাক্তারি-শিক্ষা যে জায়গায় গেছে (ক্রমাবনতিও সুস্পষ্ট) তাতে ডাক্তারি পরীক্ষা খাতায়-কলমে পাশ করলেও ‘ডাক্তার’ তৈরি হচ্ছে কিনা জোর দিয়ে বলা মুশকিল। ডাক্তারের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞান না থাকলে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বাড়বেই।
৪.
ডাক্তারি শেখা নয়, লক্ষ্য ও মোক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে নামের পাশে বড় ডিগ্রি। এ চক্রের শেষ কোথায় কেউ জানে না। এমবিবিএস ডিগ্রি এখন সাধারণের চোখে ‘পাতি ডিগ্রি’। কাজেই ডাক্তার লেজের বহর বাড়াতে চাইবেনই। ওয়ার্ডে ঘোরার বদলে এমসিকিউ বইতেই ডাক্তারি পড়ুয়ার জগৎ সীমাবদ্ধ। ফলে, রোগী না দেখেই পাশ করা ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ, এমন বহু অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তারকে জানি যাঁরা তাঁদের ডাক্তারি সংক্রান্ত সামগ্রিক জ্ঞানে (জ্ঞান মানে এমসিকিউ বইয়ের জিন আর প্যাথোজেনেসিস মুখস্থ করা বুঝবেন না) লম্বা লেজের ডাক্তারকে গুনে গুনে দশ গোল দেবেন। কাকে দায়ী করবো? ডাক্তারি পাঠ্যক্রম? নাকি সামাজিক চাপ?
৫.
অনেক ডাক্তার একবার চুটিয়ে প্র্যাক্টিস শুরু করার পর আর বইয়ের ছায়া মাড়ান না। বছর তিনেক পড়াশোনার বাইরে থাকলে ডাক্তারের জ্ঞান তলানিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নতুন কিছু ভাবার ইচ্ছেটাই চলে যায়। রোগীর কথা শোনার আগেই প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ!
৬.
এমবিবিএসের পাঠ্যক্রমে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সাধারণ নিয়ম, নবজাতক কিংবা শিশুর সাধারণ যত্ন, সাপের কামড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বুড়ি ছোঁওয়ার মতো ছুঁয়ে যাওয়া হয়। বিরল রোগ নিয়ে পাতার পর পাতা আলোচনা হয়। অথচ, রোজকার চিকিৎসার সিংহভাগ জুড়ে থাকে এই জিনিসগুলোই। ‘কোন অ্যান্টিবায়োটিক কখন, কাদের, কীভাবে দিতে হবে’ -এই বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব পায় না।
৭.
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার অভাব। বিশেষ করে শিশুদের চিকিৎসার কথা বলবো। বড়দের থেকে বাচ্চাদের রোগগুলো অনেকটাই অন্যরকম। যে ডাক্তার বাচ্চাদের চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত নন তিনি স্রেফ ভয় পেয়েই বাচ্চাদের যে কোনও জ্বর, কাশি, পাতলা পায়খানায় অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চাইবেন।
৮.
প্র্যাক্টিসের প্রতিযোগিতা। পাছে রোগী হাতছাড়া হয়ে যায় সেই ভয়ে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। ভাইরাসঘটিত রোগের মতো লক্ষণ নিয়ে দশজন রোগী এলে তাদের মধ্যে এক-দু’জনের (সেটা সেকেন্ডারি ইনফেকশনই হোক বা একইরকম রোগলক্ষণের ব্যাকটেরিয়াঘটিত ইনফেকশন হোক) হয়তো পরবর্তীতে অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মানসিকতা থেকে ডাক্তার দশজনকেই অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চাইবেন।
৯.
রোগীর তরফে ‘ডাক্তার কিনে বেড়ানো’। জ্বরের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় দিনে তিনজন ডাক্তারের চেম্বারে গেলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডাক্তারের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা বা বদলে ফেলার মানসিক চাপ থাকবেই। যুক্তিনির্ভর চিকিৎসা এমনিতেই বেশ দুর্লভ জিনিস।
১০.
ডাক্তার নিজেকে প্রফেশনালের বদলে ‘ভগবান’ ভেবে ফেলতে চাইলে। “আমার কাছে একবার দেখিয়ে কোনও রোগী সুস্থ না হয়ে বাড়ি যায় না” এরকম মানসিকতা থাকলে অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বাড়বেই।
১১.
‘গুগল ডাক্তার’ সংখ্যায় বাড়ছে। ডাক্তার পাঁচ/সাতদিন ওষুধ খাওয়াতে বললেন। ‘গুগল ডাক্তার’ কমিয়ে দু’দিনেই ছেড়ে দিলেন। কেননা তাঁর মনে হয়েছে তিনি ‘সেরে গেছেন’। অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ হ’ল না।
১২.
যত বড় অ্যান্টিবায়োটিক, যত দামী ওষুধ তত বড় ডাক্তার। দুর্ভাগ্যক্রমে এরকম একটা ধারণা পাশ করা ডাক্তারদের মধ্যেও অনেকের আছে। কাজেই সাধারণ সর্দিকাশি বা জ্বরজ্বালাতেও ‘অ্যাটম বোম’ গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক আকছার ব্যবহার হয়।
১৩.
অ্যান্টিবায়োটিক সম্ভবত সর্বরোগের মহৌষধ বলে ধরে নেওয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া প্রেসক্রিপশন করার পরে শুনতে হয়- “ডাক্তার ইচ্ছে করে ভালো ওষুধ দেয়নি। যাতে রোগ না সারে আর বারবার চেম্বারে ছুটতে হয়।” এই তো আমার দেশ! ডাক্তার কেন খামোখা জগৎ উদ্ধারের দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকবেন?
১৪.
ওষুধে ‘ওষুধ’ নেই! সর্ষের মধ্যেই ভূত! এমনকি যথেষ্ট নামকরা কোম্পানির ব্রান্ডেও যথাযথ ওষুধ থাকে না, এ অভিযোগ বারবার উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণিতও। নকল গড় রক্ষা করবে কে?
১৫
.”ডক্টরসাব, বাচ্চাকো ভর্তি কিয়া। আগর আসলামকা কুছু হয়ে যাবে তো… আপকা হসপিটাল আউর আপকো ভি…”
ডাক্তারিটা দিনের শেষে পুরোপুরি অনিশ্চয়তার খেলা। ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে রাখলে কে কবে ছবি আঁকতে পেরেছে? গান বেঁধেছে? কবিতা লিখেছে? হুমকি আর নিগ্রহের সামনে যুক্তিনির্ভর চিকিৎসার ইচ্ছেটুকুও চলে গেলে দায় কার? ডাক্তারের? এসব পরিস্থিতিতেই তো অমোঘ উক্তিগুলো উঠে আসে… “ফা* ইয়োর র্যাশনাল ট্রিটমেন্ট। ফার্স্ট সেভ ইয়োর ব্যাক। থ্রো এভ্রিথিং অন দেম। এভ্রি পশিবল অ্যান্টিবায়োটিক অ্যান্ড অল…”
*****
অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কিছু কারণ আলোচনা করলাম। আরও কিছু লিখতে ভুলে গেছি হয়তো। ওদিকে খুব দ্রুত সবাইকে ছাপিয়ে মৃত্যু ও যন্ত্রণার সবচেয়ে বড় কারণ হবে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। এ চক্রব্যূহ থেকে বেরোনো খুব মুশকিল।
(পরের পর্বে সমস্যামুক্তির সম্ভবত ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে আলোচনা করবো)