মেডিকেল কলেজ কলকাতা এশিয়ার প্রাচীনতম হাসপাতাল, ১৮৩৫ সাল থেকে পশ্চিমবগের তথা ভারতবর্ষের কিছু রাজ্য এবং বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছে। এই মেডিকেল কলেজে প্রতিদিন ওপিডি তে প্রায় ২-৩ হাজার মানুষ দেখাতে আসেন, প্রতিদিন বিভিন্ন সার্জিক্যাল ডিপার্টমেন্ট মিলিয়ে প্রায় ৩০ টির মত major OT, ৬০-৭০ টির মত emergency OT হয়ে থাকে। এছাড়াও মেডিসিন ওপিডিতে প্রতিদিন ৬০০ পেশেন্ট দেখা, তাদের যত্ন সহকারে follow up, প্রতিদিন ৪০-৫০ জন রোগীর indoor ভর্তি, কার্ডিওলজি ওপিডিতে প্রায় ৫০০ রোগীরা আসেন তাদের follow up এবং ওষুধ নেওয়ার জন্য। হিমাটোলজি ডিপার্টমেন্ট পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম হওয়ার এখানে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ জন মত রোগী আসেন ওপিডিতে, লিউকেমিয়া ক্লিনিকে সপ্তাহে ৪০-৫০ জন রোগী, এছাড়াও অসংখ্য থ্যালাসেমিয়া রোগী যারা পুরোপুরি এই ডিপার্টমেন্টের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও রেডিওথেরাপি ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ রোগী রেডিয়েশন পান এবং ডে কেয়ারে ১০-১৫ জন কেমো পেয়ে থাকেন। এই সবই খুব ছোটো একটা হিসেব যে, এই টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতালের উপর কত হাজার হাজার পেশেন্ট নির্ভরশীল।
গত মার্চ মাসে মেডিকেল কলেজকে কোরোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতাল (লেভেল ৪) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারপরে এই কলেজে একই সাথে কোরোনা ও নন কোরোনা রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছিল। ৭ ই মে তারিখে মেডিকেল কলেজকে এক্সক্লুসিভ কোভিড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করার পর হঠাত করে আগাম কোনো নোটিশ ছাড়া বা কোনো রকম বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই সমস্ত ওপিডি, ইন্ডোর, রেডিওথেরাপিতে রেডিয়েশন দেওয়ার মেশিন, কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের ইকো, নিউরোসার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, procedures যেমন- angioplasty, radiation therapy, bone marrow transplant, এন্ডোস্কোপি, TMT, ECT (Electric convulsive therapy) কার্যত পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নিউরোমেডিসিন, গ্যাস্ট্রোমেডিসিন, এন্ডোক্রিনোলজি এই ডিপার্টমেন্টগুলোর অস্তিত্ব প্রায় ৩ মাস ধরে নেই বলা যায়। সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে মেডিকেল কলেজের এই যে বিপুল পরিমাণ রোগীরা তারা অন্য হাসপাতালে দেখাবেন। আমাদের হাসপাতালের একটি ভাগে করোনা রোগীদের ভর্তি শুরু হয়, এছাড়া ইডেন বিল্ডিং ও MCH HUBS-এর একটি অংশেও কোরোনা পজিটিভ মায়েদের ও বাচ্চাদের চিকিৎসা শুরু করা হয়। কলেজ হাসপাতালের একটি খুব বড় অংশ কার্যত অচল অবস্থায় পড়ে রইল। আমরা কলেজের পিজিটি, পিডিটি, ইন্টার্ন,হাউসস্টাফ সকলেই এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে নিষ্ঠার সাথে করোনা রোগীদের পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছি, দিয়েও যাব। কিন্তু এই সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে নন-করোনা রোগীদের কি অবস্থা দেখে নেওয়া যাক।
গত ৯০ দিন ধরে মেডিকেল কলেজের মত টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতালে কোন সার্জারী হয়নি, এমারজেন্সি ওটিও বন্ধ। যে সব ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপি, পিডিয়াট্রিক্স, হিমাটোলজি ডিপার্টমেন্টে চিকিৎসা পাওয়ার কথা ছিল তারা চিকিৎসার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, অন্য কলেজে গেলেও সেই কলেজগুলোও একটা বিপুল পরিমাণ পেশেন্টদের আগে থেকেই পরিষেবা দেয়, এই অবস্থায় আমাদের কলেজের পেশেন্ট দের রেজিস্ট্রেশন করাতে যে পরিমাণ দেরি হচ্ছে তাতে ক্যান্সারের মত মারণ রোগ বেড়ে চলেছে, এবং যেদিন ওনারা চিকিৎসার সুযোগ পাবেন সেদিন হয়তো আর চিকিৎসা দেওয়ার কিছু থাকবে না। হিমাটোলজি ডিপার্টমেন্টে যাদের bone marrow transplant হওয়ার কথা ছিল তাদের দেরি হয়েছে, ইতিমধ্যেই পাওয়া খবর অনুযায়ী এইরকম একজনের মৃত্যু হয়েছে।গাইনিকোলোজি ডিপার্টমেন্টে একজন মা IUFD(intrauterine fetal death) নিয়ে আসেন, তাকে অন্য কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোভিডের সাস্পেক্ট না হওয়ায়। উনি আদৌ অন্য কলেজে জায়গা পেলেন কিনা এবং বেশিক্ষণ ধরে মৃত বাচ্চা পেটে থাকায় ইনফেকশন কতটা পরিমাণে বাড়ল তার খোঁজ নেই আমাদের কাছে। যে সব সার্জারীর রোগীরা পূর্বের কয়েক মাসের অপেক্ষার পর সার্জারীর জন্য রেজিস্টারড হয়েছিলেন এই তিন মাসের মধ্যে, তাদের আবার অন্য কলেজে গিয়ে একই পদ্ধতির মধ্যে যেতে কতটা সময় লাগবে সেটা আন্দাজও করা যাচ্ছে না। মেডিসিন,এন্ডোক্রাইনোলজি,কার্ডিওলজি এই ডিপার্টমেন্টগুলোতে হাজার হাজার ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন রোগীর চিকিৎসা হত। ওষুধ না পাওয়ায় তাদের রোগের তীব্রতা বাড়ছে, রোগীরা ইতিমধ্যেই আমাদের ফোন করে জানতে চাইছেন আমাদের ওপিডি কবে খুলবে!! এই রোগীরা কয়েক দিনের মধ্যে এরকম জটিলতা নিয়ে আসবেন তাতে হয়তো আমাদের দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
RNTCP ডিপার্টমেন্ট যেখান থেকে টিবির ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে তাও প্রায় ৩ মাসের মত জন্য মানিকতলাতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে,ফলে রোগীদের হেনস্থার শিকার হতে হয়। ইতিমধ্যেই খবরে দেখিয়েছে যে টিবি রোগের ওষুধ না পাওয়ার জন্য টিবি তে মৃত্যুর সংখ্যযা বেড়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে করোনা রোগে রোগীদের মৃত্যুর হারের থেকে অনেক বেশি অসহায়তায় ভুগছেন নন করোনা রোগীরা,আর তাদের অবস্থার কথা আমাদের অজানা। মেডিকেল কলেজের এই বিপুলসংখ্যক পেশেন্টদের অন্য দুইটি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করলেও ১০-১৫ শতাংশের বেশি পেশেন্ট ভাগ করে নেওয়া সম্ভব নয়। উপরন্তু এই রোগীরা ইতিমধ্যেই আমাদের কলেজের পরিষেবা পেতে অন্তত ১০ দিন ওপিডির লম্বা লাইনে ভোর বেলা থেকে দাড়িয়েছেন, তাদের আবার সেই একই হেনস্থার শিকার হতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার চিকিৎসা, পরীক্ষা নতুন শুরু করাতে হবে। গত সোমবার থেকে নামমাত্র ওপিডি খোলা থাকা সত্ত্বেও এবং করোনা হাসপাতাল জানা সত্ত্বেও যে পরিমাণ রোগীরা আসতে শুরু করেছেন, তা দেখেই তাদের অসহায়তার কথা বুঝতে পারা যায়।
করোনা একটি প্যানডেমিক, এবং অন্যান্য রোগের মত এই রোগটিও আমাদের সাথেই থাকবে, তাই কতদিন এই মহামারি তার এই আকার নিয়ে চলবে সেটা হতে পারে আরো দুই তিন মাস কি ৬ মাস, সেটা বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার দিকে মনোযোগ দিয়ে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে একটি মেডিকেল কলেজে গত তিনমাস বাকি সব পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কলেজের একটি বড় অংশ অব্যবহৃত হয়ে আছে যেখানে সহজেই নন করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু করা যায়।
মেডিকেল কলেজের SSB বিল্ডিং এ গুরুতর অসুস্থ (severe) করোনা রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার যথাযোগ্য পরিকাঠামো রয়েছে। কিন্তু কলেজেরই কিছু বিল্ডিংএর গঠন কাঠামো অনেক পুরানো হওয়ার এয়ার ফ্লো ভালো নেই, যে ওয়ার্ডগুলোতে করোনা রোগীদের রাখলে তাদের শ্বাসকষ্ট আরো বাড়বে বই কমবে না। কিছু কিছু বিল্ডিংএ সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন নেই, উদাহরণস্বরূপ এজরা বিল্ডিং। ফলে তিনমাস ধরে অব্যবহৃত এই বিল্ডিং গুলোতে নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা শুরু করা যায়। যেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসার কথা, সেখানেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে। যেমন, SSB বিল্ডিংএ করোনা রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে সেখানে এয়ার কন্ডিশন্ড ওয়ার্ডগুলোতে নেগেটিভ প্রেসার থাকার কথা যা করা হয়নি। গ্রীন বিল্ডিংএ যেখানে করোনা রোগীদের রাখা হয়েছে সেখানে ফিজিকাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে চলা হচ্ছে না ফলে নেগেটিভ রোগীরও সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে। গ্রীন বিল্ডিং এর সি সি ইউ তে নেগেটিভ প্রেসার ও হেপা ফিল্টারের ব্যবস্থা না করেই সেখানে করোনা রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। ফলে চিকিৎসকদের সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে। উপরন্তু, তিন মাস ধরে কোনো রকম CT, MRI কলেজে বন্ধ, ফলে যেখানে করোনা প্রাথমিক ভাবে শ্বাসতন্ত্রের একটি অসুখ সেখানে আমরা CT SCAN ছাড়াই এক্স-রের উপর ভরসা করে চিকিৎসা চালাচ্ছি।
তাই আমাদের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন যে আমাদের কলেজের imaging সুবিধা যা রয়েছে তা দুই প্রকার রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হোক এবং করোনা রোগীদের চিকিৎসায় উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা হোক।
মেডিকেল কলেজের কিছু বিল্ডিংএ করোনা রোগীদের ভর্তি করে বিকল্প ব্যবস্থা করা (যেমন অন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা হাসপাতাল হিসেবে নেওয়া, কম উপসর্গ যুক্ত রোগীদের জন্য লেভেল-৩, লেভেল-২ হাসপাতালের ব্যবস্থা করা বা অন্য কোনো উপযুক্ত পরিকাঠামো সহ হাসপাতাল তৈরী করা) গেলে মেডিকেল কলেজের বাকি অংশে নন করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু হলে উভয় প্রকার রোগীরাই উপকৃত হবেন এবং মেডিকেল কলেজের মত টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতালের অন্যান্য সুবিধা গুলির ও যথাযোগ্য ব্যবহার করা যাবে। উপরন্তু, মেডিকেল কলেজ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সাথে সাথে ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, গত তিনমাস ধরে সমস্ত পিজিটি, পিডিটি, আন্ডারগ্রাজুয়েট,ইন্টার্নদের ট্রেনিং বন্ধ।কলেজ অথরিটি থেকে নন কোভিড পেশেন্ট ভর্তি বা কলেজের ছাত্র ছাত্রী ডাক্তারদের কোনোরকম ট্রেনিংএর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। আমরা এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে অবশ্যই করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে ইচ্ছুক, কিন্তু এর পাশাপাশি নন করোনা রোগীদের চিকিৎসা এই কলেজে শুরু করার জন্য আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
#Doctorsforpeople
#InclusiveNOTExclusive
#UnlockMCK
#Doctorsforpeople