আমরা মনে করিয়ে দিতে পারি না, মনে করানোর সুযোগ দেওয়া হয় না যে রোগীর চিকিৎসার কিছুটা দায়িত্ব ডাক্তারের, কিছুটা রোগীর, আর বেশ কিছুটা সমাজের ও প্রশাসনের।
রাজস্থানে এক গাইনিকলজিস্ট ডাক্তার-ছাত্রী মারা গেলেন। আত্মহত্যা করলেন ড. অর্চনা শর্মা, তথা সমাজ-প্রশাসন মিলে হত্যা করলো এক নবীন ডাক্তারকে। রাজস্থানের ডাউসা এলাকায় এক প্রসূতির চিকিৎসা করছিলেন তিনি, যে প্রসূতি প্রসবের পর রক্তক্ষরণে মারা যান। প্রসূতির বয়স ছিল ২২, তাঁর এটা চতুর্থ প্রেগন্যান্সি ছিল, এবং আগের তিনটিই ছিল মেয়ে সন্তান, যাদের জন্ম হয়েছিল সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে। মেয়ে সন্তান তো আমাদের দেশে শুধুমাত্র বেটি, যারা ঘরের দায় বাড়ায়, আর পণের টাকার ওজন বাড়ায় বাপের সিন্দুকে। তাই ‘আর না কালী’ বলেও রক্ষা পাওয়া যায় না, ২২ বছর বয়সী মেয়েকে গিয়ে উঠতে হয় অপারেশন টেবিলে, সাত রাজার অমূল্য ধন ছেলে নিয়ে আসার জন্য। মেয়ের পর মেয়ে হয়েছে তিনবার, তাই আবার যাও হাসপাতালে ছেলে নিয়ে আসতে, নইলে এবার হয়তো বালিকা বধূকে মেরেই ফেলা হতো। এবারের প্রেগন্যান্সিতে পেটে ছেলে ছিল না মেয়ে কে জানে, কিন্তু মা আর ঘরে ফিরলো না, পোস্ট-পার্টাম হেমারেজের কারণে মারা গেলো হাসপাতালেই! এবারেই জেগে উঠলো সমাজ, জেগে উঠলো পৌরুষ! আমরা ঘরে কেরোসিন ঢেলে বউ পোড়াবো সেটা মানা যায়, কিন্তু চারবারের সিজারিয়ান সেকশনের ধকল সহ্য করতে না পারা মা রক্তক্ষরণে মারা যাবে, এটা কীকরে হতে পারে!
নিশ্চিত ডাক্তারের দোষ ছিল। দোষ ছিল না চতুর্থবার সিজারিয়ান ডেলিভারির, যেখানে প্রথম সিজারিয়ান সেকশনের পরই ডেলিভারি রিস্কি হয়ে যায়, এবং পরপর দুটো সিজারিয়ান সেকশনের পরই সেটাকে ‘হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি’ বলা হয়। এবং এরপরে আর প্রেগন্যান্ট হতে বারণ করা হয়। কিন্তু, আগের তিনটে বাচ্চা তো মেয়ে, তাদের তো সন্তান হিসেবে গণ্যই করা হয় না, তাই ছেলের খোঁজে মাকে অপারেশন টেবিলের হাঁড়িকাঠে চড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল!
ভারতে মায়েদের মৃত্যুর কারণ, অর্থাৎ প্রেগনেন্ট মহিলাদের মৃত্যুর কারণের মধ্যে সবচেয়ে উপরে হলো অবস্টেট্রিক হেমারেজ, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় পোস্ট পার্টাম হেমারেজ (প্রসবের পর রক্তক্ষরণ)। সংখ্যাটা প্রায় ৪৬% এর কাছাকাছি। রাজস্থানের মতো জায়গায় বাল্যবিবাহ এবং কন্যাভ্রূণ হত্যার সংখ্যাটা কীরকম হবে, সেটাও আন্দাজযোগ্য। এতসব ফ্যাক্টরের উপস্থিতির ফলাফল? ড. অর্চনা শর্মার আত্মহত্যা। তিনি সুইসাইড নোটে লিখে গেলেন, ‘I didn’t kill anyone. Please stop harassing doctors for PPH, which is a known complication. Maybe my death will prove my innocence.’
মরে গিয়ে তাঁকে প্রমাণ করতে হলো তিনি নির্দোষ। অথচ রোগীর বাড়ির লোকের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজস্থান পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ৩০২ নং ধারায় কেস দাখিল করলো, যা কিনা খুনের ধারা! একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে খুনের ধারায় কেস করা হলো এইরকম কারণে এইরকম বয়সের একজন পেশেন্ট মারা যাওয়ার জন্য, এটা কি কেবল আমাদের প্রশাসনের দোষ, সমাজের দোষ নয়? কিন্তু সব দোষ ফিরে ফিরে এলো ডাক্তারের ওপর, খুনী প্রমাণের চেষ্টা করা হলো একজন ডাক্তারকে, যিনি তাঁর রোগীর চিকিৎসা করছিলেন এবং মায়ের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টাই করছিলেন।
কোথায়, কবে, কীভাবে আমরা সমাজকে, প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুলবো? ২২ বছরে চারবার মা হতে বাধ্য করা অপরাধ নয়? হ্যাঁ, বাধ্য করাই বলছি, কারণ গাইনি আউটডোর-ওয়ার্ডে কিছুদিন কাজ করলেই সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট বোঝা যায়, এই প্রেগনেন্সিতে মায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-অনুমতির দাম কতোটুকু! মেয়ের পর মেয়ের পর মেয়ে, এই জুয়াখেলায় সব জেনেশুনে ঘরের বৌকে পণ রাখা অপরাধ নয়? এটা খুন নয়? বাচ্চা বানানোরও নয়, ছেলে বানানোর মেশিন হিসেবে ঘরে পণ দিয়ে বৌ আনা সমাজের ক্যান্সারের লক্ষণ নয়? তারপর ডাক্তারের নামে অভিযোগ দায়ের করা হলো ৩০২ ধারায়, যা ভারতের সংবিধান দ্বারা নিষিদ্ধ, এই কেস করার সাহস কীকরে পেলো রাজস্থান পুলিশ? তারা ড. অর্চনার খুনী নয়? একে আমরা শুধুই আত্মহত্যা বলে ছেড়ে দেব? সমাজের প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে ডাক্তারদের হত্যা করা আজ নতুন কোনো ঘটনা নয়, আবার এই রোগীদের চোখেই ‘ভগবান’ স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য সমাজের সে কী ঝুলোঝুলি!
শুধুমাত্র ডাক্তার, ওষুধ আর রোগী দিয়ে চিকিৎসা হয় না। তার সঙ্গে সমাজের দায় থাকে, রোগীর দায় থাকে, রোগীর পরিবারের দায় থাকে, দেশের রাজ্যের প্রশাসনের দায় থাকে। এই প্রতিটি দায় স্বীকার করতে হবে। আজ রাজস্থানের হাসপাতালের পরিকাঠামোর দায়, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যার দায় কে নেবে? সরকার নেবে না, রোগী নেবে না, শুধু ডাক্তাররা নেবে? আর মারা যাবে সমাজের বিষ গলায় ঢেলে?
রোগীর পরিবারকে রোগীর থেকে আলাদা করতে করতে, রোগীর পরিবারকে সমাজের থেকে আলাদা করতে করতে আমরাও কিন্ত ক্লান্ত। ডাক্তারি কোনো সেবা কাজ নয় এখনের দিনে দাঁড়িয়ে, কোনো ডাক্তার অগ্নীশ্বর নয়, রোগীরা পরিষেবা পেতেই আসেন আমাদের কাছে। কোনো সার্ভিসে, পরিষেবা প্রদানকারীকে মেরে ফেলা যায় কি, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া যায় কি? ভারতের সংবিধানে এই অনুমতি আছে? ভেবে দেখবেন, ডাক্তারদের মানুষ হিসেবে ভেবে, একটু ভেবে দেখবেন…