সোদপুরের চেম্বার শেষ করে স্কুটার নিয়ে যখন পাড়ায় ঢুকছি, এগারোটা বেজে গেছে। গলির মোর থেকেই দেখলাম বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছে। বেশ কয়েকটা টোটো, অটো রিক্সা, বাইক দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি একটা এম্বুলেন্স পর্যন্ত হাজির।
এতক্ষণ রোগীরা বেশ ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। ডাক্তারকে দেখেই সকলে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। এম্বুলেন্সটা বেমাক্কা পাড়া কাঁপিয়ে সাইরেন বাজাতে শুরু করল।
পার্থ বলল, ‘আগে এম্বুলেন্সের পেশেন্টকে দেখে দেন। রাস্তাটা পুরো আটকে দিয়েছে। সঞ্জয়দা গাড়ি বের করতে পারছে না। তারপর আপনি খাওয়া দাওয়া করে ধীরে সুস্থে চেম্বারে আসেন।’
‘আর ধীরে সুস্থে…’ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজ রবিবার, বাড়িতে খাসির মাংস হয়েছে। কাল রাতে আমিই সখ করে কিনে এনেছি।
এম্বুলেন্সের পেছনের দরজা খুলে উঠলাম। এক কঙ্কালসার বৃদ্ধা নিথর শুয়ে রয়েছেন। বুকে স্টেথো বসালাম। ল্যাব- ডুব শোনা যাচ্ছে। “প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে।“
কিন্তু মুশকিল হলো শহরের সমস্ত কর্কশে- কঠিনে, সিমেন্টে- কংক্রিটে, ইটে-কাঠে-পিচে- পাথরে, দেওয়ালে- দেওয়ালে প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি শোনা গেল না। আমার ভাগ্যটাই খারাপ। প্রাণ আছে, কিন্তু কতক্ষণ থাকবে বলা মুশকিল।
বললাম, ‘এনাকে তো ভর্তি করতে হবে।‘
বৃদ্ধার ছেলে বললেন, ‘ভর্তিই ছিল ডাক্তারবাবু। এক নার্সিংহোমে দশ দিন ভর্তি ছিল। কিন্তু উন্নতি কিছুই হচ্ছে না। বরঞ্চ দিন দিন অবনতিই হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে যা খরচ, টানতেও পারছিলাম না। যা হওয়ার বাড়িতেই হোক। আপনি স্যালাইন ট্যালাইন লিখে দেন। একটা শেষ চেষ্টা করে দেখুন।‘
আর চেষ্টা। প্রসক্রিপশন লিখতে লিখতে মনে হচ্ছিল, ওই বৃদ্ধার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করছি।
বৃদ্ধার ছেলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘খারাপ কিছু হলে যোগাযোগ করব কিন্তু ডাক্তারবাবু। তখন সার্টিফিকেটটা…’
নির্বাক ঘাড় নাড়ালাম। সেতো বুঝতেই পেরেছি। ভদ্রলোকের দরকার মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট। সেই জন্যই জীবিত অবস্থায় আমাকে একবার দেখিয়ে রাখলেন।
রোগী দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, পরিস্থিতি মানুষকে কখনো কখনো বেশ নিষ্ঠুর করে ফেলে। মা এখনও জীবিত আছেন, তবু ছেলে মাকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছেন। এখন থেকেই মৃত্যু পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন। এই অবস্থায় বৃদ্ধা আবার বেঁচে উঠলে মন্দ হতো না। তবে যা অবস্থা দেখলাম, সে সম্ভাবনা নেই।
তবে এরকম ঘটনা মোটেই বিরল নয়। মৃত্যুর আগেই অনেককে মরে যেতে হয়। সত্য মিথ্যা জানিনা, তবে শুনেছিলাম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন খুবই অসুস্থ, তখনই নাকি এক বিখ্যাত অভিনেত্রী অরবিচুয়ারি লিখে সংবাদ পত্রকে দিয়ে রেখেছিলেন, সৌমিত্র মারা গেলে ছাপার জন্য।
একজন বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে পরের দিন ভোর বেলায় যেভাবে দ্রুততার সাথে বহু বিখ্যাত মানুষের স্মৃতি চারণ খবরের কাগজে বেরিয়ে যায় তাতে মাঝে মাঝে সত্যিই সন্দেহ জাগে।
যাগগে, আমি ডাক্তার, জাহাজের খবর নিয়ে সময় নষ্ট না করে সে সময়ে দুজন রোগী দেখা উচিৎ। তাছাড়া হাত চালিয়ে রোগী দেখতে হবে। রোগীরা ইতিমধ্যেই অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন। সঞ্জীবদার সাথে কারও ঝগড়া বেধেছে শুনতে পাচ্ছি।
পার্থর গলার আওয়াজ পেলাম। রোগীকে বোঝাচ্ছে, ‘ছেড়ে দেন। এনার সাথে তর্ক কোরেন না। রগচটা মানুষ।’
‘রগচটা মানুষ বলে যা বলবে মেনে নিতে হবে।’
পার্থ বলল, ‘আসলে উনি মিলিটারিতে ছিলেন তো। কম বয়সেই রিটায়ার করে গেছেন। মিলিটারিতে তো কম বয়সেই রিটায়ার হয়। তাই মন মেজাজ খারাপ। ওর পর থেকেই উনি অমন খিটখিটে হয়ে গেছেন।’
ভদ্রলোক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ছোটোখাটো চেহারার সঞ্জীবদার দিকে তাকালেন। পার্থর কথা হজম করতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি চুপ করে গেলেন। সম্ভবত ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি সমবেদনায়।
আমি মাস্কের আড়ালে হাসলাম। সামনের রোগিণী চিরতা গেলা মুখ করে তাঁর সমস্যার কথা বলছেন। সমস্যার কোনো শেষ নেই। মাথা বন বন করে। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোয়। ঝিঁ ঝিঁ করে আওয়াজ হয়। হাত পা ল্যাল ব্যাল করে। গলায় লোদ জমে। পায়খানায় গেলে শুধু আম পরে। রাতে শুলে পায়ে শিকটান ধরে। ঘুম হয়না। তবে এই পর্যায়ে তিনি জানিয়ে দিলেন, কোনো অবস্থাতেই তিনি ঘুমের ওষুধ খাবেন না। ভাগ্যিস ভদ্রমহিলা আমার হাসি দেখতে পাননি।
বিকাল সাড়ে চারটেয় রোগী দেখা যখন শেষ করলাম তখন ঝিমোচ্ছি। খালি পেটে থেকে বিচ্ছিরি অম্বল হয়েছে। কিন্তু খাসির মাংস ছাড়া মুশকিল। দুই ছিপি এণ্টাসিড খেয়ে নিলাম।
মাংস রুটি খেতে খেতে আমি, পার্থ, গৌর আর সঞ্জীবদা- চারজনে গল্প করছিলাম। তবে গল্পের বেশি সময় নেই। এরপর একটা মেডিকেল ক্যাম্প আছে। সেখানে এতক্ষণে নির্ঘাত শ’খানেক লোক জড় হয়েছে। ওষুধ পত্র গোছানোই আছে। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যাব।
খেতে খেতে এম্বুলেন্সের বৃদ্ধার কথা উঠল। সেই প্রসঙ্গে সৌমিত্রের প্রসঙ্গ এলো। মৃত্যুর আগেই অরবিচুয়ারি লিখে ফেলা।
পার্থ বলল, ‘এ আবার এমন কী? এতো হামেশাই হয়। একটা খবরের কাগজ গুরুতর অসুস্থ এক বিখ্যাত চিত্রতারকাকে নিয়ে অনেকের লেখা জড়ো করেছিল। ওনার মৃত্যুর পর ছাপা হবে। রাতে গুজব রটে গেল, চিত্রতারকা মারা গেছেন। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় তাঁর প্রতি শোক জানিয়ে একাধিক লেখা ছাপানো হল। পরে জানা গেল মৃত্যু সংবাদটি ভুল, তিনি বেঁচে আছেন। ততক্ষণে কাগজ সকলের হাতে পৌঁছে গেছে। সারাদিন ধরে খবরের কাগজের সম্পাদক অজস্র গালি খেলেন। পরের দিন সকালে সেই সংবাদ পত্রের প্রথম পাতায় ভুল স্বীকার করে বিশাল হেডিং দিয়ে লেখা ছাপানো হল। আগেরদিন যারা শোক জ্ঞাপন করেছিলেন, তাঁরা সেখানে বিখ্যাত চিত্রতারকার দীর্ঘজীবন কামনা করলেন। দুঃখের বিষয় সেই কাগজ যখন সকলের হাতে পৌছালো ততক্ষণে মানুষটি সত্যিসত্যিই মারা গেছেন।‘
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আর গল্প নয়। তাড়াতাড়ি করো। ক্যাম্পে যেতে হবে।‘
সঞ্জীবদার ফোন বেজে উঠল। কথা বলে জানাল, এক বন্ধুর মা ভয়ানক অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। “আমি যাই তাহলে। ক্যাম্পে তো আমার তেমন কাজ নেই।“
সঞ্জীবদা মাথা গরম লোক হলেও পরোপকারী। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে, মৃতব্যক্তিকে শ্মশানে নিয়ে যেতে কখনো না নেই। সঞ্জীবদা বাইরে গিয়েও আবার ফিরে এসে আমাকে বলল, ‘তোর কাছে কী সাজিরহাট শ্মশানের ফোন নাম্বার টা আছে?’
‘শ্মশানের ফোন নাম্বার? এখনই দরকার?’
‘খবর নিতুম রবিবারে শ্মশানের ইলেকট্রিক চুল্লিটা চালু থাকে কিনা। না হলে আবার কাঠের দোকানটায় খবর দিয়ে রাখতে হবে। রোগীর অবস্থা একেবারেই ভালো নয় বলছে।‘