অভয় দিচ্ছি, শুন্ছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা
বসলে তোমার মুণ্ডূ চেপে বুখবে তখন কাণ্ডটা!
আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছে আমার নয় ছেলে –
সবাই মিলে কামড়ে ডেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।
(কবির নাম বাঙালি মাত্রই জানেন)
জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থা অনেকটা ভ্যান গখের Prisoners’ Round ছবিটির মতো।
(ছবি – উইকিমিডিয়া কমনস)
চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে উঁচু দেয়াল – ‘হাসিমুখে’ দাঁড়িয়ে থাকা অশরীরী ‘অভয়া’র অস্তিত্ব, ওর জন্য ডাক্তারদের চৌহদ্দি পেরিয়ে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদে হৃদয় ও বি৮বেকের টানে, কাজে ফেরার জন্য জুনিয়র ডাক্তারদের নিজেদের বিবেকের চাপ, কাজের জায়গায় সুরক্ষা ও নিরাপত্তাহীনতা এবং সর্বক্ষণ ঘিরে থাকা দৃশ্য বা অদৃশ্য পেশিশক্তির আস্ফালন, প্রশাসনের তরফে মূলত নিঃস্পৃহ মনোভাব এবং, সর্বোপরি গতকাল (১২.০৯.২০২৪) আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না হওয়া। কারণ? এদের দাবী ছিল – (১) ৩০ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে আলোচনায় বসতে দিতে হবে (মেনে নেওয়া হয়), (২) মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গোটা আলোচনাপর্ব সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সরকারের তরফে সরাসরি প্রত্যাখ্যান জুনিয়র ডাক্তারদের বাধ্য করল নবান্নের দরজা থেকে ফিরে আসতে।
৯ সেপ্টেমবর সন্ধে নাগাদ স্বাস্থ্যদপ্তরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির তরফে একটি মেল আসে জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে। নীচে মেলটি দিলাম।
মেলের ভাষা লক্ষ্যণীয় – একটি ছোট ডেলিগেশন (সর্বাধিক ১০ জন) “may visit” এবং “may be sent”। ইংরেজিতে এর অর্থ দাঁড়ায় আপনি চাইলে আসতে পারেন – কোন অনুরোধ করা হয়নি, এমনকি may শব্দটির পরে please শব্দটিও যোগ করা নেই। চাইলে উত্তর দিতে পারেন, নাও পারেন। এরকম একটি মেল ১ মাস ধরে রোদে-জলে ভিজে দিনরাত এক করে অবস্থানরত কোনরকম রাজনৈতিক দলের সংস্রববর্জিত আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের কাছে কি খুব সম্মানের ছিল? এবং মেলে উল্লেখও করা ছিলনা যে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
এরপরে গতকাল (১২.০৪.২০২৪) বিকেলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারির তরফে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আলোচনায় থাকবেন জানিয়ে আরেকটি মেল আসে। জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে এর উত্তর দেওয়া হয়।
মেলে জানানো কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জুনিয়র ডাক্তারেরা নিজেরা বাস ভাড়া করে নবান্নে পৌছে যায় ৩০ জনের প্রতিনিধি দল নিয়ে। ২ ঘন্টা তারা ওখানেই বসে থাকে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীও ফাঁকা কনফারেন্স রুমে বসে থাকেন – শুধু নবান্নের বাইরে এবং ভেতরে। কিছুতেই live streaming-এ রাজি হলেননা তিনি। মিটিং হলনা। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে নিজের কথা বললেন। এদের ছোট বলে ক্ষমা করে দিলেন। এবং আরও কিছু কথা বললেন, যেগুলো সবাই শুনেছে। তার মধ্যে একটু ভাবলে দেখা যাবে, সামান্য অনৃতভাষণও রয়েছে হয়তো।
কেন সরাসরি সম্প্রচার নিয়ে এত আপত্তি? এমনটা কি হতে পারে যে, জুনিয়র ডাক্তাররা যে ৫ দফা দাবী একেবারে প্রথম থেকে জনসমক্ষে এবং প্রশাসনের কাছে পেশ করে আসছে – যার মধ্যে পুলিশ কমিশনার ও হেলথ সেক্রেটারির পদত্যাগ থেকে ধর্ষক এবং খুনিদের শনাক্ত করে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তি দেওয়া, এবং, সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ, কলেজের অভ্যন্তরে ওদের কর্মস্থলে পূর্ণ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। কেবল কিছু সিসি টিভি বসানো কিংবা সিআরপিএফ মোতায়েন করে এ সমস্যার সমধান হবেনা।
অর্থাৎ জনসমক্ষে একটি অপ্রীতিকর বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে আসত। বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি, যেভাবে সিবিআই তদন্তের ফলে প্রাথমিকভাবে সামনে আসছে সে ডিসকোর্সটি সরকার এবং প্রশাসনের তরফে খুব সুখকর হতনা হয়তো। এরকম একটি আগাম আশঙ্কা থেকেই কি এতে দৃঢ়ভাবে অরাজি হওয়া?
এর আগে সুপ্রিম কোর্টে ৯ সেপ্টেম্বরের সওয়ালে সরকারপক্ষের আইনজীবী কপিল সিবাল ঘটনার দিনের (৯.০৮.২০২৪) ২ ঘন্টার সিসি টিভির ফুটেজ টুকরো টুকরো করে ২৭ মিনিটের ক্লিপগুলো দিয়েছিলেন। সিলিসিটর জেনারেল এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিবাল হাসিমুখে জানান “technical glitch”। অনেকটা শিব্রাম চক্রবর্তীর গল্পের মতো – কার্পেট কাচতে দিলে ভালো করে কাচায় সেটা খেপে গিয়ে মোটাসোটা রুমাল হয়ে যাবার মতো। এই “technical glitch”-এর মধ্যে অনেক ধোলাই হবার কাহিনি থাকতে পারে।
আরও কথা – আমাদের ভেবে দেখার জন্য
জুনিয়র ডাক্তারদের এ আন্দোলন এক অর্থে ইতিহাস-সৃষ্টিকারী এবং সমাজতত্বে ভাবনার উপাদান সরবরাহ করার মতো বিষয়। কেন?
আমরা প্রায় সবসময়ই রাষ্ট্রের বা শাসকদলের তৈরি করা অ্যাজেন্ডার প্রতিক্রিয়া জানাই। সে অর্থে আমাদের তথা জনসমাজেরর প্রতিক্রিয়া চরিত্রের বিচারে অনুবর্তী বা reactive। কিন্তু এ আন্দোলন এমন এক পরিস্থিতি ও সন্ধিক্ষণের জন্ম দিয়েছে যা শাসকদলকে (এবং কিছু পরিমাণে রাষ্ট্রকেও) দিশেহারা করে দিয়েছে। হয়তো বা প্রথমবারের জন্য প্রায় এক মাস ধরে একটি আন্দোলন চলছে যা স্ব-উদ্যোগী অগ্রবর্তী আন্দোলন, যাকে আমরা বলি proactive movement।
এ আন্দোলনের ফলে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে শাসকদল এবং সরকারকে এর প্রতিক্রিয়ায় নিত্যনতুন কৌশল ভাবতে হচ্ছে। জুনিয়র ডাক্তারদের proactive movement সরকারকে reactive position-এ ঠেলে দিয়েছে। এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এরা বিভিন্ন স্তরে গণ অংশগ্রহণের flood gate খুলে দিল।
শুধু এটুকুই নয়, এ আন্দোলনের অভিঘাতে নারীরা সামাজিক সুরক্ষা এবং ব্যক্তি নারীর স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। সমস্ত নাগরিক সমাজ – সবরকমের দলীয় প্রভাবকে দূরে সরিয়ে রেখে – একটি নতুন পরিসর তৈরি করেছে। এরকম তৃতীয় পরিসর বা নাগরিক পরিসর স্মরণীয় কালের মধ্যে উন্মোচিত হয়নি।
আমার মনে হয়, এ কথা আজ জোর দিয়ে বলার প্রয়োজন আছে যে, apart from everything, junior doctors are fighting against ‘legalized lawlessness’ of the state and government.
কুর্ণিশ, আন্দোলনকারী সন্তানসম জুনিয়র ডাক্তারদের এবং এদের সহযোগী সমস্ত ডাক্তারসমাজকে! এরা মেডিক্যাল সাম্রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির চেহারা বেআব্রু করে দিচ্ছে – প্রতি মুহূর্তে। সিবিআই সেগুলো খুঁজে বের করছে।
আপনারা খেয়াল করে দেখুন, এদের দাবী যৌক্তিক এবং নির্দিষ্ট। এখানে আরেকটি কথা বলার, আন্দোলন গণচেহারা নিলে সমস্তকিছু ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। এজন্য ঋতুপর্ণার সাথে অসঙ্গত আচরণ হয়। অনভিপ্রেত!
অনুগ্রহ করে, কোনরকম ব্যক্তি আক্রমণ – তিনি মুখ্যমন্ত্রী হ’ন বা সুপ্রিম কোর্ট – করা থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে হবে। আন্দোলনের ওজন যেন কোনভাবেই না কমে যায়। যুক্তি-বুদ্ধিকে যেন আবেগ ছাপিয়ে না যায়।
In a lightning speed you analysed the entire incident. Thanks for the insight
অসংবেদনশীল সরকার। এদের কাছ থেকে মানবিক কোন কাজ আশা করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশাসনিক স্তরে এ অচলাবস্থা মেটাবার খুব একটা প্রয়াস ও চোখে পড়ে না। ঋজু মেরুদন্ডের ছেলে মেয়ে গুলোর মনবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এ শীতলতা তাই যথেষ্ট। একমাত্র আশার কথা সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষ ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
ঠিকই বলেছেন দাদা. কিন্তু আমার মনে হয়, এই ধরণের আন্দোলন করতে যে political maturity (student polics এর কথাই বলছি) ও moral courage লাগে, এদের সেটা নেই. Political maturity কেন বললাম- এরা লেনিন এর Two step back, One step forward বোঝে কিনা জানিনা. কারণ, শুধুমাত্র livestreaming এর দাবিতে আলোচনা বানচাল করে নিজেরা Blackfoot এ চলে গেছে.
Moral courage – অবস্থানের খরচের টাকা কয়েক lakh প্রতিদিন. এই খরচ কে বা কারা দিচ্ছে? পাবলিক এর টাকায় এটা হয়না.
Junior Dr der moner obostha amader sokoler moner obostha eki Govt er uchit shighroi somadhan kora .Service place e nirapotta chai e chai ter sathe we want justice for Avoya 👍
We demand justice for RG KAR
লেখাটি ঠিকঠাক, অর্থাৎ পলিটিকালি কারেক্ট। তবে লড়াকু ডাক্তাররা ধূর্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না তাঁদের অনভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণে। অর্থাৎ তাঁদের প্রতিপক্ষের কৌশলকে পড়ে ফেলার কায়দাগুলো রপ্ত করে ফেলতে হবে দ্রুত। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নমনীয় কৌশল নিতে হবে। যেমন live streaming এর দাবিতে (সেটা আইনসঙ্গত হলেও) অনড় না থেকে বসে যেতে হত এবং প্রতিপক্ষকে তার অ্যাজেন্ডায় টেনে আনতে হত। বড় দল নিয়ে আলোচনায় বসলে অসুবিধা এটাই যে তাতে ঐক্যমতের অভাব হওয়াটা অসম্ভব নয়। ছোট শক্তিশালী দল বেশি কার্যকর। মধ্যবিত্তের আন্দোলন তাই আবেগের প্রাধান্য বেশি। সেই দুর্বলতা বিষয়ে সাবধান হতে হবে। যারা কলা মূলো নিয়ে সাহায্য করতে আসছে বা রাত জেগে স্লোগান দিচ্ছে তাদের কোনো ঝুঁকি নেই এটা খেয়াল রাখতে হবে। গ্রামাঞ্চলে কোনো প্রভাব দেখতে পাচ্ছি না! আন্দোলন ভাঙার
জন্য মুখ্যমন্ত্রীর চালকে নস্যাৎ করার জন্য স্ট্র্যাটেজিক রিট্রিটের রাস্তা তৈরি রাখতে হবে।
আজ অবধি এরকম নিকৃষ্ট এবং জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
অভয়ার সহকর্মীদের এ আন্দোলন একশত শতাংশ সমর্থনযোগ্য। সর্ষের মধ্যেই ভূত।
এই আন্দোলনকে সর্বস্তরের জনসাধারণ ন্যায্য বলে রায় দিয়েছেন।
আন্দোলন চালিয়ে যেতেই হবে যতক্ষণ না সত্যের প্রকাশ হয়।
সত্যমেব জয়তে। সত্য কখনো মিথ্যার স্তূপে চাপা থাকে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা দুদিন আগে বা পরে
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা।
জুনিয়র ডাক্তাররা প্রত্যাখ্যাত হলেও সরকার এবং প্রশাসনকে একটা জোর ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে যাতে সরকারের দুর্নীতিগুলো আজ জনসমক্ষে এসেছে এবং সরকারপক্ষ বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
W
এই অভূতপূর্ব আন্দোলন সফলতা পাক। নির্যাতিতা বিচার পাক।
চূড়ান্ত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ তা না হলে আন্দোলন রত জুনিয়র চিকিৎসকদের সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে সরকারের এই আচরন হতো না। আসলে শাসক চায় প্রশ্নহীন সমাজ যার মেরুদণ্ডটি বন্ধক থাকবে শাসকের কাছে। আর সেই জায়গা তেই আঘাত এনেছে ছাত্ররা। আপনার লেখায় তা বিশ্লেষিত হয়েছে খুব সুন্দর ভাবে যা আমার মতো পাঠকের ক্ষেত্রে খুব উপকারি।
ডাক্তার জয়ন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের এই লেখাটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত । বিশেষ করে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৃতীয় পরিসর অর্থাৎ নাগরিক সমাজের সচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুদয়ের দিক নির্দেশ করেছেন অত্যন্ত দূরদর্শীতার সঙ্গেই।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।