ঘন্টা ছয় হল আমি মারা গেছি। এমনিতে রোগব্যাধি বলতে বিশেষ কিছু ছিল না, কিন্তু সিগারেটটা একটু বেশিই খাওয়া হয়ে যেত। গত একবছরে চারবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে আই.সি.ইউ. তে ভর্তি হয়েছিলাম। এইবার আর উতরে যাওয়া হল না। তবে শেষ দুইদিন ভেন্টিলেটরে প্রাণভরে শ্বাস নিয়েছি।
হাসপাতালের যাবতীয় ফর্মালিটি মিটে যাওয়ার পর বাড়ীতে ঘন্টা দেড়েকের জন্য ঢুকেছিলাম। শ্বেতবস্ত্র-তুলসীপাতা-ফুল-চন্দন-ধূপধূনো দিয়ে নিতান্তই অনাড়ম্বরের মধ্যে আমার দেহটি তোলা হল পৌরসভার শববাহী গাড়ীতে। সামনে দুইজন আর পেছনে জনাচারেক বন্ধু-পরিজন শ্মশানযাত্রায় সঙ্গী হলেন আমার। হরিনামের সাথে খই ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে চলল আমার গাড়ী। পেছনে ফেলে রেখে এলাম বাড়ী-লাগোয়া আমার সাধের চেম্বারটি। আর কোনদিন সেখানে রোগী আসবে না। কারণ, আমার পরের প্রজন্ম মেডিক্যাল এন্ট্রান্স দেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারে নি।
মহাশ্মশানে পৌঁছেই চক্ষু চড়কগাছ! বেঁচে থাকতে ব্যাংকে পুরনো টাকা জমা দেওয়ার লাইন, এ.টি.এম. এ নতুন টাকা তোলার লাইন, আধার কার্ডের লাইন, এল.পি.জি. ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে কে.ওয়াই.সি. ফর্ম জমা দেওয়ার লাইন….. লাইনে লাইনেই জেরবার হয়েছি। এখন শ্মশানেও দেখছি পোড়ার জন্য লাইন। শালা মরেও শান্তি নেই!
হঠাৎ সমস্বরে ‘বল-হরি হরি-বোল’, ‘বিদায় অগ্নিপুরুষ’, ‘মন্ত্রীজী অমর রহেঁ’ ইত্যাদি নানা স্লোগান কানে এলো। একটা রাজকীয় ‘স্বর্গরথ’ এসে থামল আমার ধ্যাড়ধেড়ে গাড়ীর ঠিক পাশেই। পেছনে গোটা দশেক লালবাতি গাড়ী, দলীয় পতাকা লাগানো কয়েকশো বাইক, মিডিয়াভ্যান, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী। পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে জনগণের ভিড় সামলাতে। এ আবার কে ঢুকলো রে বাবা! ইচ্ছে হল মাথাটা তুলে একবার দেখি। কিন্তু মনে পড়ে গেল আমি তো মরে গেছি! পাছে শ্মশানবন্ধুরা ভূত ভেবে ভয় পায় তাই আর মাথা নড়ানোর চেষ্টা করলাম না। কাঁচের ভেতর থেকে শুধু আড়চোখে একবার দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পুষ্পস্তবকের পাহাড়ে মুখখানি ভালো করে দেখা গেল না। শুধু একটা প্ল্যাকার্ড চোখে পড়ল….. তাতে লেখা আছে “জনদরদী মন্ত্রী স্বর্গীয় ডাঃ অতনু সেনের আত্মার শান্তি কামনা করি।”
আরে! এ তো আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অতনুদা! শেষে কিনা একই দিনে, একই শ্মশানে! খবরে শুনেছিলাম অতনুদার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু কখনও দেখা করা বা ফোন করা হয়ে ওঠে নি। সে অবকাশও অবশ্য ছিল না। অতনুদা আর আমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ আজ প্রায় বিশ বছর। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অতনু দা আমাদের মতো অতি সাধারণ ডাক্তারদের একদমই পাত্তা দিত না।
পঞ্চাশ বছর আগে অবশ্য সম্পর্কটা এমন ছিল না। অতনুদা ছিল আমার কলেজের ছাত্র, দুবছরের সিনিয়র। আশির দশকের শেষদিকের দিনগুলো আজও ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। ছাত্ররাজনীতিতে চৌখস ছিল অতনুদা।
ছাত্রসংসদ নির্বাচনের আগে অতনুদা যখন লেকচার থিয়েটারের ডায়াসে উঠে বক্তৃতা দিত, বেশ লাগত! তারপর কলেজ জীবন শেষ করে আমি বেছে নিলাম আর পাঁচজন ডাক্তারের মতো গতানুগতিক রোগী-চেম্বার-প্র্যাকটিসের জীবন। আর, অতনুদার রাজনৈতিক পরিচয়টাই ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রথম প্রথম টুকটাক রোগী দেখলেও পরে একদমই বন্ধ করে দিয়েছিল।
সাল ২০১৮, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর আইন হয়েছিল রাজ্যে। একবছরে একশোর বেশী ডাক্তার জনআক্রোশের শিকার! অতনুদা তখন সর্বভারতীয় চিকিৎসকগোষ্ঠীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছে। আমি ভেবেছিলাম ডাক্তারদের এই বিপদ থেকে কেউ যদি রক্ষা করতে পারে, সে একমাত্র অতনুদাই। আমি পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম ওর কাছে। বলেছিলাম, “অতনুদা, প্লিজ কিছু করো। তোমার প্রথম পরিচয় তুমি ডাক্তার। আজ তুমি যদি হাত গুটিয়ে বসে থাক তাহলে আর কে দেখবে আমাদের?” অতনুদা সেদিন সত্যিই হাত গুটিয়ে বসে বসে আঙুল ফাটাচ্ছিল। আসলে, অতনুদার স্বপ্ন ছিল অনেক উপরে ওঠার।
মিথ্যে হয়নি অতনুদার সেই স্বপ্ন। আজ সে রাজ্যের ভূতপূর্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ওকে শেষবারের জন্য শ্রদ্ধা জানাতে অনুগামীদের রাজকীয় আয়োজন। এরকমই জীবন চেয়েছিল অতনুদা। আমি ভাবলাম আর কী হবে মনের বৈরিতা রেখে। অতনুদার সঙ্গে কথা বলার এটাই শেষ সুযোগ; কেউ জানে না পরলোকে কার কোথায় ঠাঁই হবে। সেই ভেন্টিলেটরে শেষ শ্বাস নিয়েছিলাম, তারপর অনেকক্ষণ কেটে গেছে। গলার কাছে জমে থাকা কফটা ঝেড়ে নিয়ে অতনুদাকে ডাকতে গিয়ে মনে হল শ্মশানবন্ধুরা শুনে ফেললেই কেলেঙ্কারি! তাছাড়া কাঁচের ভেতরে থাকা অতনুদার কানে স্বাভাবিক কণ্ঠ কি পৌঁছোবে? তাই গলার স্বর পাল্টে ফেললাম। আলট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সিযুক্ত ভূতুড়ে কণ্ঠে আমি ডাকলাম, “অতনুদা শুনতে পাচ্ছো? আমি কুশল। কুশল ঢাকী।”
কাঁচের বাক্সের ভেতর থেকে, “বল ঢাকী, কেমন আছিস?”
আমি দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে বললাম, “আর কেমন থাকা, ভূতেরা যেমন থাকে।”
“তোকে পই পই করে বলেছিলাম, আমার দলে আয়। লাইফ বানিয়ে দিতাম। তুই শুনলি না, গাঁট হয়ে থাকলি। ডাক্তারদের নিয়ে আন্দোলন করলি। আল্টিমেটলি কী পেলি?”
“সত্যি করে বলো তো, বেঁচে থাকতে তুমি যা যা পেয়েছিলে তা নিয়ে এখনও কি তোমার গর্ব হচ্ছে?”
“কেন হবে না? আমি মরে গিয়েও জাগতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হই নি রে! দ্যাখ ঢাকী, আমি তোর দু’ঘন্টা পর শ্মশানে এসেও তোর আগে স্বর্গে পৌঁছাবো। আজীবন পলিটিক্স করেছি বলেই এই প্রিভিলেজটা অল টাইম আমি ডিজার্ভ করি। তুই লাইনে দাঁড়িয়ে পচতে থাক।”
কথা শেষ হতে না হতেই অতনুদার রাজকীয় স্বর্গরথ আমার গাড়ীকে পাশ কাটিয়ে গড়গড় করে এগিয়ে গেল ইলেকট্রিক চুল্লির দিকে।
দশ মিনিট পর…..
ডোম এগিয়ে এসে আমার শ্মশানবন্ধুদের বলে গেল, “আপনারা ঢাকীবাবুর বাড়ীর লোক? তাড়াতাড়ি রেডি হোন। ভেতরে বডি নিয়ে যেতে হবে।”
রাজাদা খানিকটা অবাক হয়েই বলল, “মন্ত্রীমশাইয়ের মাত্র দশ মিনিটেই হয়ে গেল! অন্যদের তো একঘন্টা করে লাগছিল।”
“আসলে চামড়া-মাংস পুড়তে দশ মিনিটই লাগে, সময় বেশি নেয় হাড়।” বলল ডোম।
রাজাদা বলল, “তার মানে!”
“বুঝতে পারলেন না স্যার? শিরদাঁড়াটাই ছিল না।”… এ কথা বলেই ডোম হাঁক দিলো, “জল্দি কিজিয়ে।”
*************************************************
(বিঃদ্রঃ- এই গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। স্থান, কাল, জীবিত অথবা মৃত ব্যক্তির সঙ্গে এই গল্পের কোন কিছুর সামঞ্জস্য থাকলে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।)