একজন চিকিৎসক। ক্ষুরধার তাঁর বুদ্ধি। তেমনি তাঁর নিষ্ঠা। একেবারে স্কুলজীবন থেকেই ছাত্র হিসেবে তুখোড়। পরবর্তী কালেও যখনই যে পরীক্ষায় বসেছেন, আটকানো তো দূর, প্রতিটিতেই একেবারে প্রথম দিকে থেকেছেন। পেশাজীবনে প্রবেশের পর দেখা গেল, ডাক্তার হিসেবেও খুব ভালো তিনি। যত্ন নিয়ে রোগী দেখেন, মন দিয়ে রোগীর কথা শোনেন, রোগী-পরিজনের প্রশ্ন, সে এমনকি ভুলভাল প্রশ্ন হলেও, ধৈর্য্য সহকারে সে প্রশ্নের উত্তর দেন। চিকিৎসা যে ভালো করেন, সে তো বলাই বাহুল্য।
কিন্তু তাঁরও একটা দুর্বলতা আছে। যাবতীয় রোগীর যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি নির্দিষ্ট কয়েকটি ল্যাব থেকে করিয়ে আনতে বলেন। এমন নির্দেশ অবশ্য অনেক চিকিৎসকই দিয়ে থাকেন। অনেকসময় তেমন নির্দেশের কারণ, সেই ল্যাবগুলোর রিপোর্টের উপর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ভরসা। আবার অনেকসময় কারণটা ভিন্ন। মানে, কারণটা অর্থকরী। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের গল্পের ডাক্তারবাবুর ক্ষেত্রেও কারণটা এই দ্বিতীয় গোত্রের। অর্থাৎ, তিনি বেছে বেছে এমন ল্যাবে পরীক্ষা করতে দেন, যেখানকার রিপোর্টের নির্ভরযোগ্যতা কম নয়, কিন্তু ল্যাবগুলো রীতিমতো মোটা টাকা কমিশনও দেয়। এবারে, যেহেতু এসব ল্যাব-এ পরীক্ষার খরচার মধ্যে এই কমিশন ধরা থাকে – অর্থাৎ এই কমিশনের টাকাটা জুড়েই টেস্টের চার্জ ধার্য হয় – এবং কোনও সৎ ডাক্তারবাবু কমিশন না নিলেও কাস্টমার তথা রোগীকে কোনও ছাড় দেওয়া হয় না, সেহেতু, আমাদের গল্পের ডাক্তারবাবুর এমন স্বভাবের জন্য রোগী-পরিজন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, এমন নয়।
তাহলে আমরা ঠিক কী সিদ্ধান্তে উপনীত হব? তিন-চারভাবে পরিস্থিতিটাকে দেখা যেতে পারে, বা তিন-চারটি মত উঠে আসতে পারে।
১. ডাক্তারবাবু ডাক্তারিটাই জানেন না।
না, একেবারেই তা নয়। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সাফল্য বা তাঁর কাছে দেখিয়ে রোগী-পরিজনের স্যাটিসফ্যাকশন, এতেই প্রমাণ যে তিনি অবশ্যই সুচিকিৎসক। ডাক্তারিটা তিনি আমজনতার চাইতে বেশি তো বটেই, অনেক ডাক্তারের চাইতেও ভালো জানেন। কমিশন খাওয়ার বদভ্যেস-এর নিন্দা/সমালোচনা করার অর্থ কখনোই এমন নয়, যে, বিষয়ের উপর তাঁর দখল, তাঁর জ্ঞান বা উৎকর্ষকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
২. ডাক্তারবাবু, চিকিৎসক হিসেবে যেমনই হোন না কেন, যত উঁচুমানের ডাক্তারই হোন না কেন, তাঁর সেই সাফল্য বা উৎকর্ষকে অস্বীকার না করেই বলা যায় – এই কমিশন নেওয়ার কারণে, চিকিৎসক হিসেবে তাঁর যে “ধর্ম”, অন্তত একটি ক্ষেত্রে, তিনি তা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তদুপরি, যেহেতু এমন খ্যাতিমান চিকিৎসককে অনেকেই রোলমডেল ভাবেন, তাঁর এমন আচরণ অনুজ চিকিৎসকদের উচিত-অনুচিতের বোধকে প্রভাবিত করতে পারে।
আমাদের গল্পের ডাক্তারবাবু দক্ষ চিকিৎসক অবশ্যই, উত্তরোত্তর তিনি নিশ্চয়ই আরও শীর্ষে আরোহন করবেন, তবু আমার মনে হয়, আমাদের গল্পের পরিস্থিতিতে, চিকিৎসক তাঁর “ধর্ম” থেকে খানিক বিচ্যুত হয়েছেন, এই ভাবনাটা ভুল নয়। অন্তত আমি, এই মতেরই পক্ষে।
৩. রোগীর যখন বাড়তি খরচা হচ্ছে না, বা ডাক্তারবাবু কমিশনের লোভে বেশি বেশি টেস্ট করাচ্ছেন, এমন প্রমাণ যখন নেই – তখন এ নিয়ে এত কথার কী আছে?
না, এই বক্তব্যের পক্ষে আমি নই। নীতিভাবনার ক্ষেত্রে, অন্তত কিছু জায়গায়, উত্তরটা হ্যাঁ বা না-তে দিতে পারাটা জরুরি। কমিশন খাওয়াটা যদি অনুচিত মনে করেন, তাহলে সেটা অনুচিত-ই। কে করছেন, কেমন রাস্তায় করছেন, তাতে সরাসরি কারও ক্ষতি হলো কি হলো না – কোন পরিস্থিতিতে তা তেমন অনুচিত নয় – এসব শর্ত চাপিয়ে চলাটা আদতে অনুচিত-কে জাস্টিফাই করা হয়ে দাঁড়ায়।
৪. আপনি সমালোচনা করার কে! আগে (ওই লেভেলের) ডাক্তার হয়ে দেখান।
নাহ্, এই পয়েন্টটা নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।
তো, কথাটা হয়ত ভুল সময়ে বলা হয়ে গেল, তবু বলি – চন্দ্রযান-৩-এর সফল অবতরণে সত্যিই গর্ব হচ্ছে, ভারতীয় হিসেবে তো বটেই, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবেও – কিন্তু চন্দ্রাভিযানের আগে সমবেত পুজো-আচ্চা-যজ্ঞ ব্যাপারটা আমার খারাপ লেগেছিল। আজকের এই সাফল্য দেখে আমার খুশি হওয়াটা যেমন সত্যি – ঠিক তেমনই, সেদিনের খারাপ লাগাটা অনুচিত ছিল, এমন মনে করি না। এবং আজকের ভালো লাগা ও সেদিনের খারাপ লাগা-র মধ্যে কোনও কনফ্লিক্ট নেই।