আজকে যে মানুষটাকে নিয়ে এই পর্ব লিখবো তাঁকে অনায়াসেই আমার ‘আমি’ তৈরি হওয়ার কারিগর বলা যায়। আমার ছেলেবেলায় সেইসময়ের আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি ছাত্রের মতো ভালো স্কুলের অ্যাডমিশন টেস্টে বসেছিলাম। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হবো। পরীক্ষার সময় বাবা নিয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ হবার পর আমরা ঘুরে ঘুরে স্কুল ক্যাম্পাস দেখছিলাম। হোস্টেলে কিভাবে সিনিয়র দাদারা থাকে। তারা সারাদিন কি কি করে। কতদিন পরপর গার্জেনরা দেখতে আসেন- ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। সাধে কি আর প্রতি বছর এই স্কুল থেকে মাধ্যমিকে প্রথম কুড়িতে অন্তত চার-পাঁচ জন থাকে?
বাড়ি ফিরে মাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সারাদিনের গল্প বললাম। কয়েকদিন বাদে রেজাল্ট জানা যাবে। পাড়াতুতো এক কাকা কর্মসূত্রে সেই স্কুলের কাছাকাছি প্রতিদিন যান। তিনিই রেজাল্ট জেনে এনেছিলেন। রেজাল্ট শুনে মা আর আমার মুখভার। সারাদিন পরস্পরকে জড়িয়ে কান্নাকাটি। নাহ্, এ রেজাল্ট বাবাকে জানানো যাবে না।
বাবা অফিস থেকে ফিরতো দেরি করে। সপ্তাহে অন্তত দুতিন দিন অফিস থেকে সোজাসুজি একজনের বাড়িতে পড়াতে চলে যেতো। সেখান থেকে বাড়ি আসতে আসতে রাত দশটা। অধিকাংশ দিন আমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। সেদিন আর ঘুম আসেনি। বাবা মিষ্টি কিনে আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়ি ঢুকলো। বুঝতে পারলাম যে বাবাও জেনে গেছে। আমি কেঁদে পড়লাম – আমি কিছুতেই হোস্টেলে থাকবো না। বাবা-মায়ের প্রচন্ড তর্কাতর্কি। এতো ভালো স্কুলে চান্স পেয়ে না যাবার কোনো কারণ নেই। মায়ের আদরে আমি দিনকে দিন লাঙ্গুল বিশিষ্ট বৃক্ষবাসী হচ্ছি। আমার মধ্যে মনুষ্যেতর প্রাণীর বৈশিষ্ট নিয়ে সেই সুগভীর আলোচনা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধে চিরকাল স্ত্রীরা জয়ী হয়। পরদিন সকালে উঠে বুঝতে পারলাম যে মা জিতেছে। আমাদের বাড়ি থেকে দু-তিনটে স্টেশন পরে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম। সেখানে হোস্টেলেও থাকা যায় আবার বাড়ি থেকে যাতায়াত করলেও অসুবিধা নেই। একটা বড়ো জায়গা জুড়ে অনেকগুলো স্কুল। পাঠশালা, জুনিয়র বেসিক, সিনিয়র বেসিক, হাইস্কুল। অনেকগুলো খেলার মাঠ। একপাশে হোস্টেল, মন্দির, লাইব্রেরি এমনকি একটা ছাপাখানা শুদ্ধ রয়েছে। বড়ো মহারাজের কাছে বাবা-মা আমাকে নিয়ে গেল। সৌম্যদর্শন সুপুরুষ এক মানুষ। তিনি বললেন যে সুযোগ থাকলে বাড়ি থেকে যাতায়াত করেও ভালো মানুষ তৈরি হওয়া যায়। খুব ভালো লেগে গেল মানুষটাকে।
বড়ো মহারাজকে ঘিরে ঘটা অদ্ভুত কিছু ঘটনার কোনো সহজ ব্যাখ্যা আমি পাইনি। বিজ্ঞানের ছাত্র বলে নিজের মতো করে ব্যাপারগুলোকে সাজিয়ে নিয়েছি।
মহারাজ আমাদের ‘মনের ব্যায়াম’ বলে একটা ক্লাস নিতেন। শরীরের সাথে মনকে ঠিকঠাক ভাবে তৈরি করার পদ্ধতি। প্রার্থনা ঘরে শতরঞ্জি বিছিয়ে ক্লাস নেওয়া হতো। বড়ো মহারাজ বসে থাকতেন একটা উঁচু চৌকিতে। ক্লাসের শেষে ধ্যান করতে হতো। কোনো একটা বিন্দুতে মনঃসংযোগ করা। মহারাজ নিজেও পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ হতেন। আমাদের মধ্যে বিচ্ছু-বদমাশ ছেলেপুলেদের অভাব ছিল না। পুরাণের কাহিনির রাক্ষসদের মতো তারা নানাভাবে ধ্যানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতো। প্রসূন বলে ভয়ংকর গুন্ডা ঠিক আমার পেছনেই বসতো। ধ্যানস্থ হবার মিনিট খানেকের মধ্যে কোমরে একটা খোঁচা খেলাম। মনটা বিন্দু থেকে নড়ে খোঁচানো জায়গায়। সেটা সামলাতে সামলাতে পিঠে চিমটি। আমি চোখ অল্প খুলে ওকে ভস্ম করার চেষ্টা করলাম। ব্রহ্মতেজ তেমন কিছু জমেনি বলে প্রসূনের কিছু হলো না। কিন্তু সে অনুপমকে নিয়ে পড়লো। অনুপমের প্রতিবাদী চরিত্র। ক্লাসের সবচেয়ে ছোটখাটো ছেলে হলেও ছোড়নেবালা নেহি। খপ করে প্রসূনের হাত খামচে ধরে। মিহি একটা আর্তচিৎকার। মহারাজ চোখ খুললেন। মৃদু হেসে উঠে গেলেন। ঠিক তার এক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের ভয়ংকর রাগী হেডস্যার ঢুকলেন। তখন সিসিটিভির ব্যবস্থা ছিলনা। ওই অল্পসময়ের মধ্যে কেউ গিয়ে নালিশও করতে পারেনা। তাহলে এককোণে বসা আমাদের তিনজনকে উনি ধরলেন কি করে? হেডস্যারের ঘরে আমরা তিনজন সংবর্ধিত হতে হতে এই ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করছিলাম। নিশ্চয়ই হেডস্যার দামী একটা চশমা নিয়েছেন। দূর থেকে যেতে যেতে আমাদের দুষ্টুমি দেখে ফেলেছেন।
নাকি বড়ো মহারাজ চেয়েছিলেন যে এদের ভুল এরা শুধরে নিক? অদ্ভুত ব্যাপার, পরবর্তী সময়ে আমরা তিনজনই চিকিৎসক হয়েছি।
একবার ক্লাসে রেজাল্ট একটু খারাপ হলো। আমার বাবা-মা মহারাজকে জানায়। মহারাজ বললেন যে তাঁর কাছে আমাকে যেন দুতিন দিন রাখা হয়। মহারাজের অন্য রূপ দেখলাম। সেই কদিন আমার সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মতো মিশলেন। এমন কিছু কথা আলোচনা করলেন যা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া করা যায় না। বাড়ি ফেরার দিন তিনি জানালেন আত্মার সাথে পরমাত্মার সম্পর্ক, নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ক এবং সব শেষে বাবার সাথে মায়ের সম্পর্ক। খুব হালকা হয়ে গেল বুকের ভেতর জমতে থাকা পাথরটা। সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার তৈরি মায়া। পড়ায় মন ফিরলো।
তারপরের গল্প ডাক্তারি পড়ার সময়। থার্ড ইয়ার। পিঠের দিকে ছোটছোট পাখনা গজানো দিব্যি টের পাচ্ছি। মেন হোস্টেলের দারোয়ান এসে বললো “তোমার গেস্ট এসেছে।” আমাদের দু’চার জন বন্ধুর কপালে ফার্স্ট ইয়ারের পরী পরী গেস্ট এর আগে জুটেছে। আমি ঝট করে মুখে একটু সাবান ঘষে গেস্টরুমে হাজির। ও বাবা, পাঁচবছরের ওপার থেকে এসে বড়ো মহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার সঙ্গে বাগবাজার ফেরিঘাট পর্যন্ত গেলাম। গিরিশ ঘোষ, নিবেদিতা, বিবেকানন্দর গল্প করতে করতে গেলেন। মনটা অন্যরকম হয়ে গেল।
শেষবার দেখা হলো নর্থবেঙ্গলে। চাকরি সূত্রে জলঢাকা। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। বললেন “তোমার মধ্যে থেমে যাওয়ার লক্ষণ কেন? চরৈবতি চরৈবতি। আরও পড়তে হবে, আরও পড়তে হবে।”
বিহ্বল হয়ে বললাম যে আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন মহারাজ।
বেশ শীত। রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে ভোর আসছে। তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন।
আমার কানে আজও তাঁর জলদগম্ভীর স্বরে উচ্চারিত আশীর্বাদ বাজে -” অসতো মা সদগময়/ তমসো মা জ্যোতির্গময়/ মৃত্যর্মামৃত গময়।”
আমি সেই ভাগ্যবান যে ছাপার আগে এই কথা গুলো শুনেছি। খুব সুন্দর লাগলো।