রবিবার সকালে যথারীতি মাস্ক চাপিয়ে বাজার থেকে ফিরছি। পিতৃবন্ধু বসে রয়েছেন সমবয়সীদের সাথে চায়ের দোকানে। কারুর গলাতে মাস্ক ঝোলানোর ভড়ংটাও নেই। জোর আড্ডা চলছে।
কাকু বৈঠকী সুরে হাঁক দিলেন – “কি ডাক্তার? তোমার হাসপাতালের কি খবর? করোনা টরোনা ভর্তি হচ্ছে?”
আমি সবিনয়ে জানালাম- “আমার হাসপাতাল তো মার্চ মাস থেকেই করোনা হাসপাতাল- সবাই তো করোনা রুগী।”
-“তুমি করোনা রুগী দেখছ!” শরীর চাবুক খেয়ে সোজা, খোসগল্পের উৎসাহ মূহুর্তে শেষ। আশেপাশের দু-চারজন ছিটকে গেলেন যেন ফণা তোলা গোখরো দেখছেন। যেন আমার গা থেকে কালকূট বিষের মত করোনা উড়ে বেড়াচ্ছে। চোখে নীরব হুমকি – মানে মানে কেটে পর এখান থেকে।
মুচকি হেসে চলে এলাম। আজ খুব সহজে ছাড়া পাওয়া গেল। রাস্তায় চারফুটের বেঞ্চে চারজন সত্তরোর্ধ্ব মানুষ মাস্ক বিহীন বসে চায়ের আড্ডা দিচ্ছেন। না, আজ আর ওঁদের জন্য এতটুকু চিন্তা করতে ইচ্ছা হল না। এক মাস আগে হলেও হয়ত সতর্ক করতাম।
উনিশে এপ্রিল এক লেখায় করোনা সংক্রামিত একটি পরিবারের দুর্যোগ ও দুর্ভোগের কথা লিখেছিলাম। কিভাবে একটি অভিজাত পরিবারের ৬থেকে ৬৯ বছরের ১৩ জন সদস্য ও গাড়ির চালককে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে প্রায় এক বস্ত্রে, অভুক্ত অবস্থায়, রাত নটার সময়ে তুলে এনে হাজির করা হয়েছিল সরকারী হাসপাতালে – primary contact হিসেবে isolation ও করোনা পরীক্ষার জন্য।
প্রায় ৫০০ মানুষ লেখাটি পড়েছিলেন, ততোধিক share হয়েছিল। অনেকে ভয় পেয়েছিলেন। সেই ভয় যদি তাঁদের মধ্যে সতর্কতা জাগিয়ে থাকে, করোনা সংক্রমণের পরে সম্ভাব্য রূঢ় বাস্তবের সাথে পরিচয় করিয়ে থাকে – আমার সে অকিঞ্চিৎকর লেখা সার্থক হয়েছিল।
তারপরের দু মাসে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। লকডাউনের নম্বরী হাঁক, পুষ্পবৃষ্টি-দিওয়ালি, তারকাচিহ্ণিত লাল-লাল-কমলা-সবুজ এলাকা, লাল ১-২-৩ এলাকা, containment zone, ব্যারিকেড – সব পেরিয়ে আজ আমরা আনলকের মুক্তাঙ্গনে মুক্ত বিহঙ্গ। ১৯শে এপ্রিল রাজ্যে করোনা আক্রান্ত ছিলেন ৩০১ জন, কাল ২৯শে জুন ১৭৯০৭।
নতজানু হয়ে স্বীকার করছি, ভুল হয়েছিল আমারই। যদি আমার সে লেখায় আপনারা ভয় পেয়েও থাকেন, আর ভয় করবেন না। একদম না। ভয়ের আসলে কোনো কারণই নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেই দিয়েছেন, এরকম ভয় দেখানো একধরনের doomsday prophecy। তাঁরা নিদান দিয়ে দিয়েছেন – করোনা আসলে ‘পাতি ঠাণ্ডা লাগা জ্বর’।
দেশে কাল অবধি সরকারীভাবে করোনায় মৃত প্রায় ১৭,০০০ মানুষের প্লাস্টিক ব্যাগে মোড়া, পশুর মত সৎকার হয়ে যাওয়া মৃতদেহরা নিশ্চয় তাঁদের সমর্থন করবেন।
গত বুধবার ২৪ শে জুন আমার শ্বাশুড়ি ঠাকরুণের উপরের ফ্ল্যাটে এক প্রৌঢ়ার করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে অসুস্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে। সেই ভদ্রমহিলা এমনিতেই ঘরবন্দী মানুষ। ওঁর স্বামী বাজারহাটে বেরোন, একমাত্র ছেলের সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি কাটে শুঁড়িখানায় – ভদ্রমহিলার করোনার সূত্র সম্ভবত তাঁরাই।
দুমাস আগে হলে কি হত তা জানি। কিন্তু এখন, এই শেষ জুনে, গত ছ’দিনে কেউ তাঁদের quarantine বা isolation এর জন্য জোরাজুরি করেননি, কেউ তাঁদের করোনা পরীক্ষা করতেও নিয়ে যায়নি। ওঁদের গতিবিধির স্বাধীনতা কেউ রোধ করেনি। একবার পুরসভা এসে ব্লিচিং জল ছিটিয়ে গেছেন অবশ্য। ওঁরা বেরোচ্ছেন, বেড়াচ্ছেন, নিয়ম করে শুঁড়িখানাতেও যাচ্ছেন ও ফিরছেন।
সূতরাং, আর ভয় করবেন না। করোনা ধরা পড়লেই সরকার আপনাকে আর আগের মত বিরক্ত করবেন না। তাঁদের ধৈর্য ও সামর্থ্যের একটা সীমা আছে। সীমান্তে উৎপাত আছে। অর্থনীতির দাবি আছে। নির্বাচনের জন্য অগ্রিম ঘুঁটি সাজানো আছে।
সবচেয়ে বড় কথা – সংখ্যাতত্ত্ব আছে। আমেরিকার মত উন্নততম দেশে যদি দিনে সাতচল্লিশ হাজার সংক্রমণ হতে পারে, তিনগুণ জনসংখ্যার ভারতে দিনে দেড়লাখ সংক্রমণ তো স্রেফ অঙ্কের হিসাবে সিদ্ধ। তারপরে আছে গরিবী, অশিক্ষা আর ঘনবসতির চিরন্তন দায়িত্বহীন অজুহাত। আর ওই একই তিনগুণের তত্ত্বে আশি লাখ থেকে এক কোটি সংক্রমণ ও আমাদের কাছে জলভাত হয়ে যাবার কথা। তার তিন শতাংশের মৃত্যু হলে – এইরে, সেই আবার ভয়ের কথা বলা।
তার থেকে বরং এই ভেবে নিশ্চিত হোন যে ওটা দুষ্টু লোকদের বা আগের জন্মে পাপ করা লোকের হয় – আমার হবে না। আর ‘অন্য কারুর দোষে’ হয়েই গেলে ? সরকার ইতিমধ্যেই সহজতম পথটিতে পদক্ষেপ করেছেন – ডাক্তারদের দোষ খুঁজে বার করা।
দিনের শেষে রাষ্ট্রের কাছে, টিভি এ্যাঙ্করের কাছে, সংখ্যাতত্ত্ব দেখানো বিশেষজ্ঞের কাছে আমরা সবাই একটি সংখ্যা। বেঁচে থাকলে EVM-এ, না থাকলে Mortuary Bag-এ।
অসাধারন লেখা।
বা! নির্মেদ নিরাবেগ চাবুক।
পার্থ তোমার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম ভাই