রাত নটা নাগাদ নিয়ম মাফিক সব পেশেন্টের মেডিসিন তৈরি করে রাখছি, স্যালাইনের বোতল রেডি করছি, যে যে পেশেন্টের চ্যানেল খারাপ হয়েছে সেগুলো দেখছি, রাতে কোন পেশেন্ট কি রকম অনুপাতে ফ্লুইড পাবে এসব দেখছি;সহকর্মী সিস্টারকে রাতের রিপোর্ট লিখতে বলছি, এমন সময় গ্রুপ ডি স্টাফ বললেন “দিদি, নীচে একটা ব্রড ডেড এসেছে, বাপরে সেকি বীভৎস দিদি”
সঙ্গে সঙ্গে দেখি একজন পেশেন্ট পায়খানা, বমি নিয়ে ভর্তি হল, জলের মতো পায়খানা অনর্গল করেই চলছে, এমনকি এটাও ঠিক যে ওষুধ, preprobiotic sachet নিয়ে কমতে সময় লাগবেই খানিক; বাচ্চার মাকে বললাম।
আসলে কাছে যে আইডি হাসপাতাল ছিল তা এখনো করোনা হাসপাতাল হিসেবেই ধার্য আছে তাই আমি যে ওয়ার্ডে আছি তার উপর চাপ বেশ ভালই প়ড়েছে……
ফিমেল মেডিসিন, ফিমেল সার্জারি, বাচ্চার ওয়ার্ড সব মিলিয়ে দুজন সিস্টার রাতে আর গ্রুপ ডি স্টাফ, আয়া মাসি এনারা আছেন। জুনিয়র ডাক্তারবাবু, স্টুডেন্টস নেই, সুতরাং আমার ওয়ার্ড বেশ ভাল মতোই ব্যস্ত যায়।
ইতিমধ্যে আরো কটা পায়খানা, বমির পেশেন্ট ঢুকল। ORS দেওয়া, চ্যানেল করে ফ্লুইড, মেডিসিন, ইনজেকশন সব সারছি আর সহকর্মী সিস্টার সব রেকর্ড রেজিস্টার এসব লিখছেন, হঠাৎ নজর গেটের দিকে……
দুজন পুলিশ অফিসার মিশ মিশে কালো, পুরনো পোড়া, চামড়া উঠে যাওয়া একজন মেয়েকে ট্রলিতে নিয়ে আসছেন, বেড দেওয়া হল।
মনে মনে ভাবছি এই ব্রড ডেডকে তুলল কেন ?
যাকগে দেখলাম নিচে ফ্লুইড চালিয়েছেন একজন সিস্টার; পেশেন্ট চোখ মিট মিট করছে। সারা শরীর কাদা মাখা, হাতের আঙ্গুল কঙ্কালের মতো পুরো সাদা চামড়া বেরিয়ে আছে…
প্রথম তাকালো সম্পূর্ণ রূপে আমার দিকে, নিয়ম মাফিক হিস্ট্রি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে খুব অসহায় বোধ করলাম….
আগে পুরো শরীরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ভাবনা আর তার পর কপাল খারাপ হলে কে দেখবে? নাভি, যোনি না পুড়লে যে মরণ হয় না, তাই বেচারা বেঁচে গেছে, কিন্তু এইবার পুরো মাটির মধ্যে কাদা মাটির মধ্যে নদীর ধারে পড়েছিলো….
কি কপাল মাইরি এবারেও বেঁচে গেল? মনে মনে ভাবলাম ধর্ষিত হয়নি তাই বা কে জানে, বেওয়ারিশ লাশ যে এত হিস্ট্রি দেবে আমাকে তা আমার কল্পনাতীত…
তিন বোতল ফ্লুইড জেটে দিয়ে ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে মহিলার তাকানো আরও সুন্দর হল…
পেশেন্ট থিতু হলে অবশ্যই ভালো লাগে তো যাকগে, ঘড়ি দেখলাম রাত সাড়ে বারোটা।।
খেয়ে নিলাম ঝট করে, মায়ের বানানো রুটি, তরকারি, ডিম সেদ্ধ, সুজি সবকিছুই সহকর্মী সিস্টারের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম মজা করে।
আমার এই ১২ ঘণ্টা করে তিনদিনের নাইটের প্রথম দিন এত ব্যস্ত যাবে ভাবিনি তো, যাকগে সব কাজ সামলে বসেছি একটু; এক বাচ্চার মা “দিদি স্যালাইনের বোতল থেকে জলেের ফোঁটা কম পড়ছে, স্থির হয়ে আছে”…
বাচার মায়ের উদবিগ্নতা থাকবে তা স্বাভাবিক তবু খানিক রাগ হল মনে মনে বললাম “একটু বিশ্রাম না নিলে পরের রাতগুলো কি হবে” আর বকে বললাম মাকে “বাচ্চাকে ওআরএস খাওয়ান, হাত তো ধুতে হবে নাহলে এই ফিডিং বোতলের মুখ, বুকের দুধ খাওয়ার পর স্তনবৃন্ত– এসব পরিষ্কার না করলে পায়খানা, বমি জম্মে কমবে না, সে আপনি যতই ঠাকুর দেবতা ডাকুন না কেন”
খানিক পরে বুকে ব্যথার পেশেন্ট ঢুকল। সারারাত এই পায়খানা বমি, মায়ের উদ্বেগ, বাচ্চার ফ্লুইড নির্ধারণ এইসব সামলাতে গিয়ে দেখি ভোরের আলো ফুটছে।
এবার ভাবলাম ব্রাশ টা করে নিয়ে বিস্কুট মুখে দিয়েই ইনজেকশনগুলো দিয়ে নিতে হবে; খালি পেটে তো টিবি পেশেন্টের কাছে যাওয়া যাবে না।
ব্যাস, নীচ থেকে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের ফোন “দিদি, খুব খারাপ বাচ্চা আসছে- হিস্ট্রি দিয়েছে convulsion.” সব ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চা ঠিক হল,ঘড়ি দেখলাম পৌনে আট টা…
মুখে চোখে জল দিয়ে বাড়ি আসার সময় ফোনটা দেখলাম। মা কাল রাতে ফোন করেছিল হয়তো খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য; এমন কি আজ সকালেও ফোন করেছে….
এক বন্ধু ফোন করেছিল হয়তো খানিক খবর নেওয়ার জন্যই।
হত চকিত হয়ে ভাবলাম “কাল রাতে জল পর্যাপ্ত না খেলে আরো dehydrated হয়ে যেতাম হয়তো; স্যানিটারী ন্যাপকীন বাড়ি গিয়েই চেঞ্জ করতে হবে”
“বাবা বলছিল ঠাম্মা-দাদু আজ আসবে, বাবা প্রেশারের ওষুধটা খেলো সময় করে?”
“ওই যে লোকগানটা ভাবছিলাম; এই নাইটটা শেষ করেই রেওয়াজ নেব একবার”
“ইনু দাদাভাইকে বলে যদি একটা নাচের পার্ট চেষ্টা করা যায়”
“শ্রেয়াকে আর একবার জিজ্ঞেস করবো সিল্ক রুটের প্ল্যানটা কি হল; পাহাড় যে বড় ডাকছে”
বাড়ি ফেরার পথে ❤