শেষ দু’বছর পায়ে শেকল পরানো ছিল। বাড়ি, হাসপাতাল, হোস্টেল এই তিনের মধ্যেই চরকিবাজি খাচ্ছিলাম। পড়াশোনার চাপ ছিল সাংঘাতিক রকম। সব মিলিয়ে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। কোথাও একটু বেরিয়ে পড়ার জন্য মনটা ছটফট করছিল। আমি, রিপন আর ঋতায়ণ মেডিক্যাল কলেজে গলায়-গলায় বড় হয়েছি। সে বন্ধুত্ব এখনও অটুট আছে। সুযোগ পেলেই আমরা বউ-বাচ্চা সমেত ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। বিচ্ছিরি ভাইরাসের খামখেয়ালিপনা আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা বারবার বানচাল করে দিচ্ছিল। তৃতীয় ঢেউ পেরিয়ে অবশেষে সুযোগ এলো। কোভিড প্রায় নিয়ন্ত্রণে বললেই চলে। নতুন করে কিছু অঘটন না ঘটলে, ভাইরাসের ভয়ের রাজত্বের দিন শেষ, এ কথা বলাই যায়। ঘুরতে বেরোনো নিয়ে আমার শুধু একটাই ইচ্ছের কথা পিয়ালীকে জানিয়েছিলাম, জানলায় বা ব্যালকনিতে কুয়াশা দেখতে দেখতে চা খেতে চাই। এরপর বাদবাকি পরিকল্পনা পুরোটাই পিয়ালীর। অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর ঠিক হ’লো আমরা মেঘালয় ঘুরতে যাচ্ছি। আমি, আরশি, পিয়ালী, রিপন, সুস্মিতা, ওদের মেয়ে ধানসিঁড়ি (নামটা আমার দেওয়া), ঋতায়ণ, উদিতা। সব মিলিয়ে আটজন। আট জন মিলে ঘুরতে বেরোলে যা হয়- ডিউটি অদলবদল, ছুটি জোগাড় করা, আরও নানারকম ‘এবং-কিন্তু’র ভিড়। সব সামলে উঠে রিপন যেদিন জানালো প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে, সেদিন অবশেষে বিশ্বাস হলো, যাওয়াটা তাহলে হচ্ছেই। দোসরা এপ্রিল সকাল ন’টা পঁয়ত্রিশে ফ্লাইট।
আরশি আর পিয়ালী বাড়িতে ছিল। সব বেঁধেছেঁদে আনতে হ’ত। আগের দিন সন্ধ্যে অব্দি রোগী দেখে রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম। ভোর ভোর উঠে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। জানি, অনেকেই হয়তো অবাক হবেন; রিপন ছাড়া আমাদের সবারই এটা প্রথমবার আকাশ পথে ভ্রমণ। রিপনের দ্বিতীয়বার। আমরা সবাই ঘাড় উঁচু করে প্লেন দেখা ‘পাবলিক’। কী কী কাগজপত্র লাগবে, কেমন করে চেক-ইন করবো; সেসব নিয়ে বেশ কিছু সংশয় ছিল। যাইহোক সেগুলো ভালোভাবে কাটিয়ে অবশেষে প্লেনে উঠে পড়ে গেল। শিলংগামী প্লেন। সিনেমা-টিনেমায় প্লেনগুলোকে যেমন দেখায়, প্রথমেই সে ভাবনা বদলে গেল। ইকোনমি ক্লাস। মোটামুটিভাবে হাওড়া-ফুলবাগান মিনিবাসের মত চেহারা। বসার সিট গুলোও মোটামুটি ওরকমই। বেল্ট বাঁধা হ’ল। প্লেন ছুটলো, প্লেন উড়লো। সাময়িক ওজন বেড়ে যাওয়া অনুভব করলাম। আরশি শুধু বলছিল, “মা ভালো লাগছে না। আমাকে জড়িয়ে ধরো।” ওদিকে ধানসিঁড়ি মনের আনন্দে বাবার সাথে কার্টুন দেখছে। ঋতায়ণের সওয়া হানিমুন। ওদের এসময় বিরক্ত করা উচিত নয়। ছোট প্লেন বলেই হয়তো দ্রুত ওঠানামার সময় ওজন পরিবর্তন অনেক বেশি হচ্ছিল। সাথে মেঘের সাথে পাল্লা দেওয়ার কাঁপুনি। প্রথমবার ভ্রমণের অজানা অস্বস্তি তো ছিলই। প্রায় দু’ঘন্টা বাদে নিচে ছবির মতো সবুজ পাহাড় আর মেঘের একান্ত আলাপচারিতা চোখে পড়লো। প্লেন মাটি ছুঁয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। চারদিকে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট বিমানবন্দর। এই তবে মেঘালয়! মেঘের দেশ!
শিলংয়ের পুলিশ বাজার যেতে হবে। বিমানবন্দর থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। ওলা, উবের এখানে চলে না। ট্যাক্সির অস্বাভাবিক দাম। মারুতি সুজুকির অল্টো গাড়ি হলুদ-কালো রঙ করা। জিনিসপত্র বোঝাই করে দুটো গাড়ি শিলং অভিমুখে চললো। রাস্তার দু’দিকে তাকালে একটাই কথা ভেতর থেকে উঠে আসে- আঃ! শান্তি! চারদিকে উঁচু উঁচু পাইন গাছের জঙ্গল। আর ওই যে ক্রিসমাস ট্রি-গুলো, ওগুলো কি আসলে ফার গাছ? কে জানে। এর আগে পড়ার সময় ‘ইনভার্টেড ফার ট্রি অ্যাপিয়ারেন্স’ নামটা পড়েছিলাম। অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু এভাবেই কলোনি গড়ে তোলে। কিংবা চামড়ার রোগ ধরলে… যাক সেসব। ঘুরতে যাওয়ার গল্প বলতে এসে ডাক্তারির নীরস গল্প শুনিয়ে কাজ নেই। ততক্ষণে প্রতি বাঁকে প্রকৃতি নিজের রূপ-রহস্য মেলে ধরছে। স্যাঁতসেঁতে পাহাড় জুড়ে থরে থরে ফার্ন। হঠাৎ আমি চেচিয়ে উঠলাম, “এখানেও শিমুল!” রিপন আর সুস্মিতাও অবাক হয়ে আমার কথায় সম্মতি দিল। পরে বুঝেছি, এ সবই আসলে উদ্ভিদবিদ্যায় আমাদের প্রকাণ্ড জ্ঞানের নিদর্শন। ওই যাকে বলে, অন্ধের হস্তিদর্শন। ওগুলো রডোডেনড্রন ছিল। জানার সাথে সাথেই মনের মধ্যে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, ঘামে ভেজা কোলকাতা, পিচগলা রাজপথ উঁকি দিয়ে গেল…
“শহরের উষ্ণতম দিনে
পিচগলা রোদ্দুরে বৃষ্টির বিশ্বাস
তোমায় দিলাম আজ।
আর কীই বা দিতে পারি
পুরনো মিছিলে পুরনো ট্রামেদের সারি
ফুটপাথ ঘেঁষা বেলুন গাড়ি
সুতো বাঁধা যত লাল আর সাদা
ওরাই আমার থতমত এই শহরে
রডোডেনড্রন…
তোমায় দিলাম আজ।”
বাঁক ঘুরতেই উমিয়ম লেক। কৃত্রিম হ্রদ। ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে আসাম স্ট্রেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড জলবিদ্যুৎ তৈরীর জন্য হ্রদটি খনন করে। অবাক হচ্ছেন তো? মেঘালয়ের মধ্যে আসাম সরকার কী করছিল? আসলে মেঘালয় রাজ্য ১৯৭২ সালে আসাম ভেঙে তৈরি। তথ্য দিয়ে ভ্রমণকাহিনী ভারাক্রান্ত করবো না। হ্রদের চারদিকের প্রকৃতি যেন দক্ষ শিল্পীর তুলির আঁচড়। যতদূর চোখ যায় দিগন্তজোড়া পাহাড়ের সারি। হ্রদের চারদিকে ইতিউতি ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়। শিলংয়ের রাস্তায় একটা অদ্ভুত অভিজাত আলস্য আছে। এমনিতেই ভিড়ভাট্টা, ক্যাঁচম্যাচ অনেক কম। গাড়ি কখনো জ্যামে আটকালে কেউ অকারণে হর্ন দেয় না। রাস্তায় পুচপুচ করে পানের পিক ফেলার প্রশ্নই ওঠে না। শহরের মধ্যে অল্প দূরত্ব ছাড়া ছাড়া ডাস্টবিন। বেশ কিছু ডাস্টবিন সুদৃশ্য বাঁশের তৈরি। কোথাও ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুড়িভরা ফুল ঝুলছে। বাড়িগুলোও চোখ জুড়িয়ে দেয়। বেশিরভাগ বাড়িতেই এক চিলতে ব্যালকনি। রামধনুকে লজ্জা দেওয়া ফুলের বাহার। পাহাড়ের চরিত্র মেনে রাস্তা কোথাও উঁচু, কোথাও হঠাৎ নিচু। পুলিশ বাজারে যখন এসে পৌঁছোলাম তখন দুপুর। জেল রোডের ওপর ভারত সেবাশ্রম সংঘে থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে। পকেট বাঁচানোর জন্য আদর্শ জায়গা। মোটামুটি ভদ্রস্থভাবে থাকার জন্য একদম উপযুক্ত। আমাদের আটজনের কেউই উত্তেজক পানীয় খায় না। কাজেই সেরকম অসুবিধে হয়নি। নিরামিষ খাওয়া অসম্ভব। তাই খাওয়াদাওয়া বাইরেই করে নেবো, ঠিক করলাম। রুমে ঢুকে, স্নান সেরে গুছিয়ে যখন বেরোচ্ছি তখন বেলা প্রায় তিনটে। একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করলাম- শিলংয়ের স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচুর বাঙালী। বিশেষত ভাতের হোটেল বা জেল রোডের আশেপাশের দোকানগুলোয় নির্দ্বিধায় বাংলা বলা যায়।
বাজারটা ঘুরে দেখতে দেখতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। পুলিশ বাজার অনেকটা যেন শিলংয়ের ধর্মতলা। পরের দিনের ঘোরার জন্য গাড়ি বুক করা হ’ল। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। হাসপাতাল আর ডাক্তার খুঁজতে গিয়ে দেখলাম সেসব বেশ বিরলদৃষ্ট। গুটিকয়েক চেম্বারের সাইনবোর্ড কোথাও কোথাও চোখে পড়ে। ওষুধের দোকানও হাতে গোনা কয়েকটা। অনেক ভোর থেকে যাতায়াতের পরিশ্রমে সবাই ক্লান্ত। খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম। লেপের আদরে ঘুমের কোন গভীরে তলিয়ে গেলাম, কে জানে…