“ছেলেটা তো ভাবলাম আমার হাতেই মারা গেল…” ক্যাথল্যাব থেকে বেরিয়ে রঞ্জনদা (ডাক্তার রঞ্জন শর্মা) মা’কে জানালো।
“দীপঙ্কর বলছিলো কয়েক বছর আগে নাকি বুকে একবার খুব ব্যথা হয়েছিল-আসলে তখনই রেমাস পুরো বন্ধ হয়ে যায়..এলএডি নাইনটি ফাইভ পারসেন্ট…সারকামফ্লেক্স লং সেগমেন্ট ব্লক…রেমাসটা খুলতে গিয়েই কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট…যাই হোক মাসিমা, দীপঙ্কর এখন ঠিক আছে….”
আবার সন্তানের মৃত্যু? গায়ত্রী এই সম্ভাবনাটা কখনও ভাবে নি। হাসপাতালে কে যেন মাছের ঝোল ভাত দিয়েছে…গায়ত্রী নীরব নিয়মে খেয়ে নেয়। যেমন প্রতিবাদহীন চিরকাল সব কাজ করেছে।
মনে পড়ে সেই দন্ডকারণ্যে তুলোর সাপ দিয়ে লক্ষণরেখা করে চলে যেতাম? কতো কষ্টে একমাত্র জীবিত সন্তান…
তপ্পি সেরে উঠে আবার কলেজে কাজ করছে?
মা বাবা রয়ে গেল কল্যাণীতে। ছাতারে পাখি, মাধবীকুঞ্জ বাড়ি আর অপেক্ষা। গল্পের বই পড়া নেশা ছিল-এখন বইগুলো উল্টো করে ধরে থাকে-পাতা উল্টোয় না-অক্ষর সব অচেনা হয়ে গেছে-খেতে ভুলে যাচ্ছে-কী ভাবে যেন খায়?
খাবার গিলতে পারছে না। অগত্যা গ্লুকোজ গুলে খাওয়ানো। তপ্পি এখন একটু ঘনঘন আসছে-বোঝাচ্ছে-পেটে একটা ব্যথা-কনকনে-দন্ডকারণ্যে মনে পড়ে তুলোর সাপ বানিয়ে ওকে বড়ো করেছি-এখন এই উন্মাদ কলকাতা শহরে ঐ শিমূলের গাছ কোথায় পাবো? কে দেখে রাখবে আমার তপ্পিকে?
মা’কে নিয়ে আবার কলকাতা। এবার ডাক্তার সুজাতা ঘোষ। কলেজতুতো বৌদি (কার্ডিওলজিস্ট ডাক্তার দেবাশিস ঘোষের বৌ)।
“দীপঙ্কর.. মাসিমার ডিমেনশিয়া…খুব লেট স্টেজ-খবরের কাগজের নাম, ঠিকানা- কী খেয়েছেন-নিজের নাম সব ভুলে গেছেন-লেখাপড়াও-হ্যাঁ খেতেও ভুলে গেছেন-এই রোগের শেষ অবস্থায় এটা হয়… ভীষণ ডিগনিফায়েড… অসম্ভব ভদ্র-নম্র-শান্ত একজন মহিলা-এটাই ওনার অন্তরের রূপ-এই অবস্থায় মানুষের ভেতরের আসল রূপটা বেরিয়ে আসে-ভদ্রতার মুখোশ সরে যায়-দীপঙ্কর তুমিও মন শক্ত করো; এরপর ব্রেন বাকি সব কাজ ভুলে যাবে-তখন….”
ডাক্তার সুজাতা ঘোষ চলে যেতে যেতে ফিরে তাকান “মাসিমাকে নিজের কাছে রাখো-শেষ কটা দিন”
বৌদি তুমিও ভীষণ ডিগনিফায়েড, ভদ্র, নম্র-ভালো থেকো বৌদি।
কোনও বাড়িওয়ালা অসুস্থ, শয্যাশায়ী মানুষ রাখতে রাজি নয়-তারপর ডায়াপার-ময়লা…কেউ রাজি নয় বর্তমানে বোধহীন একজন আত্মীয়কে, মানুষকে বাড়িতে রাখতে, কতো ঝামেলা-আয়া নার্স, না গো তুমি তোমার মা’কে অন্য কোথাও রাখো…..বরং হাসপাতালে, নার্সিং হোমে-কোথাও একটা রাখো।
সুতরাং নার্সিং হোম টানা তিনটি বছর। এক ইশকুল দ্বারোয়ানের বৌ মায়ের জন্য পরম স্নেহে রান্না করে আনতো-আমি কৃতজ্ঞ। সন্ধ্যা নাইয়া-ভালো থেকো।
একটানা তিন বছর নার্সিং হোমের কেবিনে।
আমি আমার মা’কে রাইলস টিউব পরাবো না-তাহলে হাত বাঁধতে হবে।নাহলে বোধহীনা মা হাতে করে টেনে রাইলস টিউব খুলে দেবে।ক্যাথেটার পরাবো না। হোক খরচ-ডায়াপার পরাবো। ক্যাথেটার পরালে তো মায়ের কষ্ট হবে।
মা তোকে এবার নাক টিপে খাওয়াবো-মুখে লেবুর রস দিয়ে.….তুই যেমন ছোটবেলায় আমাকে খাওয়াতিস। আমার যা কিছু কাজ আছে, আমি সাঙ্গ করবো পরে। এবার চেম্বার, চাকরির পালা শেষ। এখন মাকে দেখতে আসার লোকজন আর নেই। ইশকুল ফেরত ঘেমো, ক্লান্ত নাতিটা প্রতিদিন একবার ঠাম্মাকে দেখতে আসে। কেউ বছরে একবার, কেউ শুধু একবার। মা তুই আজ ফুরিয়ে গেছিস-তোর কাজ ফুরিয়েছে।
এবার বুড়ো বাবা ভর্তি হলো হাসপাতালে। বাবার স্মৃতি, বোধ, সবই প্রখর। কিন্তু ব্যাধি বহুবিধ। একা থাকার অবস্থা আর নেই। বাবা নার্সিং হোমের পরিবেশ সহ্য করতে পারছে না। জমানো টাকাও শেষ। আবার টুকটাক টাকার ধান্ধা করতে হচ্ছে।
সুতরাং এবার একটা ভাড়া বাড়ি লাগবেই। কাছাকাছি। যাতে দুবেলা গিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখতে পারি। সংসারের কাজগুলো করতে পারি। কেননা এই দুজন বুড়োবুড়িকে একা কোথাও রাখা যাবে না-আমায় ওদের সঙ্গেই থাকতে হবে।
মা বাবা কেউ হোম ডেলিভারি বা দোকানের খাবার খেতে পারে না। অখাদ্য।
শ্রী পুলিন কৃষ্ণ পালবাবুর একতলাটা ভাড়া পেলাম। বাড়িটার সামনে একটা অনাথ আশ্রম-একটা পুজোর মন্দির। আমার নাস্তিক মাকে ডায়াপার পরিয়ে মন্দিরে নিতাম। কমলদা অনুমতি দিয়েছিলো। বাচ্চাদের মাসে একবার খাওয়াতাম-ওরা মায়ের সামনে দৌড়োদৌড়ি করতো। মা, তুই কি কিছুই বুঝতিস? পেতিস সংসারের ছোঁয়া?
রাতের পর রাত-উঠে উঠে দেখা-বেঁচে আছে তো বুড়োবুড়ি? নিঃশ্বাস পড়ছে তো? ডায়াপার ভেজে নি তো?
তখন বাবার দুটো পা’ই অসাড়, পায়খানা বাথরুমের বোধ নেই-মানসিক ব্যাধিও এসে বাসা গেড়েছে। মায়ের তো আগেই সব বোধ গেছিলো।
এক বিকেলে দেখি শ্রীমান সুদীপ্র-জুতোর সোল গেছে ছিঁড়ে-পা টেনে টেনে আসছে-ঠাম্মা দাদ্দার কাছে। এই ছবিটি আমার স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে।
এক ভাইবৌ হঠাৎ এক ঝলক খোলা হাওয়ার মতো এসে হাজির। মেজজ্যেঠু, জ্যেঠিমার কাছে। বিনা খবরে।
সবাই বড্ড ব্যস্ত। এই ব্যস্ত সময়-তীব্র পুঁজিবাজারে কার পক্ষেই বা সম্ভব, এসে বসে থাকা? তবু এই ছোট্ট ছোট্ট পাওয়াগুলো মন ভরে দেয়।
প্রায় দেড় বছর আমি মা বাবাকে রান্না করে খাইয়েছি (রান্নাটা এখন চমৎকার করছি-তবে মায়ের মতো নয়)।
তারপর দু হাজার চোদ্দো-বাইশ দিনের ব্যবধানে, প্রথমে মা তারপর বাবা চলে গেলো। চিনিয়ে দিয়ে গেলো পৃথিবীতে আপন পর বলে কেউ হয় না। ইভামাসি, ভটচাযবাবু (লাং ক্যানসার রোগী), দিদিভাই, কল্যাণদা-শম্ভুদা, আমি যখন থাকতাম না আমার পুরোনো রোগীদের অনেকেই এসে আমার মায়ের কাছে বসে থাকতো এবং আমার নাবালক ছেলেটা…কতো মানুষ ঘিরে ঘিরে ছিলো। একদিনও একা লাগে নি।পৃথিবী বড্ড সুন্দর-বড্ড ভালবাসা ভরা। পৃথিবী আমাকে দুহাত ভরে ফেরত দিয়েছে ভালবাসা, আমি পূর্ণ, আমি তৃপ্ত।
মা বাবার সময় শেষ হয়ে গেছে-সেই যুগের অবসান হয়েছে। যারা এদের স্নেহে, ভালবাসায় বড়ো হয়েছে-স্বনামধন্য হয়েছে-তারা সবাই ভালো থাকুক। তাদের সাফল্যে তো আমার মা বাবার কিছু স্পর্শ থাকবেই-থাকবে। সেটা আমারই প্রাপ্তি।
পুনশ্চঃ একবার বেলেতোড়ে- যামিনী রায়ের গ্রামে, গাজনের গ্রামে মাস্টারমশাই বিশ্বনাথ রায়ের (বিশুকাকা, রাজনীতির জন্য জেলখাটা, যার মৃত্যুতে বেলেতোড় শ্মশান গরীবগুর্বো মানুষে ভরে গেছিলো) ছোটছেলে -নির্মাল্য আমাকে একটা মানপত্র দিলো। আমি তো অবাক।আমাকে বেলেতোড় থেকে মানপত্র!! আমি আবার কী মহান কম্মোটা করলাম?
তবে মানপত্রটা পড়ে’ আরও অবাক-পুরোটাই গ্রামের তরফ থেকে আমার মা বাবাকে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানানো। তারা দুজনে এই গ্রামের মানুষের জন্য যা করেছে তার খতিয়ান-আর প্রার্থনা করা যেন এদের সন্তান এদের মতোই মহান আর পরোপকারী হয়।
তাহলে? কিছু তো থেকে যায়ই। সেটাই পাথেয়।সেটুকুই বেঁচে থাকা।
সমাপ্ত-একটা সময়ের-একটা যাপনের-একটা চিন্তাধারার।
এবং তব (এটা তব নয় ‘তোমাদের’ হতো-এটা ঐ যুগের সব মা বাবাদের উদ্দেশ্যে লেখা) চরণে আমার অবনত প্রণতি।