‘স্যার, সোমবার ওর অপারেশনটা কখন করবেন ?’ অল্পবয়স্ক মেয়েটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল।
আমার সামনেই টেবিলের উপরে একটা ক্যালেন্ডার এবং প্ল্যানার রাখা। ফেব্রুয়ারী মাসের পাতাটা খোলা। তাতে আগামী কয়েকদিনের পরিকল্পিত অপারেশনের নাম, রোগীর নাম, সময়, তারিখ লিখে রাখা। এই তরুণীর সঙ্গীর অপারেশন তো মঙ্গলবারে লেখা আছে!
‘সে কি? সোমবারে তো আমার কোনো অপারেশন নেই! আর ওনার অপারেশন মঙ্গলবারে রাখা আছে।’
‘আপনি তো বলেছিলেন সোমবারে করবেন!’
‘না, আমি মঙ্গলবারে করব বলেছিলাম। আর সেটাই লেখা আছে এখানে।’
ছোট ছেলেমেয়ে থেকে বুড়োবুড়ি বিভিন্ন বয়সের রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সামলে চলেছি গত সিকি শতাব্দী ধরে। কিন্তু আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে শান্ত অথচ কঠিন স্বরে আমার উপর মানসিক চাপ তৈরি করতে এমন কাউকে দেখিনি।
‘কেন, সোমবারে করতে অসুবিধা কোথায়?’
‘সোমবারে অপারেশন থিয়েটার খালি নেই। আমারও ওইদিন অন্য অনেক কাজ আছে। আর তাছাড়া এটা তো কোনো এমার্জেন্সী পরিস্থিতি নয়।’
‘না মানে…..’
এবারে মাথা নীচু করে মেয়েটি বলল, ‘আমরা অ্যাষ্ট্রোলজারের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। আমাদের অ্যাষ্ট্রোলজার বলেছেন সোমবার দিনটা খুব ভালো। সকালের দিকে। ওইদিন উনি অনেকটা সময় দিয়েছেন। তার মধ্যে করে দিলেই হবে।’
‘অ, অ্যাষ্ট্রো! তা এক কাজ করুন- ওই অ্যাষ্ট্রোলজারকেই বলুন সার্জেন ঠিক করে দিতে। আর তাঁর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অপারেশন করিয়ে নিন। আমি পারব না। আমাকে ছেড়ে দিন।’
‘না না আমরা আপনাকে দিয়েই করাব। সেই জন্যেই এ ক’দিন অপেক্ষা করে আছি।’
রোগী ছেলেটি মৃদুভাষী। সে সম্ভবতঃ মেয়েটির ফিয়াঁসে। সে বলল, ‘আসলে ও অপারেশনে ভয় পাচ্ছে তো, তাই।’
‘ভয় পাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে আমি ভয় কাটাতে অ্যাষ্ট্রোসার্জারী করতে পারব না।’
‘আসলে বাবা-মা জ্যোতিষীতে বিশ্বাস করেন তো, তাই।’ ছেলেটি বলল।
‘কিন্তু তোমরা দুজনেই তো অ্যাডাল্ট! তোমাদের নিজস্ব মতামত নেই?’
আজকাল এই এক ফ্যাশন হয়েছে- অ্যাষ্ট্রোসার্জারী, অ্যাষ্ট্রো সিজার! জ্যোতিষীর বেঁধে দেওয়া সময়ে নবজাতককে পৃথিবীর আলো দেখানো চলছে। জন্মের পরেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে সাথে সে পাচ্ছে অবিজ্ঞানের ছোঁয়া! জ্যোতিষ নির্ধারিত লগ্নে জন্ম হলে সে শিশুকে আর পায় কে! জীবনে সে নাকি যা ধরবে, তাতেই সোনা ফলবে!
মা-মাসী-দাদু-ঠাকুমাকে শিখন্ডি করে তথাকথিত শিক্ষিত, আধুনিক ও সচ্ছল যুবসমাজ ক্রমশঃ অবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের কুয়াশায় পথ হারাচ্ছে। এই বিপথের শেষ কোথায় কে জানে!
আমার রোগী ও তার সঙ্গিনীকে বললাম, ‘অপারেশনের সময় ঠিক হবে, রোগের পরিস্থিতি অনুযায়ী, আপনার-আমার-হাসপাতালের সুবিধাজনক সময়ে। কোনো জ্যোতিষীর গণনা অনুযায়ী নয়। না হলে আমি এ ব্যাপারে নেই।’
ছেলেমেয়ে দুটো চুপচাপ মেনে নিল আমার কথা।