মাধুদা আমার বড় জ্যাঠামশায়ের মেজো ছেলে — আমার ‘রাবুণে’ গোষ্ঠীতুল্য পিতৃকুলের বিয়াল্লিশ জন তুতো ভাই বোনের অন্যতম। বয়সে আমার চেয়ে বাইশ তেইশ বছরের বড় হবেন মাধুদা — আমার মায়ের চাইতে বছর তিনেকের ছোট তিনি।
শুনেছি, মায়ের বৌভাতের দিন তিনি ও তাঁর ছোট বোন আমার মাকে চন্দনের সাজে সাজিয়েছিলেন।
বড়জ্যাঠা মিলিটারির গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার, আজীবন লখনৌ-প্রবাসী। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে সকলেই ভীষণ রকম কৃতী ও সচ্ছল। আমাদের নিতান্ত মধ্যবিত্ত যাপনের থেকে অনেক দূরের নক্ষত্র ছিলেন তাঁরা। যোগাযোগ যেটুকু ছিল, তা বাবার সঙ্গেই, চিঠিপত্রের মাধ্যমে। মাধুদার সঙ্গে সর্বসাকুল্যে আমার বার দুয়েক সাক্ষাৎ হয়েছে এতাবৎ। প্রথমবার, তাঁর বিয়ের সময়। তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়স। টোপর পরা একটি শ্যামলা রোগাটে চেহারা ছাড়া কিছুই আর স্মৃতিতে নেই।
দ্বিতীয়বার তাঁকে দেখেছিলাম আমার ন’জ্যাঠার মেয়ে বুবীদিদির বিয়েতে — উনিশশো বিরানব্বই সালে।
তখন আমি ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নশিপ করছি। স্বভাবতই, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্গতিতে কিঞ্চিৎ ‘জাতে উঠেছি’, তাই গুরগাঁও-বাসী, বাংলা প্রায় ভুলতে বসা মাধুদার সঙ্গে দু’চারটে বাক্যালাপের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
তবে আত্মীয় হয়েও শ্রেণীবৈষম্য বজায় রাখার ফলে এঁদের প্রতি আমার একটা চাপা ক্ষোভ ছিল, সেটা খুব কাটাকাটা কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, মনে আছে।
জনান্তিকে মাধুদাকে এমন কথাও বলতে শুনেছিলাম, সম্ভবত ন’জ্যাঠাকেই বলছিলেন — “দ্য গার্ল ইজ কোয়াইট আ স্নব — সো আনলাইক কাকা অ্যাণ্ড কাকিমা!”
তারপর কেটে গিয়েছে বেশ অনেকগুলো বছর। বাবা হঠাৎ করেই চলে গেল একদিন। বাবার দিকের আত্মীয় বলতে দিল্লিবাসী ন’জ্যাঠা, তাঁর দুই মেয়ে আর কলকাতার বাসিন্দা দুই পিসী আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই কেবল ক্ষীণ একটা যোগসূত্র থেকে গিয়েছিল কিছু বছর।
কোভিডের সময় ন’জ্যেঠি, যাঁকে জেম্মা বলতাম, তাঁর চলে যাওয়ার খবর পেলাম। তারপরেই গেলেন ন’জ্যেঠু। ক্যানসারে আক্রান্ত বড়দিদি দেবীদিও চলে গেল একদিন।
নিয়ম করে যোগাযোগ রেখে যেত বুবীদিদি। তার কাছ থেকেই মাধুদা আমার ফোন নম্বর পেয়েছিলেন।
সময়ে-অসময়ে ফোন করতেন, হোয়াটস্যাপ করতেন, উৎসুকভাবে খবর নিতেন আমাদের। প্রতিদানে আমারই নিয়মিত ফোন করা আর হয়ে উঠত না। তবে বিজয়া আর নববর্ষে মেসেজ করতে ভুলিনি কখনো — সমাজমাধ্যমের পোকা আমি, ওটুকু ভুললে চলে?
কালের অমোঘ নিয়মে মায়ের মৃত্যুসংবাদও একদিন দিতে হলো মাধুদাকে।
ওঁর ফোন করা কমে এসেছিল এর পরে।
বুবীদিদি অবিশ্যি বড়ই চিন্তিত থাকে আমাকে নিয়ে — একা থাকি, বয়স হচ্ছে, কখন কি হয় — তাই, মাসে দু’তিনবার আমাকে ‘নক’ করা ওর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমি যথারীতি নির্লজ্জের মতো নির্লিপ্ত থাকি — নিজে থেকে ফোন করা আর হয়ে ওঠে না পারতপক্ষে। ঐ হোয়াটস্যাপে কৃত্রিম ফুলের তোড়ার মতো গুড মর্নিং-এর ছবি পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে আমার লৌকিকতা।
আজ, আন্তর্জাতিক নারী শ্রম-অধিকার দিবসে বুবীদিদির ফোন পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম, খুশিও। রক্তের জোর কমছে, তাই কি বাড়ছে রক্তের টান?
বাংলা, ইংরেজি মিশিয়ে কুশল সমাচার বিনিময়ের পরে হঠাৎই জিজ্ঞাসা করল বুবীদিদি — ‘খুকু, মাধুদা তোমার জন্য খুব ভাবনা করে আজকাল। ডিড ইউ হ্যাভ আ টক উইদ হিম রিসেন্টলি?’
আমি জানালাম — হ্যাঁ, গত পরশুই মাধুদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার লেখার প্রশংসা করছিলেন উনি।
বুবীদিদি অবাক হয়ে বলল — “হাউ কাম? মাধুদা তো বেঙ্গলিতে মোটেই ফ্লুয়েন্ট নয়, অ্যাণ্ড তুমি তো বাংলায় ছাড়া লেখো না।”
সত্যি বলতে কি মাধুদার মুখে আমার লেখাপত্রের উল্লেখে আমিও বেয়াড়া রকমের অবাক হয়েছিলাম। প্রশ্নও রেখেছিলাম, উনি পড়লেন কি করে? তার উত্তরে আমার বৃদ্ধ দাদাটি অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে জানিয়েছিলেন, গুগল ট্রান্সলেশনে পড়েছেন।
শুনে আমার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেটা বুবীদিদিকে জানিয়ে খুব একচোট হাসাহাসি করলাম দু’বোনে।
তারপরেই বুবীদিদি বলে উঠল —”খুকু, মাঝে মাঝে মাধুদার খবর নিও। হি ইজ সো কনসার্নড অ্যাবাউট ইউ। যখনই ফোনে কথা হয়, হি নেভার ফরগেটস টু আস্ক — বুবী, হাউ ইজ ছোটকাকিমা’জ় ডটার?”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
চিরকাল আমাদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বলতে মায়ের দিকের লোকজনকেই চিনে এসেছি — মামা, মাইমা, মাসি, মেসোমশাইরা, মামাতো-মাসতুতো দাদা-দিদি, ভাই-বোন এদেরই জেনে এসেছি চিরন্তন আত্মজনরূপে। বাবার বোধহয় অভিমান হতো। মাঝেমধ্যে বলে উঠতো — “বুঝলি বাপি, সামাজিকতায় তোর একেবারে ম্যাট্রিয়ার্কাল ফ্যামিলি’!
মাকেও দেখতাম, অনেকদিন পর্যন্ত ঐ কুমারীজীবনের ‘মুখোপাধ্যায়’ পদবীটির মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
আমার কিন্তু কোনও ‘প্যাট্রিয়ার্কাল’ হ্যাংওভার ছিল না বন্দ্যোপাধ্যায় হওয়াকে ঘিরে। বাবার পরিবারের প্রতি টান বাবাকে দিয়ে আরম্ভ করে বাবাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল আমার, অন্তত নিজে তাই জানতাম এতদিন।
মধুদা তো ছোটকাকার মেয়ে বলেও অভিহিত করতে পারতেন আমাকে। করেননি। আশির প্রান্তে পৌঁছনো প্রাচীন মানুষটির কি মনে পড়ে গিয়েছিল আটান্ন-ঊনষাট বছর আগে এক বর্ষাস্নাত সন্ধ্যায় প্রায় সমবয়সী কাকিমাকে চন্দন পরানোর কথা? জানি না।
তবে এখন থেকে হোয়াটস্যাপে মাধুদার পাঠানো দু’ছত্র বার্তা দেখলেই মনে হবে, যে আঙুলগুলো মোবাইলের কি-বোর্ডে ধীরে ধীরে টাইপ করে আমাকে শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে, বহু বহু বছর আগে সেই আঙুলগুলোই আমার মায়ের কপাল স্পর্শ করেছিল —
‘নাড়ীতে মোর রক্তধারায়, লেগেছে তার টান’ —
এই বছরের ৮ই মার্চ আমাকে মাতৃ/পিতৃতান্ত্রিকতার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে এক আশ্চর্য মানবিক বাঁধনের আনন্দস্পর্শ এনে দিল — তারই আলোয় আমার গোটা দিনটি, তার সমন্ত নৈমিত্তিক গতানুগতিকতা নিয়েই ভাস্বর হয়ে উঠল, হয়ে উঠল অনন্য।
সঙ্গের ছবিতে আমার দ্বিতীয় পরিবার, মেডিক্যাল কলেজ ব্লাডব্যাঙ্কে আজকের দিনটি উদযাপনের কিছু মুহূর্ত — জুনিয়র এবং সিনিয়রদের সঙ্গে।
একদিন পৃথিবী লিঙ্গবৈষম্যহীন হবে, থেমে যাবে হিংসা, বন্ধ হবে দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রাপ্য অধিকার অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে অনেকখানি। ছোটকাকিমার মেয়ে সেদিন আর থাকবে না, তার এই আন্তরিক চাওয়াটুকু বেঁচে থাকবে চিরকাল।