বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ, বিরুদ্ধবাদীদের ‘সবক সেখানো’ দেশের প্রধান কর্তা, দিন দুনিয়ার মালিক মহামতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের দেশে করোনার কামড়ে দিশাহারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বীমানির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মুখে। প্রায় কুড়ি হাজার নাগারিক মৃত। আক্রান্ত এক লক্ষের বেশী। এই আতঙ্কে দিশাহারা ট্রাম্প সাহেব রোগ ঠেকাতে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদীর দেশের আই সি এম আর-এর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ) ২২.৩.২০২০ তারিখের একটি রিপোর্টকে।
এই সংস্থার তরফে মহা নির্দেশক অধ্যাপক বলীরাম ভগৎ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন যে National Task Force for Covid19 লক্ষ্য করেছে উপসর্গহীন স্বাস্থ্যকর্মী যারা প্রমানিত করোনা রোগীর চিকিৎসায় যুক্ত আছেন এবং সেই রোগীর নিকটাত্মীয়দের hydroxychloroquine ওষুধটা ৭ সপ্তাহ ধরে দিলে তারা Corona virus এর আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলা হয় Chemoprophylasis, অর্থাৎ কোন বিশেষ রোগ হতে পারে এই বিশেষ আশঙ্কায় আগে থেকে ওষুধ দিয়ে সেই রোগ প্রতিহত করা।
মনে রাখতে হবে এটি নিছকই একটি পর্যবেক্ষন, প্রমাণিত সত্য নয়, মহামতি ট্রাম্পের দেশের স্বাস্থ্য অধিকর্তার এর সঙ্গে সহমত না হলেও ট্রাম্প এই ওষুধটি সংগ্রহ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সকলেই জানেন যে ম্যালেরিয়ার প্রধান ওষুধ হলো Choloroquine এবং Hydroxy-choloroquine তারই একটি রূপান্তরিত যৌগ।
বেশ কিছু বছর ধরেই choloroquine-এর আর একটি বিশেষ ব্যবহার দেখা যায়। তা হল, Immunomodulation বা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (Immune System) পরিবর্তন করা। ফলে হাত বা অস্থিসন্ধির নানা স্বপ্রতিরোধী (Anti immune) রোগে এর ব্যবহার সাফল্যের সঙ্গে করা হচ্ছে। পরবর্তীতে দেখা যায়, chloroquine এর দীর্ঘ ব্যাবহারের ফলে মানুষের চোখ বা হৃৎপিণ্ডের যে সব ক্ষতি হতে পারে hydroxycholoroquine এ সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম। সেই জন্য দাম বেশী হলেও Choloroquine এর স্থানে Hydroxycholoroquine এর ব্যবহার চালু রয়েছে।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের গঠন
১৯৫০ সালে দুই বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার সারি এবং হেনরী হ্যামার স্টার্লিং ড্রাগস কোম্পানীর তরফে এই যৌগটি তৈরী করেন এবং তার পেটেন্ট বা মেধাসত্ত্ব ঐ আমেরিকান কোম্পানীর ছিল। ১৯৫৫ সালে FDA এটিকে স্বীকৃতি দেয়। সম্প্রতি FDA র অনেক কর্তাব্যক্তির অমতেও শ্রী ট্রাম্পের চাপে কোভিড ১৯-এর চিকিতসার আপাৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে এটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
আমেরিকায় ম্যালেরিয়া হয় না বলে Choloroquine ও Hydroxycholoroquine এর উৎপাদন দীর্ঘকাল ধরেই বন্ধ। মূল উৎপাদক হল ভারত, চীন সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি। ফলে ট্রাম্প সাহেব ভারতের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন চেয়ে পাঠালেন ৬ই এপ্রিল।
করোনা অতিমারীর জন্য অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষ থেকে বিদেশে ওষুধ ও চিকিতসার সরঞ্জাম রফতানী বন্ধ করা হয়েছিল। যদিও এর মধ্যেই ব্যবসায়ীদের চাপে দেশে বিপুল ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও দুলক্ষ টন PPE Kit ইউরোপে চালান হয়েছে। ভারত hydroxycholoroquine দিতে পারবে না চক্ষুলজ্জার খাতিরে প্রথমে জানালে ৭ই এপ্রিল ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুমকি দিলেন যে ভারত ওষুধ না দিলে “চরম প্রত্যাঘাত” করা হবে। ফলে অচিরেই ৫৬ ইঞ্চি ছাতি শুকিয়ে গেল এবং সরকারী নির্দেশে গুজরাটের দুটি কোম্পানী ‘ইপকা’ এবং ‘ক্যাডিলা’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই ওষুধ সরবরাহ আরাম্ভ করল। উল্লাসিত ট্রাম্প ঘোষণা করলেন, ভারত একটি মহান দেশ ও মোদী এক মহান মানুষ। এমনকি তিনি এও আশা করলেন এ বছরে চিকিৎসায় নোবেল প্রাইজের তিনি অন্যতম দাবীদার। (Trump optimistic about winning noble prize in medicine ** Borowitz, The New Yorker, April 6,2020)
বিস্মৃত বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রসঙ্গঃ
দুয়োরানীর ছেলে ভারতবর্ষে choloroquine ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসাবে উৎপাদনের প্রধান সংস্থা ছিল আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্টিত (বর্তমান মুমুর্ষ) বেঙ্গল কেমিক্যাল, যার জন্ম হয় পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম শিল্পসংস্থা হিসাবে। তারপর দীর্ঘদিনের অবহেলা ও উদাশীনতায় এই সংস্থাটি মুর্মুষ অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে।
১৮৯২ সালে আধুনিক ভারতীয় রসায়নের প্রাণপুরুষ আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মাত্র ৭০০ টাকা পুঁজি নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপন করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল। উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ইংরেজ বণিকদের শোষণের বিরুদ্ধে স্বদেশী উদ্যোগ ও স্বাধীন ব্যবসা গড়ে তোলা। বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতের যুব সম্প্রদায়কে স্বনির্ভর করে তোলা। স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সংগ্রামে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল এক মাইলফলক।
ইংরেজ শাসকের ঔদ্ধত্য ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিপ্রতীপে বিভিন্ন মানুষ শিল্পে স্বনির্ভরতার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বদেশি শিল্প উদ্যোগ ও তাঁর আপাত ব্যর্থতার কথা আমরা কবিগুরুর আত্মজীবনীতে পড়েছি। স্বদেশি শিল্প উদ্যোগের পাশাপাশি স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বাঙালি জাতির স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার মধ্যে বেঙ্গল কেমিক্যাল অনন্য। কেননা আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র কতিপয় অনুগামীর সাহায্যে স্বল্প পুঁজিতে দেশীয় প্রকৌশল, ভেষজ গাচগাছড়া এবং অন্যান্য দেশীয় উপাদানের মারফত নানা ধরনের উৎকৃষ্ট রাসায়নিক ঔষধপত্র এই প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত কম খরচে উৎপন্ন করতে থাকেন। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠান্টির নাম হয় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল’। লেবুর রস থেকে সাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন, সালফেট অফ আয়রন থেকে সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি, পশুর হাড় থেকে সুপার ফস্ফেট অফ লাইম ও ফস্ফেট সোডা বাজারের সোরাকে বিশুদ্ধ করে পটাশিয়াম নাইট্রেট তৈরী করা—এগুলি ছিল বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং প্রফুল্ল চন্দ্রের অনন্য অবদান। এর পাশাপাশি কবিরাজি ও দেশীয় ভেষজ বিদ্যা থেকে তথ্য সংগহ করে অ্যাটকিনস সিরাপ, হাইপোফসফেট ওফ লাইম, টনিক গ্লিসারোফসফেট, বাসকপাতা থেকে প্রস্তুত কাশির সিরাপ, জোয়ানের আরক (একোয়া টাইকোটিস), পেটের রোগের জন্য কালমেঘ ও কুর্চির সিরাপ প্রভৃতি বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে উৎপন্ন ওষুধ। তখনকার দিনের প্রখ্যাত চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর, অমূল্যরতন বসু, নীলরতন সরকার, সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রভৃতিরা কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলে এইসব ওষুধের ব্যবহার করতেন।
প্রফুল্লচন্দ্রের নিজের ভাষায় –
ইউরোপের শিল্প ও বিজ্ঞান পাশাপাশি চলিয়াছে। উভয়েরই একসঙ্গে উন্নতি হইয়াছে। একে অপরকে সাহায্য করিয়াছে। বস্তুত, আগে শিল্পের উদ্ভব হইয়াছে, তাহার পর আসিয়াছে বিজ্ঞান। সাবান তৈয়ারি, কাচ তৈয়ারি, রং ও খনি হইতে ধাতুর উৎপত্তি বিগত দুই হাজার বৎসর ধরিয়া লোকে জানিত। রসায়ন শাস্ত্রের সঙ্গে ঐ সব শিল্পের সম্বন্ধ আবিষ্কৃত হইবার বহু পূর্ব হইতেই ঐগুলির উদ্ভব হইয়াছিল। অবশ্য বিজ্ঞান শিল্পকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে। ইউরোপ ও আমারিকায় শিল্পের যে বিরাট উন্নতি হইয়াছে তার সঙ্গে বীক্ষণাগারে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। বাংলাদেশের কেবলমাত্র কতগুলি টেকনোলজিক্যাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাই সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয় নহে। সফল ব্যবসায়ী বা শিল্প প্রবর্তক হইতে হইলে যে সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, কর্মকৌশলের প্রয়োজনে, বাংলা যুবকদের পক্ষে তাহাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। কলেজের শিক্ষিত যুবকরা এক্ষেত্রে ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়াছে। তাহাদের মধ্যে কার্য্য পরিচালনার শক্তি নাই, বড় জোর সে অন্যের হাতে পুতুল বা যন্ত্রদাস রুপে কৃতিত্ব দেখাতেই পারে।
(আত্মচরিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়)
গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত নানা ধরনের রাসায়নিক, ভেষজ ছাড়াও সাবান, প্রসাধনী, জীবাণুনাশক প্রভৃতি উৎকৃষ্ট জিনিসপত্র বেঙ্গল কেমিক্যালে তৈরি হতো। শুধু মুনাফার জন্য নয়, দেশবাশীকে হাতে কলমে কাজ শেখানো ও বানিজ্যমুখী করে তোলাই প্রফুল্লচন্দ্রের মূল লক্ষ্য ছিল। এই সংস্থার একটি স্বাধীন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগো ছিল, যেখানে রাসায়নিক দ্রব্যগুলি উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি উৎপাদন করা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো। সেদিক থেকে দেখলে বেঙ্গল কেমিক্যালেকে পরাধীন ভারতবর্ষের প্রথম বিজ্ঞান গবেষণাগার বললে অত্যুক্তি হবে না।
১৯০৮ সালে জন কমিং ‘রিভিউ অফ দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল পজিশন অ্যান্ড প্রস্পেক্ট ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থে লেখেন, “বেঙ্গল কেমিক্যাল দেশি উপাদান ভিত্তিক একটি অসাধারণ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর থেকে পুঁজিপতি ও বণিকদের বহু কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে”।
১৯৪৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর আগেই অবশ্য বেঙ্গল কেমিক্যালের অধোগতি দেখা যায়। মূল কারণ ছিল আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্রের বিপ্রতীপে অন্যান্য অংশীদাআরদের মুনাফার জন্য অতিরিক্ত লালসা। বীতশ্রদ্ধ আচার্য্য এর পরিচালক সমিতি থেকে বেরিয়ে আসেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে এই সংস্থার (১৯০৩ সাল থেকে) প্রধান রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন শ্রী রাজশেখর বসু বা পরশুরাম। তাঁর পরিচালনায় বেঙ্গল কেমিক্যালের গবেষণা ও নানা নতুন ধরনের ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পায়। কলকাতা থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে পানিহাটিতে এর আরেকটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ৬০ একর জমি নিয়ে। এখানে সালফুরিক অ্যাসিড প্রস্তুতির যে যন্ত্র এবং ‘গ্লোভার্স ও গে লুকাস টাওয়ার’ নির্মিত হয়েছিল তা ভারতে একটি বড় অ্যাসিড কারখানা বলে গণ্য হতো।
প্রফুল্লচন্দ্রের জীবদ্দশায় এই কোম্পানিতে ২০০০ শ্রমিক কাজ করতেন, এবং সম্পত্তির মূল্য ছিল ৫০ লাখ টাকা। পরবর্তীকালে পুনে, মুম্বাই, এলাহাবাদেও বেঙ্গল কেমিক্যাল এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। বইপত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, সুদূর লাহোরেও বেঙ্গল কেমিক্যালের একটি শাখা তৈরি হয়েছিল।
বেঙ্গল কেমিক্যালে উৎপাদিত ফিনাইল ধরনের অ্যান্টিসেপটিক, সালফুরিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড, ফায়ার কিং নামক অগ্নিনির্বাপক প্রভৃতি পণ্য ব্রিটিশ কোম্পানিগুলিকে পরাভূত করে অনেক এগিয়ে যায়।
প্রফুল্লচন্দ্র সরে আসার পর থেকে বেঙ্গল কেমিক্যালের দুর্দিনের শুরু। যদিও তাদের উচ্চ মানের দ্রব্যাদির চাহিদা বেড়েই চলেছিল। সঠিক পরিচর্যার অভাবে কারখানাগুলো রুগ্ন হয়ে পড়তে আরম্ভ করলে ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এটি অধিগ্রহণ করে। ’৮০ ও ৯০ এর দশকে বিভিন্ন বিভাগে যে সব উৎপাদন হতো তা হলোঃ
ডিভিশন ১: অ্যালুমিনিয়াম সালফেট
ডিভিশন ২: ঔষধ ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য। যেমন, ব্যথা ও জ্বরের ওষুধ, কাশির ওষুধ হজমের ওষুধ, মাংসপেশী প্রসারণের ওষুধ, ভিটামিন, টিবি ও ম্যালেরিয়ার ওষুধ, হাঁপানির ওষুধ, সাপে কাটার ওষুধ ইত্যাদি।
ডিভিশন ৩: প্রসাধনী সামগ্রী (যেমন ক্যান্থারাইডিন তেল), গৃহস্থালির জন্য ন্যাপথালিন বল, অগুরু, বাথরুম পরিষ্কারের সামগ্রী ইত্যাদি।
মাঝে দীর্ঘদিন পরিচালনার ব্যর্থতা, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার পরিকল্পনার অভাব এবং অন্যান্য নানা কারণে গুণগত উৎকর্ষতা থাকা সত্ত্বেও বেঙ্গল কেমিকাল ক্রমশ রুগ্ন হতে থাকে এবং ঋণজালে ডুবে যায়।
এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ঔষাধি গাছপালার বাগান ও অনেকগুলি ঘোড়া ছিল। ঘোড়ার রক্ত থেকে সাপের বিষের ঔষধ, ধনুষ্টঙ্কারের প্রতিষেধক, কুকুরে কামড়ানোর প্রতিষেধক (এভিএস, এটিএস ও এআরভি) তৈরি হতো। এগুলি প্রত্যেকটিই জীবনদায়ী ওষুধ। সরকারি নীতি-পঙ্গুতায় দেশে বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এসব গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের উৎপাদন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রায় সবক’টি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, বা কয়েকটি দক্ষিন ভারতের কতিপয় কোম্পানি তৈরি করে।
তবে বিগত তিন-চার বছরে সংস্থাটি আবার ছয় দশকের ব্যর্থতার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৭-১৮ সালে ১০ কোটি টাকা ও ২০১৮-১৯ সালে ২৫ কোটি টাকা লাভের মুখ দেখেছে—এই দুই বছরে যথাক্রমে ২৮ কোটি ও ১৮ কোটি টাকা ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করার পর। পরিচালকরা বলেছেন, ২০২২সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি সম্পুর্ণ ঋণমুক্ত হবে—প্রায় ১১১ কোটি টাকার ঘাটতি মিটিয়ে।
বিপুল সম্ভাবনাময় এই সংস্থাকে পুনরুজ্জীবনে কোনো সাহায্য না করে ২০১৭ সালে ক্যাবিনেট কমিটি কোম্পানিটির হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ জমি বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর বিরুদ্ধে কর্মচারীরা হাইকোর্টে যান, এবং বিচারপতি শ্রী দেবাংশু বসাকের এজলাস এই জমি বিক্রির ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে সরকার ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে—সেই মামলা এখনো বিচারাধীন। তা সত্ত্বেও এ বছর জুলাই মাসে মোদি সরকার আবার এই লাভজনক জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে সমস্ত জমি সহ (প্রায় ২৫০০ একর) বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সঙ্গে বিলগ্নিকরণ করা হবে হিন্দুস্থান অ্যান্টিবায়োটিকস, দেশের সমস্ত প্রতিরক্ষা কারখানা, বিমানবন্দরগুলি, রেলপথ ও বন্দর, ইস্পাত কারখানা, বিএসএনএল সহ অনেকগুলি নবরত্ন সংস্থা। জনগণের অর্থ শ্রমে গড়ে ওঠা গত ৭০ বছরের সব সম্পদ কার্যত জলের দরে আদানি-আম্বানিদের হস্তগত করাই এই সরকারের উদ্দেশ্য। বিলগ্নিকরণের প্রাথমিক তালিকায় আছে ৪২ টি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা।
ট্রাম্প সাহেবের দয়ায় সেই বিস্মৃত বাঙালি সংস্থা, দুয়োরানীর ছেলে বেঙ্গল কেমিক্যালের নাম আজ বহু মানুষের মুখে। প্রথম জাতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠা এই জাতীয় সংস্থাটি যদি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেত, স্বাধীন ভারতে গবেষণা ও উন্নতি অব্যাহত থাক্ত তাহলে শ্রী অজিতাভ বচ্চনের কোম্পানী ইপকা অমবা সসুইস অধিজাতিক সংস্থা ক্যাডিলার বদলে বেঙ্গল কেমিক্যাল ই এইসব ওষুধের প্রধান উৎপাদক হত। দেশের মানুষো বাঁচতেন, বহু লোকের কর্মসংস্থান হোত এবং জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি দেওয়া দুটি বহুমূল্য ডলারও অর্জন করা যেত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে তথাকথিত মিশ্র অর্থনীতির নামে দেশী শিল্পকে ধ্বংস করা, উন্নতি হতে না দেওয়া এবং বিদেশী বহুজাতিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা আমাদের দেশের সরকারের নীতি। তাই এই দুর্যোগের সময়ও ক্যাডিলা, ইপকার মালিকদের হাসি আরো চওড়া হচ্ছে আর গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন জাতীয় সংস্থা।
হাইড্রোস্কিক্লোরোকুনাইন কি বেঙ্গল কেমিক্যাল এর আবিষ্কার?
No