লকডাউনের পর প্রায় একমাস হতে চললো। দরিদ্র মানুষের দুর্দশার নতুন নতুন ছবি চোখের সামনে ভেসে আসছে। নানা সামাজিক সংগঠন, কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল, বামপন্থী যুবক-যুবতীরা সাধারণ মানুষের কাছে সাধ্যমত ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। রাজ্য সরকার একাধিকবার বলেছে যে, এ রাজ্যে কোন ভুখা মানুষ থাকবে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন রাজনীতি করবেন না। সব মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর মানবিক মুখ দেখে তাঁকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন । অথচ মাস গড়াতেই মানুষের সামনে যে ছবি ফুটে উঠছে তা হতাশাজনক। সরকারী রেশনের খাদ্যশস্য যে প্যাকেটে দেওয়া হচ্ছে তার উপর শাসকদলের ছাপ্পা মারা। অনেকে এমনও অভিযোগ করেছেন যে কলকাতা পুর এলাকায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের পুর প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে শাসকদলের কর্মীদের মাধ্যমে রেশন বিলি করা হচ্ছে। এর বিপরীতে বামপন্থী নানা সংগঠন, ব্যক্তি ও এমনকি রাজনৈতিক দলগুলি যে সব খাদ্যশস্য নিয়ে মানুষের দরবারে হাজির হয়েছে তাঁরা কোন রকম রাজনৈতিক ভাষ্য ছাড়াই সেগুলি নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
ধ্বংসাত্মক রাজনীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় শাসকদলের সংখ্যালঘু নীতি। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের যে রিপোর্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে জমা দিয়েছে সেখানে আলাদা করে তাবলীগ-এর ঘটনার হিসেব আলাদা করে উল্লেখ করেছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী “তাবলীগ ক্লাস্টার”-এর পর থেকে কোভিডের সমস্যা তৈরী হয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী লক ডাউনের পর যে অবস্থা ছিল তা এই ক্লাস্টার না থাকলে দেশে এত পজিটিভ কেস থাকতো না। তাদের ন্যারেটিভ সত্য প্রমাণ করার জন্য কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম মিথ্যা খবর প্রচার করে তুলেছে। চাপে পড়ে মিথ্যা খবরের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আবার নতুন নতুন মিথ্যার পসরা খুলে বসছে। বস্তুত অন্য দেশের উদাহরণ দিয়ে সহজেই দেখানো যায় যে কোভিডের পুরো চক্র পরিণত হতে প্রায় ১২ সপ্তাহ সময় লাগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ভারত সরকারের আচরণের নিন্দা করেছে।
এই রাজ্য সরকার যেন কেন্দ্রের প্রচারকে সত্য করে তুলতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে। কলকাতার কয়েকটি সংখ্যালঘু এলাকা নিয়ে রাজ্য জুড়ে যে অপপ্রচার চলছে তার বিরুদ্ধে তার ভূমিকা অত্যন্ত নিন্দনীয়। লকডাউন রাখার জন্য যে কার্যকরী ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার তার বিন্দুমাত্র সেখানে দেখা যাচ্ছে না। বেলগাছিয়া বস্তি এর জ্বলন্ত উদাহরণ– এখানে মানুষ অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও সবার কাছে আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠছে। এর আশু ফল হিসেবে কোভিডেও ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
লকডাউন নিয়ে সরকারের ধারণার অস্বচ্ছতার আরেকটি প্রমাণ হল প্রয়োজনীয় পরীক্ষার অভাব। সরকার যে পরামর্শদাতা কমিটি তৈরী করেছে সেখানে কোনো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই। তার ফলে সরকারের সিদ্ধান্তগুলিও দিশাহীন। লকডাউনের ফলে সংক্রমণের গতি বিলম্বিত হয়। এর ফলে যে সময় পাওয়া যায় সেই সময়ের সঠিক সদ্ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন ক্লাস্টার খুঁজে বার করা। একের পর এক এলাকা ধরে গণ-পরীক্ষা না করলে লকডাউন কার্যকরী হবে না। অথচ, সরকারের সেদিকে কোনো নজর নেই।
সরকারের এই দ্বিধাগ্রস্ততার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসাকর্মীরা। সরকারী তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে সারা দেশে যে পজিটিভ কেস পাওয়া গেছে তা মোট পরীক্ষার ৪.২%। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই হার অনেক বেশি, প্রায় ৬%। প্রতিদিন যে নতুন নতুন রোগী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে মোট পরীক্ষার নিরিখেও তা অত্যন্ত বেশি। এ রাজ্যে ১২ এপ্রিলে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ শতাংশ । ১৩ এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ালো ৭.০২%, যা সারা দেশের মধ্যে নজিরবিহীন। এই তথ্য থেকে দুটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। প্রথমত, খুব কম পরিমাণ টেস্টের জন্য ফলাফলে গরমিল হতে পারে (small sample size) অন্যথায় সত্যি সত্যি পশ্চিমবঙ্গ করোনার হট স্পট। আসল কারণ যাই হোক না কেন ইতিমধ্যে কুড়িজন চিকিৎসাকর্মী এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ও মেডিকেল কলেজসহ পাঁচটি হাসপাতালের এক বা একাধিক ওয়ার্ড বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এর মধ্যে আছে বাংলা তথা পুরো এশিয়া মহাদেশের গর্বের প্রতিষ্ঠান কলকাতা মেডিকেল কলেজ। হাওড়া হাসপাতালের ঘটনাটি এর মধ্যে খুব চমকপ্রদ। সেখানে একজন রোগিনীর শরীরে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রকাশ করার পরও হাসপাতাল সুপার তাঁকে জোর করে আইসিইউ-তে ভর্তি করেন। পরে রোগিনীর মৃত্যু হয়। ঐ আইসিইউ-তে তখন আরো দশজন রোগী ছিলেন। কোন রকম পিপিই ছাড়াই কর্মরত চিকিৎসক ও সেবিকারা তাঁর চিকিৎসা করেন। পরে ঐ হাসপাতাল সুপার নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি হন। এমনকি করণায় আক্রান্ত হয়ে বাঙুর হাসপাতলেই মৃত্যু হয় হাওড়া জেলা হাসপাতালের এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর।এসব ঘটনার মূল কারণগুলি খোঁজা যেতে পারে-
১) গোষ্ঠী সংক্রমণ নির্ণয় করার জন্য প্রচুর পরীক্ষা করা দরকার। মহামারি শুরুর সময় মনে করা হয়েছিল যে শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। এই রাজ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই ঝুঁকির শিকার। তাদের মধ্যে থেকে গোষ্ঠী সংক্রমণ খুঁজে বের করার জন্য যে স্যাম্পল সাইজ হওয়া দরকার তা বিশেষজ্ঞরা অঙ্ক কষে বলে দিতে পারেন।
রাজ্যে স্বাস্থ্য প্রশাসনে প্রচুর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আছেন, এমনকি ব্লক স্তর পর্যন্ত তাঁদের বিস্তার। এই রাজ্যে একটি প্রাচীন ও বহুমান্য জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান আছে (AIIPH)। কোন অজানা কারণে সরকার এই সব বিশেষজ্ঞদের নস্যাৎ করে দিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরী করেছে। সে কমিটিতে কোন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই। যে সব মরসুমের জন্য উপযোগী চিকিৎসকদের সমাহার সেখানে হয়েছে তাদের মতামতও মরশুমি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
২) কোভিড নির্ণয়ের জন্য একটি সর্বজনীন প্রটোকল স্থির করা দরকার ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে প্রটোকল আছে তা সরকার না মানতে চাইলে উপযুক্ত প্রটোকল বানানো যেতে পারে। সে প্রটোকলের মুখ্য বিবেচ্য হওয়া উচিত ঝুঁকিপূর্ণ সব মানুষের পরীক্ষা। ঝুঁকিপূর্ণ বলতে কি বোঝায় তার সংজ্ঞা আগে থেকেই স্থির করা আছে।
৩) সব তথ্য স্বচ্ছতার সাথে প্রকাশ করা উচিত। সরকার যে হিসাব দিচ্ছেন তাতে প্রচুর গরমিল আছে। মোট যতজন আক্রান্ত হয়েছেন, যতজন চিকিৎসার পর রোগমুক্ত বা মৃত বলে ঘোষণা হয়েছে তার বাইরে ৩৭ জন রোগীর কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এই রোগীরা মৃত। সরকার তাঁদের কোভিডের শিকার বলে মানতে চাইছে না। সরকারের বক্তব্য হল এঁরা কোভিডের জন্য নয়, মারা গেছেন কো-মরবিডিটির জন্য। কোভিডে মৃত্যুর ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞাটি আলোচনা করা যেতে পারে। তাঁরা বলেছেন যে কোন রোগী যদি করোনায় আক্রান্ত হন ও মারা যান এবং সংক্রমণ ও মৃত্যুর মধ্যে কোন উপসর্গহীন সুস্থতার লক্ষণ ৪৮ ঘন্টার কম হয় তাহলে সে মৃত্যু করোনা সংক্রমণজনিত বলে ভাবতে হবে। এই সংজ্ঞা সরকার পাল্টে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরী করেছেন। তাদের জাদুতে ৩৭ জন মানুষ পুরোপুরি নিখোঁজ। যদি সব হিসাব ঠিকমতো করা হয় তাহলে প্রমাণ হবে যে এই রাজ্য করোনা সংক্রমণ আটকাতে সীমাহীন ভুল ও নির্বুদ্ধিতা দেখিয়েছে ও আদতে এই রাজ্য সংক্রমণের আঁতুড়ঘর হতে চলেছে।
এখন অবশ্য কে দোষী তা নির্ণয় করার সময় নয়। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে অবস্থা সামলাতে সরকারের অবিলম্বে যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত
১) প্রতি মিলিয়নে ১৫০০০ পরীক্ষার ব্যবস্থা।
২) সব ধরনের জ্বর, সর্দি কাশি ও ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত নতুন রোগীদের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
৩) স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য সরকারী ও বেসরকারী নির্বিশেষে সব ধরনের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পিপিই সরবরাহ করা।
৪) মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা।
৫) বাড়ীতে বাড়ীতে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া।
৬) হটস্পট ক্লাস্টারগুলি চিহ্নিত করে লক করা।
৭) অবিলম্বে চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জাম ক্রয় করা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করা।