কেউ কেউ কুকুর – বেড়াল ইত্যাদি পশু ভালোবাসেন। কেউ কেউ ভালোবাসেন না। কেউ কেউ আবার এই বিষয়ে উদাসীন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কুকুর – বেড়াল পশুরা এবং / অথবা তাদের প্রতি প্রীতি যখন অন্যের বা অন্যদের অথবা কোন পরিবারের বা অনেক পরিবারের অথবা সাধারণ মানুষ থেকে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত মুলত শ্রমজীবী মানুষদের যাদের কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় অথবা নিরীহ পথচারীদের কিংবা সমাজের সমস্যা ও বিপদ হয়ে দাঁড়ায় তখনই বিপত্তি।
আমরা জানি যে কোন সভ্য দেশে এবং সমাজে পথ কুকুর – বেড়াল ইত্যাদি রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো ও মলমূত্র ত্যাগ করার কথা নয়। কুকুর – বেড়ালের লালা থেকে ১০০ শতাংশ মারণঘাতী জলাতঙ্ক (Rabies) রোগ হতে পারে। এছাড়াও কুকুর – বেড়ালের লালা, লোম, মলমূত্র, দেহে থাকা পরজীবী প্রভৃতি থেকে নানারকম অ্যালারজি, শ্বাস কষ্টের রোগ, আন্ত্রিক রোগ, চর্ম রোগ, কৃমির রোগ প্রভৃতি হয়।
Leptospirosis, Bovine TB, Scabies, Hydatid Cyst প্রভৃতি রোগ এবং Noroviruses, Paturella, Salmonella, Brucella, Yersinia enterocolytica, Campylobacter, Capnocytophaga, Bordetella bronchiseptica, Coxiella burnetti, Staphylococcus intermedius, Methicillin resistant staphylococcus aureus, Sarcoptic mange, Tinea corporis প্রভৃতির সংক্রমণ হতে পারে।
২০১১ এর সেন্সাস অনুযায়ী ভারতে কুকরের সংখ্যা ছিল সেইসময় প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে ৮০ % পথ কুকুর। কুকুর ও মানুষের অনুপাত ছিল ১/৩৬।
আমরা এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় পশুদের মধ্যে কুকুর দের নিয়ে সমস্যা এবং তার প্রতিকার নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবো।
বিপদ গুলি কি কি?
১) কুকুরের তাড়া ও কামড়ঃ আগেই বলা হয়েছে যে আমাদের দেশে গ্রামে শহরে সর্বত্র প্রচুর পথ কুকুর ঘুরে বেড়ায়। অপরিচিত কেউ সেখানে এসে পড়লে অথবা পরিচিত কেউ খুব কাছে এসে পড়লে অনেক সময় বিপদ ভেবে কামড়ে দেয়। বিশেষ করে শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশে সরু গলিতে অথবা রাস্তার ধারে বা ফুটপাথে পথ আটকে শুয়ে থাকে বা ঘুমোয়। তখন তাদের অতিক্রম করে চলাফেরা করা খুব দুরূহ হয়ে ওঠে। অনেক সময় দল বেঁধে আগন্তুক বা পথচারীদের আক্রমণ করে। অনেকসময় গাড়ি, স্কুটার, সাইকেল আরোহীদের আক্রমণ করে। সেক্ষেত্রে কামড়ের পাশাপাশি দুর্ঘটনাও ঘটে। আমাদের রাজ্যে তো আছেই, কেরল থেকে দিল্লি থেকে অসম পথ কুকুরের আক্রমণের ভুরি ভুরি আভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা বেশি ভুক্তভোগী হন। কিছুদিন আগেই আমদাবাদের এক শিল্পপতি এবং দিল্লিতে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী পথকুকুরের দ্বারা সাঙ্ঘাতিকভাবে আক্রান্ত হন। ঐ শিল্পপতি মারাও যান। এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন আদালত এমনকি দেশের শীর্ষ আদালত একের পর এক নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। কিন্তু দুনিয়ার তথাকথিত এই বৃহত্তম গণতন্ত্রে এগুলি মেনে চলার ক্ষেত্রে মহামান্য নাগরিক, সরকার এবং পুরসভাদের আশানুরূপ কোন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা দেখা যায় না।
পথ কুকুররা সাধারণত একটি এলাকার মধ্যে বিচরণ করলেও খাদ্যের অভাবে বা স্থানাভাবে বা অন্য কুকুরের তাড়া খেয়ে অথবা ঋতুর (Mating) কারণে সঙ্গিনীর খোঁজে বা পুরুষ কুকুরদের আক্রমণ থেকে অব্যহতি পেতে অন্যত্র উপস্থিত হয়। সেই সময় তারা আতঙ্কগ্রস্ত বা উত্তেজিত থাকার কারণে কাছাকাছি কেউ চলে এলে অনেকসময় কামড়ে দেয়। আবার ঋতুর সময় প্রায়শই তারা পথের মধ্যে দলবদ্ধভাবে যৌনক্রিয়া করে এবং পুরুষ কুকুর গুলির মধ্যে কলহ ও যুদ্ধ চলতে থাকে। সেইসময় তাদের মেজাজও ক্রুদ্ধ থাকে। পথচারী বা আগন্তুকের কাছাকাছি চলে এসে অনেকসময় কামড়ে দেয়। পথ কুকুররা পথেই সন্তান প্রসব করে। শাবকরাও পথের মধ্যে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। তাদের কাছাকাছি কেউ চলে এলে মা কুকুর অনেকসময় বাচ্চার বিপদ আশঙ্কা করে কামড়ে দেয়। এছাড়াও নানা কারণে কুকুরের কামড় ঘটতে পারে।
২) পথ কুকুরদের দ্বারা পরিবেশ দূষণ ও দুর্ঘটনাঃ পথ কুকুররা পথে থাকে। ওখানেই খায়, ছড়ায়, মুখে করে এটা ওটা নিয়ে আসে। মল মুত্র ত্যাগ করে। অসুস্থ হলে শ্লেশ্বা, বমি ইত্যাদি ত্যাগ করে। পথেই বিশ্রাম করে, ঘুমোয়, খেলে, দৌড়াদৌড়ি করে। ধুলো ময়লা মাখে, ছড়ায়। লোম ছড়ায়। সবচাইতে দূষণ হয় যত্রতত্র করে রাখা মলমূত্র থেকে। এগুলি থেকে অনেক রোগ ব্যাধি হয় এবং এই দূষণ ও সংক্রমণ গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে বা শুয়ে থাকার কারণে কিংবা হঠাৎ করে দৌড়ে সামনে চলে আসায় ভারসাম্য হারিয়ে আনেকসময় স্কুটার, টোটো, অটো প্রভৃতি ছোট গাড়িগুলির দুর্ঘটনার কারণ হয়।
৩) পোষা কুকুরের কামড় ও দূষণঃ অনেকে কুকুর পোষেন। তাদের মধ্য্যে খুব কম সংখ্যক পুরসভায় লাইসেন্স করিয়ে, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে ও টিকা দিয়ে, ঠিকমত প্রশিক্ষণ দিয়ে যত্ন করে পোষেন। অনেকক্ষেত্রেই কুকুরের আলাদা থাকার জায়গা (Kennel) বা চলাফেরার মত স্থান থাকেনা। ফলে পথ কুকুরের ক্ষেত্রে রোগ ও দূষণ সহ যে বিপদ ও সমস্যাগুলি থাকে এক্ষেত্রেও থাকে। আমাদের দেশে ঘিঞ্জি জনবসতিগুলিতে এমনিতেই স্থানাভাব, মানুষের থাকারই পর্যাপ্ত জায়গা নেই, তাই কুকুরদের ছেড়ে রাখা হয়। ঘরেবাইরে করা ওই কুকুরগুলি রোগ ও দূষণকেও ঘরেবাইরে করে এবং প্রতিবেশী থেকে পথচারী সকলের বিপদ ও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ধনী ও শিক্ষিত ব্যাক্তিও বাড়ির কুকুর বাইরে জনপথে নিয়ে গিয়ে মলমুত্র ত্যাগ করিয়ে পরিবেশ দূষণ ও সমাজের ক্ষতি করেন।
অনেক কুকুর প্রেমিক পথ কুকুরদের নিজ গৃহে বা কোন আশ্রয়স্থলে (Dog Pound) রেখে যত্নআত্তি না করে রাস্তার মধ্যেই তাদের যত্নআত্তি করেন ও খাবার দিয়ে অপরের অসুবিধা ও দূষণের সৃষ্টি করেন। এদের মধ্যে কিছু অত্যুৎসাহীদের দেখা যায় আরও নজর কাড়তে এটিএম, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন প্রভৃতি জনবহুল জায়গায় খাবার বিলি করতে যেখানে প্রচুর সারমেয় জড়ো হয়ে উপভোক্তা ও যাত্রীদের প্রবল সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেকে শখ করে নামী বিদেশী কুকুরের দামী শাবক কিনে পুষতে শুরু করে পরে সামলে উঠতে পারেননা অথবা কুকুররা বৃদ্ধ বা অসুস্থ হলে আর দায়িত্ব নেন না। আমাদের দেশে সহজ সমাধান পথে ছেড়ে দেওয়া। দিল্লি সহ বিভিন্ন শহরে পথে ছেড়ে দেওয়া একদা পোষা এই কুকুরগুলি রীতিমত বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই ছেড়ে রাখা হিংস্র বড় চেহারার শিকারি বা পাহারাদার কুকুরগুলি বহু মানুষকে কামড়িয়েছে।
৪) পথ কুকুরদের নিজেদের সমস্যাঃ এদের থাকার কোন জায়গা নেই, খাবারের ব্যাবস্থা নেই। যেখানে সেখানে কষ্ট করে থাকে, ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। আবর্জনা ঘেঁটে খায়। নোংরা জল পান করে। কথায় কথায় মানুষজন প্রহার করে, অন্য কুকুররা আক্রমণ করে। প্রবল গরম, বৃষ্টি ও শীতে খুব কষ্ট পায়। অসুখ হলে চিকিৎসা নেই, বয়স হলে কোন দেখভাল নেই। রাস্তায় মরে পড়ে থাকে। ঋতুমতী হলেই নারী কুকুরকে পুরুষ কুকুরদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে হয়। রাস্তায় প্রসব করতে হয়। খাদ্য, বাসস্থান, যত্ন ও চিকিৎসার অভাবে অনেক শাবক মারা যায়, অনেক শাবক রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়।
৫) জলাতঙ্ক ও অন্যান্য রোগের বিপদঃ আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে বেশ কিছু মারাত্মক ব্যাধি এবং ক্রনিক ব্যাধি কুকুরের কামড়, আঁচড়, লালা, লোম, মল মুত্র থেকে হয়। এর মধ্যে সবচাইতে সাঙ্ঘাতিক জলাতঙ্ক (Rabies)যার কোন চিকিৎসা নেই এবং যার থেকে মৃত্যু অবধারিত। প্রতি বছর ৫০০০০ – ৬০০০০ মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যান, যার মধ্যে অর্ধেক ভারতে। প্রায় ২৫০০০ – ৩০০০০। প্রতি দুই সেকেন্ডে ভারতে একজন মানুষ আক্রান্ত হয় কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে। আক্রান্তদের বেশিরভাগের বয়স ১৫ বছরের নিচে। প্রতিদিন ভারতে ২৪ জন মানুষ জলাতঙ্কে মারা যান। তথাপি জলাতঙ্ক Neglected Tropical Disease এবং Notifiable Disease নয়। প্রতি বছর জলাতঙ্কের টিকার জন্যে ভারত সরকারের ২০১১ সালেই খরচ হতো ১৩৬০ কোটি টাকা।
কিছু আন্তর্জাতিক উদ্যোগঃ
জল জলাতঙ্কের প্রাকৃতিক বাধা (Natural Barrier)। তাই অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ইউনাইটেড কিংডম, আয়ারল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, ফিজি, সাইপ্রাস, মাল্টা প্রভৃতি এবং ভারতের লাক্ষাদ্বীপ ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ছাড়াও সঠিক বিধিব্যাবস্থার মাধ্যমে সুইডেন, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি জলাতঙ্কমুক্ত (Rabies Free) অঞ্চল। এখানে গুটিকয় যে রোগী পাওয়া গেছে তারা বাইরে থেকে সংক্রমিত হয়ে এসেছিলেন। সঠিক বিধিব্যাবস্থার মাধ্যমে বেলজিয়াম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চিন, হংকং, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আমীরশাহী, বাহারিন, বুলগেরিয়া, বেলরুশ, চিলে, হাঙ্গেরি, লাতভিয়া, স্লোভাকিয়া প্রভৃতি জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রিত (Rabies Controlled) দেশ। বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের (১৮২২ – ১৮৯৫) মৃত্যু দিবস ২৮ সেপ্টেম্বর কে আন্তর্জাতিক জলাতঙ্ক দিবস (World Rabies Day) হিসেবে পালন করা হয়।
কুকুরের কামড়ের কারণে জলাতঙ্ক রোগে মানুষের মৃত্যু ২০৩০ এর মধ্যে রোধ করার জন্যে আন্তর্জাতিক স্তরে ‘ গ্লোবাল স্ট্রাটেজিক প্ল্যান ‘ তৈরি হয়েছে যার উদ্দেশ্যঃ (১) সমূহ পদ্ধতিকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করে কুকুর থেকে মানুষে জলাতঙ্কের সংক্রমণ এবং তদজনিত মৃত্যু রোধ। (২) প্রমাণ নির্ভর চিকিৎসা প্রণালী অবলম্বন। (৩) কর্মসূচিগুলি কার্যকর করতে স্থানীয় স্তরে বিবিধ অংশীদারি সংস্থাকে যুক্ত করা।
কিছু জাতীয় উদ্যোগঃ
২০১৩ থেকে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (NRCP)শুরু হয়। এর লক্ষ্য ছিলঃ (১) বিনামূল্যে জলাতঙ্কের প্রতিষেধক ইম্যুনোগ্লোবিন ও টিকা সরবরাহ। (২) জন্তুর কামড়ের চিকিৎসা, জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির সমন্বয়। (৩) জন্তুর কামড়ের উপর নজরদারি বৃদ্ধি এবং জলাতঙ্কে মৃত্যুর রিপোর্ট। (৪) জলাতঙ্কের প্রতিরোধ বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতাকে দূর করা।
পরবর্তীতে কেন্দ্র সরকারের মৎস্য, প্রাণীজ সম্পদ ও দুগ্ধজাত বিষয়ক মন্ত্রক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর ২০৩০ এর মধ্যে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলকরণের লক্ষ্যে ‘National Action Plan For Dog Mediated Rabies Elimination (NAPRE)’ গ্রহণ করেছেন। সেই মোতাবেক কেন্দ্র সরকার ‘Animal Birth Control Rules, 2023’ জারি করেছেন। পথ কুকুরদের (Stray Dogs) জনসংখ্যা কমানো ও ব্যাবস্থাপনা এই কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্যবস্তু। দেশের প্রতিটি পুরনিগম, পুরসভা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও গ্রাম পঞ্ছায়েত পথ কুকুরদের জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্কের প্রতিষেধক প্রদানের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন করবে। পথ কুকুর নিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্ক প্রতিরোধে শীর্ষ আদালতেরও একাধিক নির্দেশ রয়েছে।
রাজধানী দিল্লি সহ বিভিন্ন শহরে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হিংস্র বিপজ্জনক বিদেশি কুকুরের ক্রমবর্ধমান কামড়ের কারণে কেন্দ্র সরকার প্রাণীজ সম্পদ ও দুগ্ধজাত বিষয়ক মন্ত্রক এর মাধ্যমে গত ১৭ মার্চ ২০২৪ থেকে বোরবল, ক্যানারিও, রাশিয়ান শেফার্ড ডগ, উলফ ডগ, আমেরিকান পিট বুল, বুল ডগ, মাস্টিফ, রটঅয়েলার, টেরিয়ার প্রমুখ ২৩ টি বিদেশি বিপজ্জনক কুকুর আমদানি, প্রজনন ও বিক্রির উপর নিসেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
কুকুর কামড়ালে তৎক্ষণাৎ কি করণীয়?
(১) সাবান জল দিয়ে, সবচাইতে ভালো জোরালো কলের জলে (Running Tap Water) এ ২০ মিনিট ধরে ক্ষতস্থান ধোয়া। (২) তারপর ক্ষতস্থানে স্পিরিট বা পভিডিন আয়োডিন লাগানো। (৩) নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালের ইমারজেন্সি তে দেখানো।
ইঁদুর, ছুঁচো, কাঠবেড়ালি প্রভৃতির কামড়ে কি করণীয়ঃ
সাধারণত গৃহ(Domestic)ও গৃহ সংলগ্ন (Peri – Domestic) এই ছোট প্রাণীগুলির কামড় থেকে জলাতঙ্ক হয়েছে রিপোর্ট পাওয়া যায় নি। কিন্তু এই নিয়ে নজরদারি তথ্য ও গবেষণা যেহেতু এখন অবধি সীমিত ও অসম্পূর্ণ এবং এগুলিও গরম রক্তের প্রাণী (Warm Blooded Animals), অন্যদিকে জলাতঙ্ক প্রায় ১০০ শতাংশ মারণঘাতী, তাই টিটে্নাস টক্সয়েড এর পাশাপাশি জলাতঙ্কের টিকা নেওয়া উচিত। মেঠো ইঁদুর (Rat), বনে থাকা এই ধরনের প্রাণীদের (Wild Animals) কামড়ের ক্ষেত্রে জলাতঙ্কের টিকা নিতেই হবে।
জলাতঙ্ক সম্পর্কে প্রাথমিক কয়েকটি কথাঃ
বুলেট আকৃতির রাইবোনিক্লিক অ্যাসিড যুক্ত লিসা ভাইরাস টাইপ ১ (Lyssavirus type 1) এই রোগের জন্যে দায়ী। এই প্রাণঘাতী ভাইরাস রোগাক্রান্ত প্রাণীর লালার মধ্যে থাকে এবং কামড় ও আঁচড়ের মধ্যে অপরের দেহে প্রবেশ করে। মানুষের জলাতঙ্কের শতকরা ৯৯ ভাগ হয় রোগাক্রান্ত কুকুরের কামড় ও আঁচড় থেকে। এছাড়াও রোগাক্রান্ত বিড়াল, ভাম, বাঁদর, হনুমান, বেজি, শেয়াল, হাইনা, নেকড়ে, বুনো কুকুর (Dhole), বাদুর (প্রধানত লাতিন আমেরিকায়) ইত্যাদির কামড় আঁচড় থেকে হতে পারে। একটি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুর তার রোগের পর্যায়ে ৪০ কিমি পর্যন্ত ঘুরে অনেক মানুষকে কামড়াতে পারে।
কোন ব্যাক্তির কেটে বা ছড়ে যাওয়া চামড়ায় বা মিউকাস মেমব্রেনে কোন রোগাক্রান্ত কুকুর বা অন্য পশু কামড়ে বা চেটে বা আঁচড়ে (এরা নখ চাটে এবং নখে লালা লাগে) দিলে কিংবা কামড়ে আঁচড়ে ক্ষত সৃষ্টি করলে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারে বায়ুতে থাকা কণার (Aerosol)মাধ্যমে অথবা জলাতঙ্ক আক্রান্ত বাদুরের গুহায় প্রশ্বাসের মাধ্যমে কিংবা জলাতঙ্ক আক্রান্ত ব্যাক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে (উদাহরণ, Cornea Transplant) জলাতঙ্ক হতে পারে।
মানুষের দেহে রোগটির সুপ্তিকাল (Incubation Period) কামড় বা আঁচড়ের দিন থেকে তিন থেকে আট সপ্তাহ। কিন্তু চারদিন থেকে বেশ কয়েক বছর অবধি হতে পারে। যদি ক্ষত গভীর, অনেকগুলি, মাথা মুখ ঘাড় হাতের মধ্যে হয় অথবা রোগাক্রান্ত হিংস্র বন্য জন্তু কামড়ায় তাহলে রোগের সুপ্তিকাল খুব কম সময়ের হয়। প্রাণ বাঁচাতে কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবস্থা নিতে হয়।
জলাতঙ্ক রোগের লিসা ভাইরাস কামড়, আঁচড়, লালার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যাক্তির ক্ষতের মধ্যে প্রবেশ করে আশপাশের মাংস পেশি ও কানেক্টিভ টিস্যুগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বংশ বৃদ্ধি করে নিকটবর্তী প্রান্তিক স্নায়ু গুলির (Nerve Endings) সাথে যুক্ত হয়। তারপর স্নায়ু ধরে প্রতিদিন ২৫০ মিলিমিটারের মত উঠে আসতে আসতে সুসুন্মা কান্ডের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রে (Central Nervous System) পৌঁছয়। পরে সেখান থেকে লালাগ্রন্থি ও অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
মানুষ রোগাক্রান্ত হলে প্রথম তিন চারদিন জ্বর, গা হাত পা ব্যাথা, কামড়ের জায়গা ব্যাথা ও ঝিনঝিন করা ইত্যাদি হয়। ক্রমে মাংসপেশিগুলি অসাড় হয়ে আসে। তখন জল পান করতে গেলে বা গায়ে হাওয়া লাগলে খিঁচুনির মত হয় ও দম বন্ধ হয়ে আসে (Hydrophobia, Aerophobia)।এই জন্যে জলাতঙ্ক নামকরণ। জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে রোগীদের সাধারণত দুরকম আচরণ দেখা যায়। (১) উত্তেজনাপূর্ণ আচরণ (৮০%, Encephalitic Rabies) এবং (২) সাড়হীন আচরণ (২০%, Paralytic Rabies)। প্রথম ক্ষেত্রে স্নায়ু উত্তেজনা, খিঁচুনি, ভুল বকা, লালা পড়া, জল দেখলে আতঙ্ক, হাওয়া লাগলে প্রবল কাঁপুনি ইত্যাদি দেখা যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মাংসপেশিগুলি শিথিল ও অবশ হয়ে পড়ে। জলাতঙ্ক রোগী রোগের লক্ষণ প্রকাশের তিন থেকে ছয়দিনের মধ্যে মারা যায়।
জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসাঃ জলাতঙ্ক ১০০ শতাংশ মারণঘাতী রোগ। এর নেই কোন ওষুধ, নেই কোন চিকিৎসা। সাময়িক কিছু উপশম দেওয়া যায় মাত্র। তাই জলাতঙ্ক প্রতিরোধের উপর জোর দিতে হবে।
জলাতঙ্ক প্রতিরোধঃ
(১) কুকুর নিয়ন্ত্রণঃ
জনস্বার্থে জন্মনিয়ন্ত্রণ, জলাতঙ্কের টিকাকরণ ও ডগ পাউন্ডে রাখার ব্যাবস্থা করে পথকুকুরদের প্রথমে নিয়ন্ত্রণ, তারপর সমাজ থেকে নির্মূল করতে হবে। গৃহপালিত কুকুরদেরও জলাতঙ্কের টিকাকরণ করে এবং গৃহসংলগ্ন এলাকার (House Compound) অথবা খামার বাড়ির (Farm House) মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। গৃহপালিত কুকুরদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্সের ব্যাবস্থা করতে হবে। পুর মহানিগম, পুরসভা, পঞ্ছায়েত এবং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলিকে এগুলি কার্যকর করার দায়িত্ব নিতে হবে।
(২) আপৎকালীন চিকিৎসাঃ
এক নম্বর বিষয়টি সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়া অবধি শহরে প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল এবং আরবান হেলথ ক্লিনিক এবং গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি গ্রামীণ হাসপাতাল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রে টিকা ও ইম্যুনোগ্লোবিন সহ কুকুর কামড়ের আপৎকালীন চিকিৎসার ব্যাবস্থা রাখতে হবে। ক্ষতস্থান কামড় আঁচড়ের সঙ্গে সঙ্গে বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রানিং জলে ২০ মিনিট অথবা সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। তারপর ক্ষতস্থানে স্পিরিট বা পভিডিন আয়োডিন লাগাতে হবে। সেলাই না করা উচিত। কেননা বাড়তি ক্ষত ভাইরাসগুলির স্নায়ুর দিকে গমনকে সাহায্য করে। প্রয়োজনে চাপ ব্যানডেজ করা যেতে পারে। টিটানাস টিকাকরণের প্রমাণ না পেলে ইঞ্জেকশান টিটানাস টক্সয়ড দিতে হবে।
(৩) জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের টিকাকরণঃ
(ক) কুকুর কামড়ানো আঁচড়ানোর পরে নেওয়া টিকাকরণ (Post-exposure Prophylactic Vaccination):
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কামড় পরবর্তী প্রতিষেধক হিসাবে চামড়ার মধ্যে (Intradermal বা ID)জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা (Anti Rabies Vaccine বা ARV) দেওয়ার পক্ষে। এটি নিরাপদ, কার্যকর, কম পরিমাণে লাগে এবং টিকা সঙ্কটের আবহে অনেকখানি টিকা ও অর্থ সাশ্রয় হয়। প্রতি ডোজে মাত্র ০.১ মিলিলিটার টিকা লাগে। কামড়ের পর ০, ৩, ৭ ও ২৮ তম দিনে (২ – ২ – ২ – ০ – ২) প্রথম তিনদিন দুটি করে ডোজ শরীরের দুটি স্থানে (উদাহরন, বাহু ও ঊরু) এবং চতুর্থ দিন শরীরের একটি স্থানে দিতে হয়। চামড়ার মধ্যে ডেনড্রাইটিক কোষ, লসিকা কলা (Lymph Tissue), টি সেলের উপস্থিতিতে প্রতিষেধক অ্যান্টিজেন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
মাংসপেশিতে (Intramascular বা IM) দেওয়া জলাতঙ্কের টিকা এক মিলিলিটার ০, ৩, ৭, ১৪ ও ২৮ তম দিনে দিতে হয়। জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকার সাথে হিউম্যান রেবিজ ইম্যুনোগ্লোবিন (Human Rabies Immunoglobulin বা HRIG)২০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট প্রতি কিলোগ্রাম ওজন হিসাবে কামড়ের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতস্থান বা স্থানগুলির চারদিকে ইঞ্জেকশান এর মাধ্যমে দিতে হবে। এটি দেওয়ার আগে চামড়ায় পরীক্ষা (Skin Test) করে দেখতে হবে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা। HRIG, Equine Rabies Immunoglobulin বা ERIG এর থেকে বেশি নিরাপদ।
১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে লুই পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা (Nerve Tissue Vaccine) আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন ধরনের টিকার মধ্যে Cell Culture Vaccine এখন ব্যাবহ্রিত হয়। এর মধ্যে Human Diploid Cell Vaccine, Purified Chick Embryo Cell Vaccine এবং Purified Verocell Vaccine এর ব্যাবহার বেশি। জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা দিলে গা হাত পা ব্যাথা, অল্প জ্বর আসা ছাড়া কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। সব বয়সের ডোজ এক। গর্ভাবস্থায়, স্তন্যদানের এবং এইচ আই ভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার কোন বারণ নেই।
জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুর কামড়ালে গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, শুয়োর, গাধা, উট, ঘোড়া যে কোন গৃহ পালিত উষ্ণ রক্তের প্রাণীর জলাতঙ্ক হতে পারে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত গরু ইত্যাদির দুধ ফুটিয়ে খেলে অসুবিধা নেই। অন্যথায় বিপদ আছে।
(খ) কুকুর কামড়ানো আঁচড়ানোর ঝুঁকির কারণে আগে থাকতে নেওয়া টিকাকরণ (Pre-exposure Prophylactic Vaccination):
যে সমস্ত গবেষক পরীক্ষাগারে Rabies Virus নিয়ে কাজ করেন, সেখানকার সাফাই কর্মীরা অথবা যারা বন কর্মী বা চিড়িয়াখানার কর্মী অথবা যারা পশু প্রশিক্ষক, পশুর দেখাশোনা করেন বা পশু চিকিৎসক অথবা যাদের জলাতঙ্ক প্রাদুর্ভাবপূর্ণ অঞ্চলে বেড়াতে বা অন্য কারণে যেতে হবে তাদের জন্যে আগাম টিকাকরণের (Pre-exposure Prophylactic Vaccination) ব্যাবস্থা আছে। সেইক্ষেত্রে Cell Culture Vaccine দেওয়া হয় D0, D7, D21, অথবা D28 এ, চামড়ার মধ্যে (ID) বা মাংসপেশিতে (IM)। Booster Dose প্রতি দু বছর অন্তর নিতে হয়।
(গ) আগে টিকা নেওয়া থাকা সত্ত্বেও আবার আক্রান্ত হবার পরে নেওয়া টিকাকরণ (Re-exposure Prophylactic Vaccination):
কেউ যদি আগে জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকার পুরো কোর্স নিয়ে থাকেন এবং তার পরে তাকে কুকুর কামড়ায় বা আঁচড়ায় তাহলে তাকে জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকার দুটি ডোজ নিলেই হয় (Re-exposure Prophylactic Vaccination)। প্রথম (D0) ও তৃতীয় দিনে (D3)। ক্ষতর সংখ্যা বেশি হলে বা ক্ষত গভীর হলে তৃতীয় ডোজও (D7) দিতে হবে। এক্ষেত্রে ইম্যুনোগ্লোবিন দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু পূর্ববর্তী টিকাকরণ যদি অসম্পূর্ণ বা সন্দেহজনক হয় তাহলে নতুন কেস ধরে সম্পূর্ণ টিকাকরণ করতে হবে।
কাদের টিকা দেবো? আর কাদের টিকা ও ইম্যুনোগ্লোবিন দেব?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির নির্দেশিকা অনুযায়ী কামড়কে এবং কামড়ের চিকিৎসাকে (Post-exposure Prophylaxis) শ্রেণিবদ্ধ (Categorization) করা হয়েছেঃ
(১) Category I সন্দেহজনক প্রাণীর ছোঁয়া বা লালা লেগে গেলেও চামড়ার স্তরে কোন ক্ষত সৃষ্টি না হলে। এক্ষেত্রে ভালো করে সাবান দিয়ে জায়গাটা ধুয়ে ফেলতে হবে।
(২) Category II কুকুরের কামড়ে বা আঁচড়ে চামড়া সামান্য ছড়ে গেলে এবং রক্তক্ষরণ না হলে দ্রুত টিকাকরণ শুরু করতে হবে।
(৩) Category III কুকুরের এক বা একাধিক কামড়ে অথবা / এবং আঁচড়ে চামড়া ভেদ করে এক বা একাধিক ক্ষত সৃষ্টি হলে, তার সাথে রক্ত বের হলে এবং ক্ষত যুক্ত চামড়ায় বা অঙ্গে কুকুরের লালা লাগলে এবং বাদুরের দ্বারা আক্রান্ত হলে পুরো কোর্স টিকার সাথে ইম্যুনোগ্লোবিন দিতে হবে।
আহ্বানঃ আসুন পথ কুকুর মুক্ত করে, গৃহপালিত কুকুর – বেড়ালদের টিকা করণ সম্পূর্ণ করে আমাদের রাজ্য ও দেশটিকে জলাতঙ্ক মুক্ত রাজ্য ও দেশে পরিণত করি।
০২.০৪.২০২৪
কৃতজ্ঞতাঃ কুকুর, সাপ ও অন্যান্য কামড় এবং তাদের চিকিৎসা – সম্পাদনাঃ অরণি সেন & স্নিগ্ধা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন’।
খুব সুন্দর লেখা। মানুষের কাজে লাগবে।