(১)
চলুন একটু ঘুরে আসি। ভাবছেন কোথায়? না, না। একদম চিন্তা করবেন না। আমরা এখন স্মৃতি পথে মানসযাত্রা করবো। একেবারে হাল আমলের কচিকাঁচাদের বাদ দিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ষাটোর্ধ্ব মানুষজনের কাছে এই যাত্রা যে খুব স্মৃতিমেদুরতায় ভরা এক চনমনে আনন্দের পথচলা হবে তা আমি গোড়াতেই হলফ করে বলতে পারি।
গরমের ছুটি পড়েছে স্কুলে। মধ্যাহ্ন ভোজনের পাট চুকিয়ে বাড়ির সবাই একটু নিদ্রালস হয়েছেন। মায়ের কোলঘেঁষে বল্টু পল্টু ছোটন টোটনের দল সবাই শুয়ে আছে। শান্ত, শব্দহীন দুপুর বেলা। হঠাৎ পাড়ার গলিপথের স্তব্ধতার আড় ভেঙে টঙ টঙ করে মৃদু ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসে। বিছানায় শুয়ে থাকা মানবকরা তখন আর ঝন্টু মন্টু নয়। তারা তখন প্রদোষ মিত্তির কিংবা প্রখর রুদ্র। সতর্ক সারমেয়র মতো সবারই কানদুটো বিলকুল খাড়া। দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু ঘন্টার আওয়াজ এখন অনেকটাই স্পষ্ট। সেই শব্দ কর্ণপথে প্রবেশ করেই আকুল করিল সব প্রাণ। সবাই উতল হয়ে উঠেছে এক অজানা প্রত্যাশায়। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া মাকে আলতো ধাক্কা মেরে তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলা –
মা, দু আনা পয়সা দেবে? বুড়ির চুল খাব। মিঠাই কাকু এ পাড়ায় অনেক দিন পর এসেছে। তুমি ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? দাওনা মা।
ঘুম জড়ানো চোখে মা হয়তো বললেন -দেরাজের বাঁ দিকের ড্রয়ারে রাখা আছে। বেশি নিবিনা যেন।
বল্টু পল্টু ছোটন টোটনের তখন তুরীয় অবস্থা। আলিবাবার মতো অপ্রত্যাশিত খাজানার সন্ধান পেয়ে তাদের তখন প্রবল তুর্কী নাচন। সদর দরজার আগল খুলে দে ছুট, দে ছুট সেই ঘন্টা বাজিয়ের স্বপ্নের পশরা চেখে দেখার জন্য।
(২)
কি! অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল তো? খুব স্বাভাবিক। আজ থেকে পাঁচ – সাড়ে পাঁচ দশক আগে এমনই ছিল কিশোর কিশোরীদের সুলভ মনোহরণের আয়োজন। তবে এসব নিয়ে কথা বলতে আজ খাতা খুলে বসিনি। আজ কথা বলবো ফাঁকি মিঠাই তথা বুড়ির চুল তথা কটন বল ক্যান্ডির ফাঁক ফোকর নিয়ে।
এক হৈচৈ ফেলে দেওয়া খবর এসেছে সুদূর দক্ষিণ ভারতের পুদুচেরী থেকে। খুব সম্প্রতি পুদুচেরী সরকার এক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাদের রাজ্যে বুড়ির চুল বা ফাঁকি মিঠাইয়ের বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জলে ঢিল ছুড়লে যেমন জল নড়েচড়ে উঠে ঢেউ তুলে পাশের জলকে আলোড়িত করে ঠিক সেভাবেই একে একে ছড়িয়ে পড়েছে পাশের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে।আর তাই পুদুচেরীর পথে হেঁটে তামিলনাড়ু সরকারও রাজ্যে কটন বল ক্যান্ডির বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন থেকে ঐ দুই দক্ষিণী প্রদেশে আমাদের ছোট বেলার বহু আনন্দময় স্মৃতি বিজড়িত মিঠাইয়ের উৎপাদন ও বিক্রি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে বলা হয়েছে। কেন এমন ফরমান?
কোথায় ঘটল বিচ্যূতি? সরকারের পক্ষ থেকে অধ্যাদেশ জারি করতে গিয়ে তামিলনাড়ুর মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এম সুব্রহ্মণ্যিয়াম জানিয়েছেন -“রাজ্যে কটন বল ক্যান্ডির উৎপাদন ও বিক্রি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে এই জনপ্রিয় মনোলোভা মিঠাইয়ের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ রোডোমাইন – বি মেশানো হচ্ছে বিপদজ্জনক পরিমাণে যা শরীরের পক্ষে হানিকর। এই নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে কটন বল ক্যান্ডির প্রস্তুতকারীরা, বিপণনকারী ভেণ্ডাররা এবং সর্বোপরি কটন বল ক্যান্ডির উপভোক্তারা সচেতন হবে বলেই আমার স্থির বিশ্বাস।”
(৩)
রোডোমাইন বা রোডামিন-বি। আজকের আসামি। এই পদার্থটি সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নেওয়া যাক্। রোডামিন-বি (RhB) একটি রাসায়নিক যৌগ যার বহুল ব্যবহার প্রধানত বস্ত্রবয়ন শিল্পে। রঞ্জক পদার্থ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত হওয়ায় রোডামিন-বি এই রাসায়নিক যৌগটি সিল্ক, পাট, চামড়া, উল ও সুতো রঙ করার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য রঞ্জক পদার্থের তুলনায় রোডামিন অনেকটাই সস্তা, ফলে প্রসাধনসামগ্রী তৈরিতে এবং রঙিন প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদনেও এই রঞ্জক পদার্থের সাহায্য নেওয়া হয়। এহেন এক গুরুত্বপূর্ণ ও সুলভ রঞ্জক পদার্থ মুনাফালোভী অসচেতন খাদ্য প্রস্তুতকারীদের দৌলতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে গোবি মাঞ্চুরিয়ান, লঙ্কার গুঁড়ো, চিলি চিকেন, সস ও কটন বল ক্যান্ডির মতো মুখরোচক প্রস্তুতিতে। বিপদ এখানেই। কেন এই আশঙ্কিত উদ্বেগ? এখন তার খোঁজ করি ।
(৪)
গবেষণা সূত্রে জানা গিয়েছে যে রোডামিন-বি মানুষের শরীরের পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরে এই রঞ্জক পদার্থের সংস্পর্শে এলে চামড়ার অসুখ, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, চোখের সংক্রমণ থেকে শুরু করে কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হয় , রোডামিন বাড়ায় পেটে টিউমার সৃষ্টির ঝুঁকি। পাশাপাশি রোডামিনের প্রভাবে
ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা তৈরি হয়। যদিও এই বিষয়ে বিজ্ঞানী মহলে মত মতদ্বৈধতা রয়েছে।
আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষজনের মধ্যেও রঙদার খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হবার প্রবণতা রয়েছে। এই দুর্বলতা বিষয়ে খাদ্যপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো বিলক্ষণ অবগত। তাই উপভোক্তাদের – শরীর স্বাস্থ্য সুস্থতার – তোয়াক্কা না করেই কেবলমাত্র খাদ্যদ্রব্যকে ক্রেতাদের নজরে দেখনদার করে তুলতে রোডামিন-বি এর মতো বিপদজ্জনক রাসায়নিক রঞ্জক পদার্থ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কটন বল ক্যান্ডির মতো জনপ্রিয় শিশুখাদ্যে। মনে রাখতে হবে যে কোনো অবস্থায়ই এটি খাবারদাবারে মেশানো যাবেনা। অথচ তাই করা হচ্ছে ।
বিশিষ্ট চিকিৎসক ও আ্যাপোলো হাসপাতাল, চেন্নাইয়ের অঙ্কোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট প্রসাদ ঈশ্বরণ এই বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, বহুদিন ধরেই তাঁরা রোডামিন-বি এর বিপদ প্রসঙ্গে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছেন। এতোদিন পরে সরকারের টনক নড়েছে। দেরিতে হলেও যে শেষপর্যন্ত খাদ্যে বিষক্রিয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। পুদুচেরী সরকার সর্বপ্রথম মৌচাকে ঢিল ছোড়ে। এরপর একে একে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং এখন অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারও রোডামিন-বি এর অপব্যবহার সম্পর্কে উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চলেছে। বাজার থেকে কটন বল ক্যান্ডির পাশাপাশি অন্যান্য রঙিন খাবারের নমুনা সংগ্রহ করে যাচাই করে দেখা হচ্ছে মানুষের শরীরে এই রাসায়নিক যৌগটি কী প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসার নামে এমন কাণ্ড কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।
আরও এক গবেষিকা শ্রীমতী মিনাক্ষী এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “গবেষণায় জানা গিয়েছে যে রোডামিন- বি মানব কোশের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এই রাসায়নিক যৌগটিকে ব্যবহার করা হলে তা সেরিবেলাম টিস্যু এবং ব্রেনস্টেমের ক্ষতি করতে পারে।”
(৫)
শুরু করেছিলাম অনেকটাই পেছনে ফেলে আসা শৈশবের এক নির্ভেজাল (?) আনন্দের রোমাঞ্চকর কাহিনী দিয়ে। এখন প্রবীণ শরীরে বাসা বেঁধেছে হরেক উপসর্গ। রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টিমণ্ডার রসাস্বাদনেও বঞ্চিত করি নিজেকে। তাতে আক্ষেপ নেই, কিন্তু যখন দেখি এ কালের কচিকাঁচারা আমাদেরই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য অনেক অনেক সহজ আনন্দের থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তখন হতাশা জাগে বৈকি!
এমনটা নিশ্চয়ই নয় যে কেবলমাত্র দক্ষিণী রাজ্যগুলোতেই যথেচ্ছভাবে ক্ষতিকর রোডামিন-বি ব্যবহার করা হচ্ছে। আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত বিপুলা এই ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা জনপদের অগণিত শিশু কিশোর কিশোরী কোনো এক মধ্যাহ্ন বেলায় হয়তো বা আজও উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে বুড়ির চুল বা মুখে দিলে নিমেষে গলে যাওয়া ফাঁকি মিঠাইয়ের জন্য। তাদের আনন্দকে ভবিষ্যতে যেন আর রোডামিনের বিষে বিষিয়ে না তুলি। আমাদের রাজ্য কবে সচেতন হবে?
** এই রচনাটি প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
গুরুচণ্ডা৯-ওয়েব ম্যাগাজিনে ১৮ই মার্চ, ২০২৪ প্রকাশিত।