“গণশত্রু” ছবিটা হয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে। তখন আমরা সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছি, ডাক্তার হয়ে উঠতে তখনো ঢের দেরি! সেখানে এক আদর্শবাদী ডাক্তারকে সমাজের চোখে কিভাবে শত্রু বানানো হয়েছিল আমাদের মনে আছে।
মাঝের বছরগুলিতে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বেশ কিছু অপ্রার্থিত বদল এসেছে রোগী-চিকিৎসক পারস্পরিক সম্পর্কে, বিশেষত অতি সাম্প্রতিক কালে। যার দায়ভাগ চিকিৎসক বা রোগী আলাদা ভাবে কারোই নয়! তাঁরা দুজনেই এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে অসহায় ক্রীড়নক মাত্র!
এই প্রেক্ষিতে তেত্রিশ বছর পরের পৃথিবীতে হাতে এলো এক আশ্চর্য উপন্যাস, অক্ষরসিদ্ধ সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর “গণমিত্র”।
মিথ্যা-না-বলতে-কি এতো অস্বস্তিকর উপন্যাস আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে না! এটা বই না আয়না মাঝে মাঝে ধন্দ্বে পড়তে হয়েছে।
স্বপ্নময় হলেন সেই বিরল শ্রেণীর লেখক যিনি নিজের ভাষা খুঁজে পেয়েছেন প্রথম থেকেই! আর তাঁর প্রতিযোগী একমাত্র তিনি নিজেই।
আমার বরাবরই মনে হয়েছে বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যকে মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আনন্দ পান লেখক।
তাঁর লেখায় একটা ছিয়াশির মারাদোনা সুলভ ব্যাপার আছে, যেখানে পায়ে ফুটবল নয়, হাতে কলম নিয়ে পাতা জুড়ে যা খুশি তাই করা যায়!
এই ব্যাপারটা প্রায় একটা পিশাচসিদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন স্বপ্নময় অবলীলায় লেখেন “এই এরিয়ায় মাসে দুলাখ টাকার বিক্রি না-দেখাতে পারলে আমার চাকরি থাকবে না, প্লিজ স্যর…ছেলেটার চোখ দু’টো থেকে যেন দু’টো হাত বেড়িয়ে এসেছে, সেই হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বাটি।”
অথবা, “আমাশার কারণে বায়ুসৃষ্ট হলে একরকম গন্ধ হয়, কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে অন্য গন্ধ…বাতকর্মের শব্দও নানা রকমের হয়। উচ্চকিত, তাড়িত, কম্পিত, বিনীত, স্তিমিত …রোগীকে তো বলা যায় না, একটু পাদো তো দেখি …যে গ্যাস ছাড়লে নিজেকে খুনির মত লাগে, সেটা এইচ-টু-এস …গন্ধক ঘটিত গ্যাস। ডিমের প্রোটিন চেন-এ সালফার লেগে থাকে।”
অথবা, “… ফাঁকি দেবে না…প্রসেসটা শুরু হয়ে গেলে আস্তে আস্তে বাড়বে। একটা ‘সেল’এর কথা ভাবো না কেন? প্রাণী কোষ। অ্যামিনো অ্যাসিড বেসড নির্জীব মলিকিউলটার মধ্যে একটা রহস্য ঢুকে যায়, যেটার নাম ‘প্রাণ’, সেলটা বাড়তে থাকে, ডিভিশন হয়। সেই রহস্যটার নাম ‘ইচ্ছে’। বুঝলে না, ইচ্ছে ইচ্ছে …মার্কারি দেখেছ? মার্কারি গুঁড়োগুলো কাছাকাছি এলে জুড়ে যায়। ইচ্ছের মতো। আমার ইচ্ছেটাও জুড়ে দিলাম বুঝলে?”
বহুস্তরীয় এই উপন্যাসের চলন নন-লিনিয়ার। যেন ইচ্ছে মত উইং বদল করেছেন লেখক। ফর্ম নিয়ে খেলেছেন।
প্রথম পুরুষ থেকে উত্তম পুরুষে গিয়ে ফের ফিরে এসেছেন প্রথম পুরুষে।
উপন্যাসটির একস্তরে আছে একটি চিকিৎসক পরিবারের দ্বন্দ্বময় আখ্যান, আদর্শের এবং প্রজন্মের সংঘাত। আবার অন্যস্তরে সমাজের একেবারে প্রান্তিক মানুষদের ঘামের গন্ধ! চোখ নাক জ্বালা করতে থাকে অনুভবী পাঠকের।
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গণমিত্র সমকালীন বাংলা সাহিত্যে একটি মেধাবী সংযোজন।
পুস্তক প্রকাশনা একটি শিল্প, সব অর্থেই। এমন অসচরাচর বইখানির উপস্থাপনা এতটা মধ্যমেধামাখা গতানুগতিক না হয়ে, আর একটু রুচিসম্মত, উন্নত আর যুগোপযোগী হয়ে, সার্বিকভাবে প্রকাশনার মান বাড়ালে কিন্তু ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক সংস্থাটিরই সম্মান বাড়ত!
পরবর্তী সংস্করণে তাঁরা আরো যত্নবান হবেন আশা করব।
গণমিত্র
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
মিত্র ও ঘোষ
প্রথম প্রকাশ : পৌষ ১৪২৮
তিনশো টাকা
মাননীয়েষু, আপনি আপনার মূল্যবান এবং ব্যস্ত সময় থেকে এই বইটির জন্য যে অংশ ব্যয় করেছেন তার জন্য মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করেই অনুরোধ জানাচ্ছি যদি সম্ভব হয় বইটির ঠিক কোন কোন জায়গায় মেধা, গতানুগতিকতা, রুচি এবং যুগোপযোগিতায় খামতি আছে যদি নির্দেশ করেন, পরবর্তী সংস্করণে সেই খামতিগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন। নমস্কার নেবেন।