“…কেন জানি না যাঁরা দেহ বেচে রোজগার করেন আর যাঁরা বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা অর্জন করেন তাঁদের একটা মিল আমাকে ভারি বিস্মিত করে। এঁরা সবাই নিজের নিজের ফি নিজে নিজে নির্ধারণ করেন। কী সোনাগাছির খুপরি বা ফ্ল্যাট, কী নামী ডাক্তার-উকিল-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষকদের চেম্বার বা কোচিং। একই ডিগ্রিধারী অথচ, অবোধ্য মাপকাঠিতে এঁরা যার যার বিক্রয়মূল্য নিজেরাই ঠিক করে নিজেদেরকে বাজারজাত করেন। আর সে প্রক্রিয়ার গরমিলটা এত তীব্র যে চোখে লাগে।…”
বইয়ের নাম হাসপাতালের জার্নাল (এক)। এক, সুতরাং দুই তিন ইত্যাদি ক্রমে আসবে আশা করা যায়।
লেখক আমার অতি প্রিয় মানুষ। অরুণাচল দত্ত চৌধুরী। মূলত কবি। কিন্তু অসামান্য গদ্য লেখেন। অবশ্য কবিরা সাধারণত তা-ই। ভাস্কর চক্রবর্তী কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ অথবা জয় গোস্বামী – মাঝেমধ্যে মনে হয়, কবিতা দিয়ে শুরু না করলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যও এমনটি হতো না – কবির গদ্য অন্যস্বাদের। ভিন্ন মাত্রার। অরুণাচল দত্ত চৌধুরীরও তাই।
মাঝেমধ্যে তাঁকে বলি, দ্যাখো, সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে, তুমি গদ্যকার। এত কবিতা লিখে কোনও পুরস্কার পেলে না, কিন্তু একখানা গদ্য লেখার জন্য একেবারে সাসপেন্ড হয়ে গেলে। আবার এমন সাসপেন্ড, যা হাজার মিটিং-মিছিল করেও কিচ্ছুটি করতে পারলাম না। রিটায়ার করার সময় একেবারে কালিম্পং পাঠিয়ে সরকার সাসপেনশন তুলল আর পেনশন দিল সাসপেনশনের আগেকার মাইনের ভিত্তিতে (মানে অনেক কম)। এর চাইতে বড় স্বীকৃতি আর কী-ই বা হতে পারে!! একেবারে আগমার্কা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। (এই বইয়ের প্রথম লেখাটাই সেই ‘সরকারি স্বীকৃতি’-প্রাপ্ত গদ্য।)
এসব কথা তাঁকেই বলা যায়। আশ্চর্য ক্লেদহীন নিষ্কলুষ মানুষ তিনি। সহজ সরল। সাসপেনশনের দিনে কমে-যাওয়া মাইনে নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখিনি। এখন কম পেনশন নিয়েও নয়। কিছু বললেই হাসিমুখে বলেন, আমি অত কোর্ট-হাইকোর্ট দৌড়াতে পারি না। যা পাচ্ছি, চলে তো যাচ্ছে…
তো এমন মানুষই লিখতে পারেন – “…প্রাইভেট হাসপাতালের ব্যাপারটা ব্যবসা। মুখে বললেও… না বললেও। ডাক্তারি ব্যাপারটাই আসলে ব্যবসা। এক সময় ছাত্র ভাবত সে চিকিৎসা বিজ্ঞানী হবে। পাশ করার পর ভাবত চিকিৎসা বৃত্তিধারী হবে। আজ সে পাকেচক্রে সাফল্য পেয়েছে। সে আজ চিকিৎসা ব্যবসায়ী। যেমন আইন ব্যবসায়ী, অস্ত্র ব্যবসায়ী ইত্যাদি।
চিকিৎসা যখন ব্যবসা আর চিকিৎসা ব্যবস্থাটা ব্যবসায়ীদের হাতে, তখন লাভক্ষতির হিসেবটাই বড়। মানবিকতা জিনিসটা খায় না মাথায় দেয় ব্যবসা করতে গেলে মনে রাখলে চলে না। বিশেষ করে ব্যবসা যখন কর্পোরেট। সেখানে স্বচ্ছতার অবকাশ নেই। ঘোলা জলেই লাভের মাছ ধরার সুবিধে।
কমিউনিকশন না থাকার কথা উঠেছে। ডাক্তারির কথা ছেড়ে অন্য কথা বলি।
বলুন দেখি উকিল ব্যারিস্টাররা শামলা পরে বিশাল কালো প্রজাপতি সেজে আদালতের আনাচে কানাচে ওড়াউড়ি করে কেন, এমনকি আমাদের মতো গরমের দেশেও? স্রেফ ইউনিফর্ম দেখিয়ে সম্ভাব্য মক্কেলদের থেকে একটা কাল্পনিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য, যাতে ঘাবড়ে দেওয়া যায়… আচমকা উঁচু দর বলতে কোনো অসুবিধে না হয়।
ডাক্তারিতেও তেমনই। ব্যবসার খাতিরেই কমিউনিকেশনটা কমিয়ে রাখা।…
খেয়াল করে দেখবেন, হসপিটাল, হসপিটালিটি, শব্দগুলি একই উৎস থেকে আগত।… যিনি হোটেল না খুলে হাসপাতাল খুলেছেন, বুঝতে হবে তিনি যথেষ্ট বুঝে শুনে লাভের কড়ির হিসেব করেই তো করেছেন। এই সহজ সত্যিটা ভুলে যাওয়ার ন্যাকামির সত্যি কোনো মানে হয় না।
সরকারি হাসপাতাল কি ব্যবসার বাইরে? সমস্ত চিকিৎসা ফ্রিয়ের নামে গুচ্ছের রুগীকে মেঝেতে শুইয়ে কম সংখ্যার ডাক্তার আর তার চাইতেও কম নার্সিং স্টাফ দিয়ে ভোটব্যবসা জিইয়ে রাখা, এটা ব্যবসা না? সমস্ত চিকিৎসা পরিষেবা ফ্রিয়ের নামে আল্ট্রাসোনোগ্রাফির ডেট পড়ছে আট ন’ মাস বাদে। টিকিট কাটার লাইনে এক ঘণ্টা, ডাক্তারের ঘরের সামনে লাইনে এক ঘণ্টা আর ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎকার দেড় থেকে দু’মিনিট, এই হেনস্থার মাঝে কমিউনিকেশন… সে কোথায়? ডাক্তার যাঁর তথাকথিত বিবেক আছেও ধরে নিলাম, তাঁকে কিন্তু একটানা দেখে যেতে হবে দেড়শ বা দু’শ… হয়ত তারও বেশি মানুষকে, ভোট ব্যবসায়ীদের ভাষায় এইলিং হিউম্যানিটিকে।…”
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হয়ে গেল। কারণ দুটো।
এক, অরুণাচল দত্ত চৌধুরীর গদ্যের স্বাদ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।
আর দুই, এই কথাগুলো, এমন সহজ করে, এত অকপটে কাউকে বলতে দেখিনি। বললেও, এমন সুখপাঠ্য গদ্যে তো নয়ই। কাজেই এসব নিয়ে নিজের ভাষায় বোকাবোকা হ্যাজ নামানোর চাইতে অরুণাচলদার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়াই ভালো।
হ্যাঁ, অকপট। সিস্টেমের গলদ তো দেখিয়েছেনই, সঙ্গে আঙুল তুলেছেন নিজের দিকেও। নিজেদের দিকেও। সিস্টেমের শিকার ডাক্তাররা তো অবশ্যই, কিন্তু শুধু সেটুকু বললে অর্ধসত্য বলা হয়। অরুণাচল দত্ত চৌধুরী অর্ধসত্যে বিশ্বাসী নন। তাই অকপটে বলেন –
“…আর যাঁদের মানে যে ডাক্তারবাবুদের চোখের চামড়া নেই? সরকারি হাসপাতাল তাঁদের মৃগয়াক্ষেত্র। সম্ভাব্য হরিণশাবকগণ তথা আরোগ্যকামীকে চেম্বারের চাঁদমারিতে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। এই মেধাবী শয়তানদের রুখবে কে?… করদাতার টাকার এই নয়ছয় ভোটব্যবসায়ীরা জানেন না বললে মানতে হবে?… সকালে দাঁত মাজার পরই টিপছাপ দিয়ে ট্রেনে চেপে প্র্যাকটিস করতে চলে যান অন্য শহরে, আবার রাত ন’টায় বাড়ি ফেরার পথে টিপছাপ, এমন উদাহরণও বিরল নয়। কাজেই সরকারি হাসপাতাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক জায়গা, যেখানে ভয় নাই (আসলে যথেষ্টই ভয় আছে), ভরসাও নাই।
বেসরকারি, কর্পোরেট অথবা অকর্পোরেট যে হাসপাতাল, সেখানে মালিক পক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে চলেন অতি আজ্ঞাবহ এই মেধাবী চিকিৎসককুল।… করুন, তাঁরা রোজগার করতে থাকুন। কিন্তু মাথা নীচু করে এই নৈরাজ্য যা কিনা ওভারবিলিং, ফলস স্টেটমেন্ট ইত্যাদি তাঁরা মেনে নেন অম্লানবদনে, এটাই ভারি আশ্চর্যের।… ”
বইটা পড়ুন। স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে এমন অকপট সত্যভাষণ, ব্যবস্থার দোষগুণ নিয়ে এমন ব্যক্তিগত গদ্য আগে পড়েননি নিশ্চিত।
ব্যক্তিগত গদ্য। কেননা, নিজের কর্মজীবন, নিজের ডাক্তারি পড়া, জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম, হস্টেলজীবনের স্মৃতি – তার মধ্যেই এসেছে এমন অকপট কথাগুলো। আর এমন আলগোছে এসে পড়া বলেই কথাগুলোর অভিঘাত এমন তীব্র। এমন তীক্ষ্ণ।
আবার চিকিৎসকের অসহায়তার কাহিনীও রয়েছে। ওয়ার্ডে। রোগীর চাপে নাজেহাল অবস্থায়। আদালতে হুজুর-ধর্মাবতারদের সবজান্তা হোলিয়ার-দ্যান-দাউ বোলচালের সামনে।
সুদৃশ্য বইটির প্রকাশক প্রণতি প্রকাশনী। দাম, মাত্র আশি টাকা। ছাড় দিয়ে আরও কম।
খামতি বলতে, জার্নাল যেহেতু, লেখাগুলোয় তারিখের উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। এবং কিছু লেখায় প্রেক্ষিতের সংক্ষিপ্ত উল্লেখও। যেমন, ‘মেডিকেলের র্যাগিং’ লেখাটি যে মেডিকেল কলেজের হস্টেল আন্দোলন ও তৎকালীন অধ্যক্ষের নক্কারজনক ভূমিকার প্রেক্ষিতে লেখা, সেটা সবাই না-ও বুঝতে পারেন। আর, ছোটখাটো বেশ কিছু ছাপার ভুল।
তারপরও বলি, বইটি চিকিৎসক-অচিকিৎসক সবারই পড়ে দেখা উচিত। অবশ্যই উচিত।
পাঠক হিসেবে আমি হাসপাতালের জার্নাল (দুই)-এর অপেক্ষায়।