চাষের কাজ চলছে। তার উপর পয়লা বৈশাখের উদযাপন। চেম্বারে বিশেষ ভিড় নেই। সামান্য জ্বর জ্বালা ছাড়া মনে রাখার মত রোগীও বিশেষ নেই। এরই মাঝে মাঝবয়েসী এক ভদ্রমহিলা এলেন চেম্বারে। স্বামী ও পুত্র কোনোমতে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে এসেই রোগী দেখা বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আর শোয়ানোর সাথেসাথেই শুরু হলো বিপত্তি। ভদ্রমহিলা তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই ওয়াক ওয়াক করতে শুরু করলেন। চেম্বারের ডাস্টবিনটা মুখের কাছে ধরতেই গলগল করে খানিক জল বমি করে নেতিয়ে পড়লেন। তবে লক্ষ্যণীয় ভাবে, শুয়ে না পড়ে বসেই রইলেন। আমি কোনো মতে বমি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে গোল গোল চোখ করে জিজ্ঞেস করলাম, হয়েছেটা কি?
আজ সকাল বেলা ঘুম থেকে যেই না উঠেছে, তখন থেকেই ভয়ংকর ভাবে মাথা ঘোরাচ্ছে। সাথে নিরন্তর বমি। পয়লা বোশেখের বাজারে গতকাল রাত্রে মাটন আর খান দশেক লুচি ছাড়া আর কিচ্ছুটি খায়নি স্যার। সকালে এমন দেখে গ্যাসের ওষুধ খাইয়েছি। বমি কমানোর ওষুধও দিয়েছি। কমেনি।
অবশেষে পাড়ার ডাক্তারকে ডেকেছি। তিনিও বলেছেন তীব্র গ্যাস জমে মাথা ঘোরাচ্ছে। গ্যাসের ইঞ্জেকশন আর বমির ইঞ্জেকশনও দিয়েছেন উনি। কিন্তু কি জ্বালা বলুন তো! কমছে তো নাইই, বরং যেন বেড়েই চলেছে। প্রথম দিকে বমির সাথে রাতের খাবারগুলো উঠছিলো। এখন শুধুই জল উঠছে স্যার।
এতক্ষণ কথাগুলো বলার পর দম নিয়ে অসহায় চোখে তাকালেন ভদ্রলোক। পরনের কাপড়ও বমির জলে ভেজা।
প্রথমত: ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়েছে মাথাঘোরানো, সাথে বমি।
দ্বিতীয়ত: ভদ্রমহিলাকে ডানদিকে পাশ ফিরিয়ে শোয়ানোর সাথে সাথে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বমি।
বি.পি.পি.ভি নয় তো?
ভদ্রমহিলার কাছে উঠে গিয়ে ডিক্স হলপাইক পদ্ধতি অনুযায়ী ডান দিকে ঘাড় কাত করে যেই না শোয়াতে গেছি, অমনি লাফিয়ে উঠলেন ভদ্রমহিলা। মাথা ঘোরাচ্ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে বলে ওয়াক ওয়াক করতে শুরু করলেন। ভাগ্যিস, এ যাত্রায় আর বমি হলো না। তবে চোখের মণির থরথরানি চোখ এড়ালো না আমার। এবার শুরু হলো পরের পর্বের পরীক্ষা। এবার ঘাড়টিকে বাম দিকে কাত করে যেই না পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে শুইয়ে দিলাম, অমনি দেখলাম সব ঠান্ডা। আর মাথা ঘোরাচ্ছে না। কিছুক্ষণ এভাবে রেখে এবার পুরো শরীর টিকে বামদিকে আরও পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বেঁকিয়ে শুইয়ে রাখলাম। আধা মিনিট রাখার পর তড়িঘড়ি পা ছড়িয়ে বসিয়ে দিয়ে সামনের দিকে ঘাড় নামিয়ে দিলাম যাতে থুতনি বুকে লেগে থাকে।
আমার কর্মকাণ্ড দেখে ভদ্রমহিলার ছেলে কিছু একটা বলতে চাইছিলো। হাত নেড়ে আপাততঃ থামিয়ে পূনরায় একই পদ্ধতিতে প্রথমে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে বামদিকে ঘাড় কাত করে আমার হাতের উপর উনার মাথাটি রেখে বিছানার প্রান্তে মাথাটি ঝুলিয়ে রাখলাম। আধা মিনিট রেখে বামদিকে পুরো শরীর পাশ ফিরিয়ে আরও পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কাত করলাম ঘাড়।এভাবে আরও তিরিশ সেকেন্ড রেখে তারপর পা ছড়িয়ে দ্রুত বসিয়ে দিয়ে ঘাড় নুইয়ে রাখলাম মিনিট খানেক।
এবার জিজ্ঞেস করলাম, কেমন বোধ করছেন?
বার দশেক বমি করে ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, বেশ ভালো লাগছে ডাক্তারবাবু।
ভদ্রমহিলার ছেলে ততক্ষণে মোবাইলে ভিডিও করতে শুরু করেছে। ওকে বাধা না দিয়েই বললাম, যেটা ভিডিও করেছো, সেই পদ্ধতিতেই এই কৌশলে ব্যায়াম করালেই কমে যাবে।
আর গ্যাসের ব্যাপারটা কি করা যাবে ডাক্তারবাবু? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলার স্বামী।
আশ্বস্ত করে বললাম, গ্যাস,অ্যাসিডের জন্য হয়ইনি। এই রোগের পোশাকী নাম “বিনাইন প্যারোক্সিজমাল পসিশানাল ভার্টাইগো”, সংক্ষেপে বি. পি. পি. ভি.।
কানের অন্তরে তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার ক্যানেলের মধ্যে থাকা তরলের অবস্থানের হঠাৎ তারতম্যে এই ঘটনা ঘটে। এই তিনটি ক্যানেলই আমাদের ব্যালেন্স রক্ষা করে। শুয়ে থাকাকালীন হঠাৎ উঠে বসলে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়াও মেইনার’স ডিজিজ, ল্যাবাইরিন্থাইটিসের মতো কঠিন রোগেও ঘটতে পারে।
ডায়াগনোসিস, ডিক্স হলপাইক পদ্ধতি অনুযায়ী। আর প্রাথমিক চিকিৎসা এপলি’স কৌশল। যা কিনা এক্ষুনি করলাম। পরবর্তী রোগনির্ণয়ের জন্য নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
ভদ্রমহিলা খানিক সুস্থ হয়ে উঠে বসেই জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে গ্যাস অ্যাসিড নয় তাই তো?
আমি ‘না’ বলতেই স্বামীর দিকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, খেয়েছি মাত্র দুটো মাটনের পিস। তাতেই সবাই আমাকে দোষ দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো। এবার হলো তো?