প্রজ্ঞাকর ভিক্ষুর নেতৃত্বে বৌদ্ধ শ্রমণদিগের দলটি কৌশাম্বি, বুদ্ধগয়া ও রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ দর্শনান্তে পুনরায় উত্তরাপথ অভিমুখে প্রত্যাগমন করিতেছিল। পথিমধ্যে কাশী নগরী সংলগ্ন সুপ্রাচীন ধামেক স্তূপ দর্শন করিয়া পরিব্রাজক শ্রমণগণ গঙ্গাতীরস্থ একটি পান্থশালায় বিশ্রামের উদ্দেশ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিল।
দীপান্বিতা গঙ্গাস্নান করিতে গিয়াছিল। স্নান সমাপনান্তে ঘাটের প্রশস্ত পীঠিকায় দণ্ডায়মান হইয়া সে বহুকালের পুরাতন অভ্যাসবশত সূর্যপ্রণাম সম্পন্ন করিল। তাহার পর অন্যমনস্ক চক্ষে উত্তরদিকে চাহিয়া রহিল। ঐ যেদিকে নগাধিরাজের কিরীট হইতে অবতরণপূর্বক পতিতোদ্ধারিণী জাহ্নবী পূর্বমুখে প্রবাহিত হইতেছেন, সেই সুদূর উত্তরাপথে তাহার দ্রুতগামী অবাধ্য চিত্ত ছুটিয়া চলিল — ঐদিকে কান্যকুব্জ নগরী, সেই পুণ্যস্থানে তাহার মনোমন্দিরের আরাধ্য দেবতা সগৌরবে বিরাজ করিতেছেন। বহুক্ষণ সেই দিশায় চাহিয়া থাকিতে থাকিতে যখন বেলা বহিয়া গেল, প্রভাতের নম্রতার নির্মোক ত্যাগ করিয়া রৌদ্রকর প্রখর হইয়া উঠিল, দীপান্বিতা কিঞ্চিৎ ক্লেশ বোধ করিতে লাগিল। পান্থশালায় প্রত্যাবর্তনের নিমিত্ত সে ঘাটস্থ প্রস্তরনির্মিত সোপানে আপন পদতল স্থাপন করিল।
কিয়দ্দূর উত্তরণের পরে প্রবল শ্বাসের কষ্ট তাহার চলনকে প্রতিহত করিল — বাধ্য হইয়া তাহাকে থামিতে হইল।
অধুনা এই নূতন উপসর্গ তাহার ক্ষয়িষ্ণু দেহকে অতিশয় ক্লিষ্ট ও জর্জরিত করিয়াছিল — দীর্ঘ পথযাত্রার শ্রান্তি ও নবলব্ধ শ্বাসকষ্টের গ্লানি তাহার রুগ্নতাকে অধিক প্রকট করিয়া তুলিয়াছিল। বিভিন্ন রোগব্যাধির উপসর্গ বিষয়ক পূর্ব অভিজ্ঞতার ফলে দীপান্বিতা উপলব্ধি করিয়াছিল, তাহার হৃদযন্ত্র অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে, হৃদস্পন্দন অনিয়মিত ও দ্রুত হইয়াছে, শ্বাসের কষ্ট তাহারই বিষময় ফল। তুলসী ও বাসক সেবনে সাময়িক উপকার পরিলক্ষিত হইত, কিন্তু দীপান্বিতার স্বচিকিৎসায় কোনও আগ্রহ ছিল না। অতএব পরিচর্যার অভাবে রোগ দুশ্চিকিৎস্য হইয়া উঠিয়াছিল।
ধীর পদসঞ্চারে পান্থশালায় ফিরিয়া একটি শ্রমণ বালকের নিকট দীপান্বিতা শুনিতে পাইল যে প্রজ্ঞাকর ভিক্ষু তাহাকে স্মরণ করিয়াছেন।
সে বিশ্রামের অপেক্ষা না করিয়াই ভিক্ষুর সমীপে উপস্থিত হইল। তাহার শ্বাসপ্রশ্বাস তখনও স্বাভাবিক হয় নাই।
ভিক্ষু প্রজ্ঞাকর খর্বকায়, বৃদ্ধ শ্রমণ — জলপান সমাপনপূর্বক আপন প্রকোষ্ঠটিতে বসিয়া তিনি বোধিচর্যাবতারের সূত্র পাঠে মগ্ন ছিলেন। দীপান্বিতা তাঁহার নিকটে আসিয়া নীরবে দণ্ডায়মান হইল।
ভিক্ষু শান্ত চক্ষু তুলিয়া তাহাকে অবলোকন করিয়া স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন – “উপবেশন করো সুদত্তা। আমাদিগের পরিব্রাজন বিষয়ে তোমার সহিত কিছু আলোচনা প্রয়োজন।”
দীপান্বিতা প্রকোষ্ঠদ্বারের চতুষ্কাষ্ঠে উপবেশন করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল – “বলুন ভদন্ত, আমি শুনিতে ব্যগ্র হইয়াছি।”
প্রজ্ঞাকর ভিক্ষু স্মিতমুখে বলিলেন — “পরিব্রাজনান্তে আমাদিগের জেতবন বিহারে ফিরিয়া যাওয়াই স্থির ছিল। কিন্তু উপস্থিত পান্থপালের নিকট একটি নূতন সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমি কিছু উত্তেজিত হইয়াছি।”
দীপান্বিতা জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিয়া রহিল। বৃদ্ধ ত্বরাহীন কণ্ঠে বলিয়া চলিলেন — “কাশী হইতে অনধিক সত্তর ক্রোশ উত্তরে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম অবস্থিত — মহাতীর্থ প্রয়াগ। পান্থপালের নিকটে সংবাদ পাইলাম, আগামী পূর্ণিমা তিথিতে পুষ্যভূতিরাজ চক্রবর্তী সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রয়াগে পদার্পণ করিবেন। সঙ্গমে স্নান সমাপনান্তে মহারাজ শীলাদিত্য কল্পতরু হইবেন বলিয়া জনশ্রুতি — কি হইল সুদত্তা? তুমি কি অধিক অসুস্থ বোধ করিতেছ?”
হর্ষবর্ধনের নামোল্লেখেই দীপান্বিতার ধমনীমধ্যে রক্ত চলাচলের অস্বাভাবিক গতিবৃদ্ধি ঘটিয়াছিল। দীর্ঘ একযুগ অতিক্রান্ত করিয়া স্বীয় আরাধ্য দেবতার সহিত সাক্ষাতের সম্ভাবনায় প্রবল উত্তেজনায় তাহার শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইল।
সে অবরুদ্ধ স্বরে কহিল — “জল! পানার্থে কিঞ্চিৎ জলদান করুন ভদন্ত!”
জলপান করিয়া অল্প সুস্থবোধ করিলে, দীপান্বিতাকে উদ্বিগ্নচক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া প্রজ্ঞাকর ভিক্ষু চিন্তিতস্বরে বলিলেন — “কিন্তু অসুস্থ, অশক্ত দেহে সত্তর ক্রোশ পথ অতিক্রম করিতে তুমি কদাচ সমর্থ হইবে না সুদত্তা।”
আগ্রহাতিশয্যে দীপান্বিতা উপবিষ্ট অবস্থা হইতে দ্রুত দণ্ডায়মান হইল। উদ্দীপ্ত কণ্ঠে কহিল — “আমি যাইব, ভদন্ত। মন্থরগতিতে চলিব, পথিপার্শ্বের জলসত্র বা বিশ্রান্তিগৃহে পর্যাপ্ত বিশ্রাম লইয়া তবেই অবশিষ্ট পথ লঙ্ঘন করিতে সচেষ্ট হইব। আমাকে ফেলিয়া যাইবেন না, তথাগতের ইচ্ছায় আমি নিশ্চিতরূপে আপনাদিগের সঙ্গে প্রয়াগ পৌঁছাইতে সক্ষম হইব। এখন আজ্ঞা করুন প্রভু।”
বহুকাল পরে সেই রাত্রিতে দীপান্বিতার অনায়াস নিদ্রাকর্ষণ হইল। স্বপ্নে প্রয়াগের ত্রিবেণী সঙ্গমে উত্তরাপথ নায়ক পুষ্যভূতি কুলতিলক হর্ষবর্ধনের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল।
সে অবলোকন করিল, বাম পার্শ্বে রাণী দুর্গাবতীকে লইয়া শীলাদিত্য সম্রাট নদীতে স্নান করিতে নামিলেন। তাঁহাদের সহিত সে-ও নদীবক্ষে অবতরণ করিল। তাঁহারা অবগাহনপূর্বক তীরে উঠিলেও দীপান্বিতা উঠিল না।
গঙ্গা এবং যমুনার পবিত্র সঙ্গমে অন্তঃসলিলা সরস্বতীর স্রোত তাহাদের সহিত মিলিত হইয়া ধরিত্রীগর্ভের অনিশ্চিত অতলে চিরতরে নিরুদ্দেশ হইয়া গেল।
পূর্ণিমা তিথিতে প্রয়াগের সঙ্গমঘাট লোকে লোকারণ্য। ইতস্তত পুষ্যভূতি সাম্রাজ্যের কেতন উড়িতেছে, মধ্যে মধ্যে দুন্দুভি ও নাকাড়ার শব্দে দশদিক স্পন্দিত হইতেছে। সপরিবার সম্রাট হর্ষবর্ধন স্নান সমাপনান্তে তীরস্থ তরুতলে বেদীতে উপবেশন করিয়াছেন। অসংখ্য মনুষ্য – বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অল্পবয়স্ক নরনারী তাঁহার সমীপে পৌঁছিয়া নানা বস্তু যাচ্ঞা করিতেছে, পারিষদবর্গের সহায়তায় হর্ষ তাহাদের প্রার্থনা অনুমোদন করিতেছেন। রাজ্যশ্রী মুহূর্তের জন্যও ভ্রাতার সঙ্গত্যাগ করেন নাই। সঙ্গমের ঘাট যেন এক অভূতপূর্ব উৎসবস্থল বলিয়া বোধ হইতেছে।
সূর্য যখন মধ্যগগনে, দূরে কাশী হইতে প্রয়াগ আগমনের ক্ষীণ পথটির প্রান্তে প্রজ্ঞাকর ভিক্ষুর অনুসারী শ্রমণদিগের দল সকলের দৃষ্টিগোচর হইল। দশজন মুণ্ডিতমস্তক ভিক্ষুর পশ্চাতে একজন প্রৌঢ়া ভিক্ষুণী নতমস্তকে বুদ্ধের নাম ধ্বনিত করিয়া পথ বাহিয়া আসিতেছে। সাধারণ পথিকগণ সসম্মানে ভিক্ষুদিগের জন্য পথ ছাড়িয়া দিল।
বহু মানুষের সমাগম দেখিয়া দীপান্বিতা অনুমান করিয়াছিল যে সে অবশেষে তাহার গন্তব্যে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
তাহার শ্বাসকষ্ট তীব্রতর হইয়াছে, দুর্বল হৃদপিণ্ড যেন ফাটিয়া পড়িতে চাহিতেছে, তীব্র রৌদ্রালোকেও তাহার দৃষ্টি অস্পষ্ট ও ধূসর বোধ হইতেছে। সে স্থির বুঝিয়াছিল, তাহার জীবনীশক্তি নিঃশেষিত হইয়া আসিতেছে, নিভন্ত প্রদীপে তৈলসিঞ্চন করিলেও তাহার নির্বাপিতপ্রায় জীবনদীপ পুনর্বার প্রজ্বলিত হইবে না। আপন অন্তর্যামীর নিকট নীরব প্রার্থনায় তাহার শুষ্ক ওষ্ঠাধর কম্পিত হইতেছিল — ‘প্রভু, আর কয়েকটি মুহূর্ত আমাকে ভিক্ষা দাও। আমাকে তাঁহার চরণস্পর্শ করিতে দাও প্রভু — একটি মুহূর্তের তরে তাঁহার মুখপানে দৃষ্টিপাত করিতে দাও”।
হর্ষবর্ধনের নিকটে পৌঁছিয়া যথোচিত স্বস্তিবাচনের পরে প্রজ্ঞাকর ভিক্ষু স্নিগ্ধস্বরে তাহাকে আহ্বান করিলেন।
“সুদত্তা, নিকটস্থ হও বৎস। অসুস্থদেহে বহুদূর হইতে মহারাজ সমীপে আসিতে আগ্রহী হইয়াছিলে — তোমার প্রার্থনা নিবেদন করো।”
দীপান্বিতা নতমস্তকে সম্রাটের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। বহু আয়াসে নিমীলিত চক্ষু দুইটি উন্মীলন করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রাজার পদপ্রান্তে তাহার অস্বচ্ছ দৃষ্টি ন্যস্ত করিল। কিন্তু এ কি, এ পদযুগল তো তাহার পরিচিত নহে — এ কাহার চরণকমল? সে ধীরে ধীরে আপন মুখমণ্ডল উত্তোলিত করিয়া উপবিষ্ট সম্রাটের মুখপানে চাহিল। সম্রাট হর্ষবর্ধনও তাঁহার চরণপ্রান্তে প্রণত নারীর মুখের উপর আপনার দৃষ্টি স্থাপন করিলেন। না, বলিরেখাঙ্কিত মুখাবয়বের বিগতযৌবনা এই ভিক্ষুণীকে তিনি চিনিতে পারিলেন না — ক্ষণিকের তরে দৃষ্টিপাত করিয়া চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন।
আর দীপান্বিতা? প্রিয়তমকে চাক্ষুষ করিবার অভিলাষে সে অতিকষ্টে পূর্ণদৃষ্টি মেলিয়া হর্ষের মুখপানে পরম প্রত্যাশায় চাহিয়াছিল। কিন্তু ইনি কে? পদ্মকোরকতুল্য কোমল নয়ন, খড়্গের ন্যায় উন্নতনাসা, প্রস্ফুটিত কুসুমের ন্যায় ঈষদব্যয়িত অধরোষ্ঠের ফাঁকে ভুবনমনোহর হাস্য — কে ইনি? কে? চেতন-অচেতনের দোলাচলে অবস্থিত দীপান্বিতার প্রতি চাহিয়া সেই মহাকারুণিক জ্যোতির্পুরুষ পুনর্বার মৃদু হাসিলেন। নয়নে নয়ন মিলিত হইল, অন্তরীক্ষ হইতে অনৈসর্গিক বাঁশরীর সুর চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িল, পরিপার্শ্বের কলরোল ধীরে ধীরে স্তিমিত হইয়া আসিল — মরজীবনের উপান্তে পৌঁছিয়া দুঃখিনী, ভাগ্যপীড়িতা ভিক্ষুণীর সহিত শাক্যশ্রেষ্ঠ গোতমের শুভদৃষ্টি সুসম্পন্ন হইল। আপন নিঃশেষিতপ্রায় প্রাণশক্তি একত্র করিয়া হৃদয়বিদারী স্বরে দীপান্বিতা আকুল হইয়া ডাকিল — “সিদ্ধার্থ, সিদ্ধার্থ! তিলেক প্রতীক্ষা করো প্রভু — আমি আসিতেছি।”
দীপান্বিতার কণ্ঠস্বর শ্রবণ করিবামাত্র হর্ষবর্ধন শরবিদ্ধ মৃগের ন্যায় ফিরিয়া চাহিলেন। বাহ্যিক রূপ প্রতারণা করিতে পারে কিন্তু ঐ কণ্ঠস্বর ভুলিবার নহে। হর্ষের কণ্ঠ হইতে রুদ্ধ, ব্যাকুল আহ্বান বাহির হইল — “রত্নাবলী!”
তথাগত বুদ্ধের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ভিক্ষুণী দীপান্বিতার প্রাণহীন দেহ শীলাদিত্য সম্রাটের চরণতলে পতিত হইল, তাহার বক্ষনিঃসৃত অন্তিম শ্বাস ত্রিবেণীসঙ্গমের শীতল বায়ুর সহিত মিশিয়া সুদূর অনন্তের পথে অন্তর্হিত হইয়া গেল।
দাতাশ্রেষ্ঠ সম্রাটের চরণে আপনার সমস্ত জীবন নিঃশেষে দান করিয়া বুদ্ধ শরণাগতা দীপান্বিতা তাহার চির উপাস্য সিদ্ধার্থের অঙ্গে চিরতরে লীন হইল। মহাতীর্থ ত্রিবেণীসঙ্গমে, এক অভূতপূর্ব মাহেন্দ্রক্ষণে বেদমাতা তাপসী সরস্বতী যেন বোধিসত্ত্ব গৌতমের সহিত চিরকালের জন্য একাঙ্গী হইয়া গেলেন।
অনাদি অতীত বর্তমানে মূক হইয়াছে, ইতিহাসও লাঞ্ছিত, পদদলিত। এই কাহিনীর অর্বাচীন সূত্রধার কেবল একাকী বসিয়া একাগ্র মনে শুনিতেছে, ভারতভূমির উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল মানবসাগরতীরে সার্ধ সহস্র বৎসর পরেও একনিষ্ঠ বুদ্ধোপাসক এক শীলাদিত্য সম্রাটের আকুল আহ্বান নগরে, পর্বতে, নদীতটে, অরণ্যে ক্রমাগত ধ্বনিত হইয়া ফিরিতেছে —
“রত্নাবলী! রত্নাবলী! রত্নাবলী!”
সমাপ্ত