বেশিরভাগ হবু মায়ের ধারণা, শিশুকে স্তনপান করানো আর এমন কী কঠিন কাজ! সবাই তো করাচ্ছে। নিজেও নিশ্চয়ই কাজটা ভালোভাবে করতে পারবেন। তবে ধারণা আর বাস্তবের মধ্যে যে অনেক তফাৎ তা পরিস্থিতি এলেই অনেকে বুঝতে পারেন। তখন নানারকম অসুবিধা টের পান। কিন্তু নিয়ম মেনে চললে এই অসুবিধা কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন নয়। কী করবেন আর কী করবেন না, জেনে নিন।
কীভাবে খাওয়াবেন?
সহজভাবে খাওয়ানো শুরু করুন। দরকার হলে নিজেকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বালিশ নিয়ে নিতে পারেন। এরপর সন্তানকে কোলে নিয়ে নিজের বুকের কাছে আনুন। নিজেকে শিশুর কাছে এগিয়ে নিয়ে যাবেন না।
শুধুমাত্র স্তনবৃন্ত নয়, স্তনের পুরো কালো অংশ (অ্যারিওলা) বাচ্চার মুখে আসবে। বাচ্চার চিবুক মায়ের স্তনে স্পর্শ করে থাকবে এবং সঠিক সংযোগ হলে স্তনপানের সময় বাচ্চার নিচের ঠোঁট উল্টে যাবে। বাচ্চার পেট মায়ের পেটে লেগে থাকবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল, বাচ্চার মাথা, ঘাড় ও ধড় এক সরলরেখায় থাকবে। অনেক সময়ই বাচ্চার ঘাড় বেঁকে থাকার জন্য বাচ্চার দুধ টানতে কষ্ট হয়। এক হাত শিশুর মাথার পিছনে রাখুন আর অন্য হাত দিয়ে শিশুর মুখে স্তন দিয়ে দিন। শিশুর নিচের দিকের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে হাঁ করিয়ে মুখে দিন। শিশুর খাওয়ার সময় শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক মতো নিচ্ছে কিনা লক্ষ রাখুন। শিশুর খাওয়া বন্ধ করার সময় আগে শিশুর মুখের কোনা দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে আস্তে করে বের করে দিন।
প্রতিবার ২০-২৫ মিনিট করে খাওয়াবেন। যদিও শিশুকে খাওয়ানোর কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। শিশু যখন চাইবে তখনই খাওয়াতে হবে। খাওয়ানোর পর শিশুকে শুইয়ে দিন। এরপর দ্বিতীয় স্তন পান করান। এরপরেও শিশুর খিদে থাকলে আবার প্রথমটা খাওয়ান। খাওয়ানোর পর অবশ্যই ঢেঁকুর তোলাবেন। এভাবে খাওয়ানো সম্পূর্ণ করুন। প্রথম কয়েক সপ্তাহ পরেও যদি শিশু কোনও একটি স্তন পানেই আগ্রহ দেখায়, অন্যটা মুখে নিতে না চায় তাহলে যেটি খায় না তার থেকে পাম্প করে দুধ বের করে দিন।
নিজেদের ঘরেই শিশুকে শোয়াবেন। শিশুর জন্মের প্রথম এক বছর বাবা মায়ের ঘরেই ঘুমনো উচিত। না হলেও যে ৬ মাস শিশু স্তনপান করে সেই সময়টা অবশ্যই রাখতে হবে। অবশ্যই চিৎ করে শোওয়াবেন। উপুড় করে নয়। এতে সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম বা সংক্ষেপে সিডস (SIDS) এর হার কমানো যায়। এতে শিশুকে খাওয়ানোও অনেক সহজ হয়ে যায়। তবে শিশুর জন্য নির্দিষ্ট বিছানায় শোয়ানো দরকার। বয়স্কদের খাট শিশুর জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। খাটের হেডবোর্ড, ঘরের দেওয়াল ও তোষকের মাঝে পড়ে শিশু দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। ঘুমের ঘোরে বাবা মায়ের হাত শিশুর নাকে বা মুখের ওপর পড়লেও শিশুর শ্বাসরোধ হতে পারে।
শিশুকে স্তনপান করানোর সময় খুব আঁটসাঁট ও অপরিষ্কার পোশাক পরা উচিত নয়।
কী কী সমস্যা হতে পারে?
স্তনপান করানোর সময় মায়ে্রা কিছু কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। যেমন,
স্তনে ব্যথা হওয়া– প্রথমবার সন্তানের জন্ম দেওয়া মহিলাদের এই সমস্যা বেশি হয়। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে গেলেই ব্যথা হয়। নিপল শুষ্ক বা হলে বা দুধের পরিমাণ বেশি হলে এমন হতে পারে। তবে বাচ্চা খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যথা দূর হয়। স্তনের শুষ্কভাব দূর করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো কোনও ক্রিম লাগানো যেতে পারে।
ক্র্যাকড নিপল– অনেক সময়ে মায়েদের নিপল ফেটে যায় এমনকী তার থেকে রক্ত পর্যন্ত বেরতে পারে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাকে খাওয়াতে সমস্যা হয়। নিজের যেমন কষ্ট হয়, তেমনই বাচ্চাকে ওই স্তনপান করাতেও মা দ্বিধা করেন। এমন হলে নিজের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। কখনও কখনও ফাঙ্গাল বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য এমন হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ সময়ে স্তন আর্দ্র রাখলে তা সেরে যায়। আর মায়ের নিজের দুধ লাগিয়ে দিলেও অনেক সময় উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া দুধ পাম্প করে বুক খালি করে দিলেও কাজ হয়।
বুকের দুধ জমাট বেধে যাওয়া- স্তনপান করানো মায়েদের এই সমস্যা খুব সাধারণ। ঠিকমতো দুধ না বেরলে তা জমাট বেধে যায়। এর সঙ্গে হালকা জ্বর, স্তনে ব্যথা বা শিশুকে দুধ খাওয়াতে সমস্যা হতে পারে। তাই দুধ যাতে ঠিকমতো বেরতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আর অবশ্যই বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে যেতে হবে। আলতো ভাবে ম্যাসাজ করলে বা হালকা গরম সেঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়। এরপরেও সমস্যা থেকে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
দুধের পরিমাণ কম বা বেশি হওয়া– অনেক সময় শিশু তার প্রয়োজনীয় দুধ পায় না। খাওয়ানোর পরেও তাই কান্নাকাটি করে। তেমন হলে স্তনে পাম্প করে দুধ আনার চেষ্টা করতে হবে। কিছু ব্যায়াম আছে যা দুধ আনতে সাহায্য করে। উপযুক্ত প্রশিক্ষকের কাছ থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে শুরু করা দরকার। অন্যদিকে বেশি দুধ হলে তা কমানোর চেষ্টা করার দরকার নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন ছিটকে শিশুর চোখে, মুখে না যায়। তেমন হলে আগে থেকে কিছুটা দুধ পাম্প করে ফেলে দিতে হবে।
সংক্রমণ– জন্মগতভাবে নিপল ভিতর দিকে থাকলে অনেক সময়ে স্তনে সংক্রমণ দেখা দেয়। তখন স্তনে ব্যথা হয়, গরম হয়ে যায়, লাল হয় ও ফুলে যায়। কারো কারো আবার পুজ হয়। এ ধরণের সমস্যা হলে শিশুকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ রেখে য়াগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
• স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ফল বেশি করে খাওয়া, সবজি, হোল গ্রেনস।
• তরল খাবার বেশি করে খাওয়া, জল, ফলের রস, দুধ খেলে শরীর আর্দ্র থাকে । অল্প স্বল্প চা, কফিও চলতে পারে। তবে বেশি চা বা কফি খেলে শিশুর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
• যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিতে হবে।
• ধূমপান পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। শিশুর মধ্যে নিকোটিন গেলে ঘুমের ব্যঘাত সহ পরোক্ষভাবে নিকোটিনের অভ্যাস হয়ে যেতে পারে। এতে করে শিশুর শ্বাসকষ্ট ও জটিল উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
• ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। অনেক ওষুধ আছে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় খেলে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কোনও ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে ভালো হয়।
• প্রথমেই বেশি দুধ না এলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রথমদিকে বাচ্চাকে কয়েক ঘণ্টা অন্তর খাওয়ানো ক্লান্তি বোধ হতে পারে। তবে ধীরে ধীরে তা অভ্যাস হয়ে যায়। আর যত বেশি শিশুকে খাওয়াবেন ততই বেশি দুধ তৈরি হবে।