এপ্রিল মাস। রোববার সকাল। গরমটা বাড়তে শুরু করেছে। মা-বাবা- ভাই সবাই বিয়ের নেমন্তন্নে রানাঘাট। বাড়ি ফিরে লাভ নেই। সুতরাং রোববারের অন-কল ডিউটি-টা চেয়ে নিয়েছি। কপাল ভালো থাকলে বেশীরভাগ সপ্তায় রোববারটা ঠান্ডা যায়। শনিবার রেগুলার এমার্জেন্সি ডিউটি ছিল। গোটা তিনেক খারাপ অ্যাক্সিডেন্ট কেস আর দুটো হাতভাঙ্গা রোগীর অপারেশন করে শেষরাতে ঘরে ফিরেছি। ঘন্টা চারেক ঘুমিয়ে উঠে চা- সিগারেট নিয়ে হোষ্টেলে গুলতানি করছি। এক্ষুনি জানাবাবু-র মেস থেকে জলখাবারের ডাক আসবে। আজ হাউসষ্টাফ রতন। বেশ অভিজ্ঞ। একবছর হাউসষ্টাফশিপ করার পরেও এক্সটেনশনে রয়েছে। আমি সিনিয়র পিজি। জুনিয়র পিজি-র বৌ প্রেগন্যান্ট। বাড়ি গেছে। পাজামা ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট গলিয়ে হোষ্টেলের মহার্ঘ্য লুচি-আলুর দম নিয়ে সবেমাত্র বসেছি, অমনি যমদূতের মত কলবুক হাতে গ্রুপ-ডি ষ্টাফের উদয়। ১৯৯৮ সাল। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। তাই কলবুক। কলবুক সই করে গপাগপ্ ব্রেকফাস্ট শেষ করে, সিঁড়ি দিয়ে নামছি। উল্টো দিক দিয়ে হোষ্টেলের রয়টার্স সত্যবান উঠছে।
‘কি কান্ড দেখে আসুন গিয়ে।’
‘কি কান্ড?’
‘হাত।’
‘মানে?’
‘হাত আটকে আছে লিফটে।’
‘কোথায়?’
‘গ্রীন বিল্ডিং’
গ্রীন তো উল্টো দিকে। এমার্জেন্সি থেকে কল-বুক খেয়েছি।’
‘আরে আগে গ্রীনে যান। এটার জন্যেই কলবুক খেয়েছেন মনে হয়।’
.তবু কৌতূহল সংবরণ করে কর্তব্যের টানে গেলাম ক্যাজুয়ালটি ব্লক, মানে এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে। দোতলায় এমার্জেন্সি অর্থোপেডিক ওয়ার্ড। রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, রক্তের দাগ অনুসরণ করে এগোলাম। সেই দাগ ক্যাজুয়ালটি বিল্ডিংয়ের মেন গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেছে। ওয়ার্ডের ভেতরে মর্মান্তিক দৃশ্য। রক্তের পুকুরের মাঝে বসে এক মাঝবয়সী মহিলা। রতন প্রানপণে ব্যান্ডেজ জড়াচ্ছে আর ব্যান্ডেজ ভিজে যাচ্ছে রক্তে।
‘ব্যান্ডেজে হবে না, রতন। আর্টারি বাঁধতে হবে।’
চেঁচিয়ে বললাম-‘সিষ্টার, ট্রে রেডি করুন। জলদি। আর্টারী ফরসেপস্ আর সিল্ক।’
ব্যান্ডেজ খুলতেই বীভৎস দৃশ্য। ডান হাতের কনুইয়ের নীচ থেকে মাংস,চামড়া কিছু নেই। সব ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেছে। রেডিয়াস আর আলনা- হাতের দুটো হাড় পাটকাঠির মত উঁচু হয়ে আছে।
আর্টারি মানে ধমণী। ছিঁড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। গ্লাভস্ পরে ফরসেপ দিয়ে চেপে ধরে সিল্কের সুতো দিয়ে বেঁধে দিলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হল। সাদা হয়ে গেছে রোগিণী। এক্ষুণি কয়েক ইউনিট রক্ত দিতে হবে। স্যালাইন চালিয়ে রক্ত আনতে পাঠালাম। রক্ত দিয়ে অপারেশনের জন্য রেডি করতে হবে। সে হতে এখনও তিন-চার ঘন্টা।
পরিস্থিতি একটু হাল্কা হতেই রতনের দায়িত্বে রোগিণীকে রেখে গ্রীন বিল্ডিংয়ের দিকে এগোলাম।
সামনে এক বিরাট জটলা। চেঁচামেচি হচ্ছে- ‘হাত, হাত।’ ‘কি ভয়ঙ্কর’, ইত্যাদি। ভীড় ঠেলে দু- নম্বর লিফটের কাছে যেতেই দেখলাম সেই ভয়াবহ দৃশ্য। একটু আগেই যার রক্ত বন্ধ করে এলাম, কব্জিসহ তার হাতটা আটকে রয়েছে লিফটের দরজায়। এগুলো সরকারি বিল্ডিংয়ের পুরোনো দিনের লিফট। দরজা দুটো ম্যানুয়াল, কোলাপসিবল গ্রীলের। মাঝেমধ্যেই বাইরের দরজাটা ঠিক মত বন্ধ হয় না। তখন সুইচ টিপলেও লিফট চলে না। তখন বাইরের কোলাপসিবল দরজাটা খুলে আবার ভাল করে বন্ধ করতে হয়। তবে লিফট চালু হয়। অনেকে ভিতরের দরজাটা না খুলে কোলাপসিবলের ফাঁক দিয়েই বাইরের দরজাটা বন্ধ করতে যায়। খুব বিপজ্জনক। সম্ভবতঃ এটা করতে গিয়েই হাতটা আটকে গেছিল বাইরের দরজায় এবং লিফট হঠাৎ চালু হয়ে প্রচন্ড গতিতে হাত থেকে শরীর ছিঁড়ে নিয়ে উঠে গিয়েছিল উপরে।
শুনলাম মহিলার ছেলে ভর্তি আছে তিনতলায় হেমাটোলজিতে। ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে। তার খাবার আনতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। তিনতলায় গিয়ে বাচ্চাটাকে দেখে এলাম। খুব অসুস্থ।
এরপর এমার্জেন্সি অপারেশন করে হাতটা কনুইয়ের নীচ থেকে বাদ দেওয়া হল। সেটা ১৯৯৮ সাল। মেডিকেল কলেজ। এখনকার দিন হলে হয়ত হাতটা জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেত। সেই যুগে সেটা সম্ভব ছিল না। তবে মহিলা প্রাণে বেঁচে গেল। কিন্তু মায়ের মন! কেবলই ছেলেকে খোঁজে।
তিনদিন বাদে ওয়ার্ডে গিয়ে নার্স দিদিদের কাছে শুনলাম, রোগিণীর ছেলেটা ব্লাড ক্যান্সারে মারা গেছে। এত দুঃখও থাকতে পারে মানুষের কপালে!
মর্মান্তিক ঘটনা। উপস্থাপনাটি বড়ই হৃদয়ছোঁয়া।
এত কিছুর পর মন শক্ত রেখে কাজ করেন কি করে? সেই জন্যই বোধহয় আপনারা ভগবানতুল্য।
ডাক্তারী পড়বার সময়কার অনেক ঘটনা মনে পড়ে গেল। কি সাবলীল বর্ণনা! লেখক তার ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে অজান্তে তার অন্য একটি পরিচয় উন্মুক্ত করে ফেলেছেন। মায়া, মমতা ও দরদের আধারযুক্ত এক অনন্য মানবিক মুখের অপরূপ রূপের দর্শন পেয়েছি। সেবা যখন ডিউটির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে মনুষ্যত্বের পরিমণ্ডলে বিস্তৃত হয় তখনই জীবরূপে শিবসেবা পরিপূর্ণ হয়। ঈশ্বর মঙ্গল করুন।