বছর দশেক আগের কথা। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের পুরোনো হাসপাতাল বিল্ডিং-এর নিচ তলায় তখন পুড়ে যাওয়া রোগিনীদের রাখা হত। রান্না ঘরে অসাবধানতার কারণেই হোক বা সন্ধ্যা প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের সময়েই হোক অথবা নিছকই বাজি পোড়াতে গিয়েই হোক সমস্ত পুড়ে যাওয়া রোগিনীরা দলা পাকিয়ে না-বলা অবহেলায় কোনওমতে ভবিতব্যের দিন গুজরান করতো। আমরা সব নব্য চিকিৎসকেরা একের পর এক বেডের প্রান্তে দাঁড়িয়ে খসখস করে স্যালাইনের হিসেব আর অ্যান্টিবায়োটিকের ক্যারিজমার অপেক্ষা করতাম। রোগী শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। পরিজনদের মাঝেও এক অদ্ভুত নিস্পৃহতা লক্ষ্য করতাম।
অধিক পুড়ে যাওয়া রোগীর চ্যানেল করা ছিলো বেশ দুঃসাধ্য। সেই সংকটে মাঝে মধ্যে ডাক পেতাম। বার বার স্যালাইনের ছুঁচ ফুটিয়েও রোগিনীদের আলাদা করে নতুন ব্যাথার উদ্রেক হতো না। ভীষ্মের শরশয্যায় পিঁপড়ের কামড়ের মতই যৎকিঞ্চিৎ।
কিন্তু সেদিন ফুটফুটে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মননের অশ্রু তালুতে গিয়ে ঠেকে কি একটা দলা পাকানো অনুভূতি তৈরি করেছিল সেই গল্পই আজ করবো।
মা হারা মেয়েটা বাবার আনা নতুন মায়ের রোষানলে পড়েছিল প্রথম থেকেই। তার পর যখন নতুন মায়ের কোলে ফুটফুটে ভাইটা জন্মালো তারপর থেকেই মাকে লুকিয়ে বাবা যে হাসিটা বিনিময় করতো তাতেও ভাঁটা পড়লো।
কচি ভাইটা প্রায়ই সর্দি,কাশিতে ভুগতো। এই বর্ষায় হঠাৎ কাঁসাই উপচে বান এলো। ভাইকে কোলে নিয়ে দৌড়ে ঘরে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজে গেছিলো ভাই। বকাঝকা তো তার গা সয়ে গেছে। কিন্তু তার বাবার সামনে মা গায়ে কি একটা ঢেলে উনুনের জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ ছুঁড়ে মেরেছিলো। এটুকুই তার মনে আছে। বছর বারোর কচি প্রাণে আগুনের থেকেও তীব্র ভাবে বিঁধেছিলো “ডাইনি” কথাটা।
এক রুগ্ন বুড়ি-মা মেয়েটির বিছানার পাশে হাঁটু মুড়ে কপাল চাপড়ে বিলাপ করতো। মেয়েও মরেছে পুড়ে।আদরের নাতনিও আজ ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। অসহায়, নিঃসম্বল কপাল পোড়া বুড়ির সরকারের কাছেও সুবিচারের দাবি নেই। শুধু পা জড়িয়ে কাঁদতো।
আমি রোজদিন নিজে হাতে ড্রেসিং করতাম, কপট রসিকতায় ওদের মুখে হাসি ফোটানোর বৃথা চেষ্টা করতাম।
এ পোড়া দেশে যদিও পুড়ে যাওয়া রোগীদের অধিকাংশই নিজ কর্মক্ষেত্রে অসাবধানতার শিকার। পোড়া মূলতঃ দুই প্রকার। আগুনের বা ইলেকট্রিসিটির পোড়া (বার্ন) এবং উষ্ণতরলে পোড়া (স্ক্যাল্ড)। দুইক্ষেত্রেই শরীরের প্রত্যেক প্রত্যঙ্গের পুড়ে যাওয়া “রুল অফ নাইন” অনুযায়ী হিসেব করে সর্বমোট কত শতাংশ বার্ন হলো তার হিসেব করা হয়। সেই অনুযায়ী অতি প্রয়োজনীয় স্যালাইনের হিসেব করা হয়। এই রোগীর অধিকাংশই হয় সংক্রমণ সংক্রান্ত জটিলতায় অথবা হাইপোথারর্মিয়াতে মারা যান। বার্ন যত গভীর ততই সংকটময় সে চিকিৎসা।
পুড়ে যাওয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা কি?
প্রথমতঃ শুকনো কম্বল বা চাদর দিয়ে ঢেকে আগুন নেভানোর পর পুড়ে যাওয়া অংশ কুড়ি মিনিট ধরে ট্যাপের জলে ঠান্ডা করুন। বরফের ব্যবহার রক্তপ্রবাহের সংকোচন করে অতিরিক্ত ক্ষতি করতে পারে। তৈলাক্ত কিছু না লাগানোই ভালো। বরং ঠান্ডা, ভেজা কিছু কাপড় দিয়ে হালকা চাপ দিয়ে যন্ত্রণা লাঘব করা যেতে পারে। পুড়ে যাওয়া অংশ অনতিবিলম্বেই ফুলতে থাকে। তাই হাতে বা পায়ের পোড়াতে গহনাদি দ্রুত খুলে ফেলা জরুরী।
পুড়ে যাওয়ার পরে যে ফোস্কা পড়ে তা আসলে সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে। পুড়ে যাওয়া অংশে কলোয়ডাল সিলভার মলম লাগান। নিদেনপক্ষে এ্যালোভেরা জেল বা মইসচারাইজার লাগাতে পারেন। চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানোর আগে পরিষ্কার ভেজা গজ কাপড় দিয়ে জায়গাটা জড়িয়ে রাখতে পারেন। মুখে খাওয়ার মত অবস্থায় থাকলে ও.আর.এস. এখানে অমৃতসমান। যন্ত্রণার লাঘবে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দেওয়া যেতে পারে। শরীরের অধিকাংশ পুড়ে যাবার ক্ষেত্রে রোগীকে জলে ডুবিয়ে ঠান্ডা করতে গেলে হাইপোথার্মিয়া হেতু জটিলতা বাড়তে পারে। এছাড়াও শরীরে ফ্লুইডের অভাবে ডিহাইড্রেসান হয়ে রোগীর শক্ জনিত জটিলতাও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
ইলেকট্রিক শকের ক্ষেত্রে দুইরকমের জটিলতা দেখা যায়। সাধারন বার্নের মতই স্যালাইন দিয়ে ডিহাইড্রেসন রুখলেও হৃৎস্পন্দনের ইলেকট্রিক জটিলতা অনেকাংশে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখবেন ইলেকট্রিক শকের ক্ষেত্রে সাধারণত এনট্রি ও এক্সিট পয়েন্টে দুটি বার্নের দাগ পাওয়া গেলেও অন্তরালে থাকা ডিহাইড্রেসানের চিকিৎসা সমান জরুরি ।
এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যান। চিকিৎসক প্রথমেই পুড়ে যাওয়া অংশের শতাংশ নির্নয় করে স্যালাইনের প্রয়োগ করে বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। পুড়ে যাবার প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীকে আপাতঃ দৃষ্টিতে তুলনামূলক স্বাভাবিক লাগলেও লড়াইটা শুরু হয় তার পরেই। ফ্লুইড রিসাসিটেশন শেষ হলে সংক্রমণ ও তৎ-সংক্রান্ত জটিলতা ও হাইপোথারমিয়ার সাথে লড়াই শুরু হয়। আমাদের শরীরের বর্ম (স্কিন) নষ্ট হওয়ায় শত্রু জীবাণুগুলি সহজে বাসা বাঁধে ও শরীরের উত্তাপ ধরে রাখার উপায় না থাকায় কোর টেম্পারেচার কমে গিয়ে হাইপোথারমিয়া তৈরি হয়। পুড়ে যাবার পর তাই অতি সংবেদনশীল কক্ষে রোগীকে রাখা উচিত যেখানে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিচ্ছন্নতা ও রোগীর ব্যক্তিগত পরিচর্যার ওপর জোর দেওয়া হয়। সে জন্যই “বার্ন ওয়ার্ড”-এর প্রয়োজনীয়তা।
দুর্ভাগ্যক্রমে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে এখনকার মতো সেসময় বার্ন ওয়ার্ড ছিলো না। আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা আর চিত্রগুপ্তের ব্যস্ততা রোগীর পাথেয় ছিলো। কিন্তু বছর বারোর ওই মেয়েটার পুড়ে যাওয়া বিবর্ণ মুখটা আজও চোখে ভাসে। পরপারে যাবার আগে ফ্যাসফ্যাসে গলায় আমার কানে কানে বলে গিয়েছিল-“ডাক্তার কাকু, বাবাকে বলে দিও,আমি ডাইনি নই”। বুড়ি দিদিমা ছাড়া আর কাউকে সেকথা বলতে পারিনি। বাবা তো কখনও দেখাই করতে আসেনি।