পরিবারে বিভিন্ন প্রজন্মের ছয়জন সচ্ছল ডাক্তারকে দেখে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম…। মেডিকাল কলেজে ঢোকার পর মেডিকাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস’ অ্যাসোশিয়েসন নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখালো…ডা নর্মান বেথুন, ডা দ্বারকানাথ কোটনিসের মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন…। কিন্তু কোথায় যাব? কোথায় স্পেনের জনগণের ফ্রাংকো-বিরোধী আন্দোলন, কোথায় চীনের মুক্তিযুদ্ধ? নিকারাগুয়ায় সান্দিনিস্তা সরকারের এক প্রতিনিধির কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলাম নিকারাগুয়ায় কাজ করার ইচ্ছাপ্রকাশ করে, তার উত্তর এলো না। অবশেষে ডাক্তারী পাস করার তিন বছর পর শহীদ হাসপাতালে কাজ করতে যাওয়া।
ছাত্রাবস্থায়ই দল্লী-রাজহরার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য আন্দোলনের গল্প শুনেছি। শহীদ হাসপাতাল স্থাপনের আগে ১৯৮১-তে প্রথম যে তিন ডাক্তার শ্রমিকদের সঙ্গে স্বাস্থ্য আন্দোলনে কাজ করতে যান, তাঁদের একজন ডা পবিত্র গুহ আমাদের ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের একজন। (বাকী দু’জন ছিলেন ডা বিনায়ক সেন ও ডা আশীষ কুন্ডু।) শহীদ হাসপাতাল থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে বেলুড়ের ইন্দো-জাপান স্টীলের শ্রমিকরা ১৯৮৩-তে যখন বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের কাজ শুরু করেন, তখন তাঁদের দোসর ছিল আমাদের সমাজসেবা সংগঠন পিপলস হেলথ সার্ভিস অ্যাসোশিয়েসন, সদ্য-ডাক্তার আমিও ছিলাম সেই স্বাস্থ্য প্রকল্পের চিকিৎসকদের মধ্যে।
শহীদ হাসপাতালে ছিলাম ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ আট বছর। ১৯৯৫-এ পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যোগ দিলাম ভিলাই শ্রমিক আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত কানোরিয়া জুটের শ্রমিক আন্দোলনের স্বাস্থ্য কর্মসূচী শুরু করার কাজে। চেঙ্গাইলের শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১৯৯৯-এ শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের গঠন, ১৯৯৯-এই বেলিয়াতোড়ে মদন মুখার্জী স্মৃতি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০০০-এ বাউড়িয়া শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০০৭-এ বাইনান শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২০০৬-’০৭-এ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পাশে থাকা, ২০০৯-এ সুন্দরবনের জেমসপুরে সুন্দরবন সীমান্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা, ২০১৪-এ আমার সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতালে যুক্ত হওয়া, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণ কর্মসূচী, ২০০০ থেকে ফাউন্ডেশন ফর হেলথ অ্যাকশনের সঙ্গে অসুখ-বিসুখ পত্রিকার প্রকাশ, ২০১১ থেকে স্বাস্থ্যের বৃত্তে প্রকাশ, ২০১৩ থেকে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর পক্ষে প্রচার, ২০১৫-এ ‘সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি’ গড়ে তোলা, ২০১৬ থেকে চন্ডীপুর-বারাসত-জলপাইগুড়ি-মাথাভাঙ্গায় যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলা, ২০১৭ থেকে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম এবং জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস-এ কাজ করা, ২০১৯ থেকে ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ’-এর হয়ে নৈহাটি ও সল্ট লেকের দত্তাবাদে কাজ করা–সবই আসলে সেই পথেই চলা, যে পথে আমি চলা শুরু করেছিলাম ১৯৮৬-তে, দল্লী-রাজহরার শ্রমিকরা চলা শুরু করেছিলেন ১৯৭৯-এ।
শুরুর শুরু
১ লাখ ২০ হাজারের আবাদী দল্লী-রাজহরাতে কোনও হাসপাতাল ছিল না এমনটা নয়। ভিলাই স্টীল প্ল্যান্টের হাসপাতাল, সরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মিশনারীদের হাসপাতাল, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার, হাতুড়ে—সবই মজুদ ছিল এ শহরে। কিন্তু গরীব মানুষ সে সবে সুচিকিৎসা পেতেন না।
খনির ঠিকাদারী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার ঠিকাদার লিখে পাঠালে বিএসপি হাসপাতাল থেকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা পেতে পারতেন। কিন্তু সেখানে তাঁরা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, ডাক্তার-নার্সরা তাঁদের লাল মাটি-মাখা শরীরে হাত ছোঁয়াতে ঘৃণা বোধ করতেন।
সে কারণে ১৯৭৯-এর ডিসেম্বরে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের উপাধ্যক্ষা কুসুম বাই প্রসবের সময় চিকিৎসা-অবহেলায় প্রাণ হারান। সেদিন বিএসপি হাসপাতালের সামনে জড়ো হয়েছিলেন দশ হাজার শ্রমিক চিকিৎসা অব্যবস্থার প্রতি বিক্ষোভ দেখাতে—না তাঁরা হাসপাতাল ভাঙ্গচুর করেননি, গায়ে হাত পড়েনি কোনও ডাক্তার বা নার্সের। তাঁরা শপথ নেন এক প্রসূতিসদন গড়ে তোলার যাতে আর কোনও মা-বোন কুসুম বাই-এর মতো প্রাণ না হারান।
শহীদ প্রসূতি সদনের শিলান্যাস হয় ১৯৮০-র ৮ই সেপ্টেম্বর।
স্বতস্ফূর্ততা থেকে চেতনা
১৯৭৯-এ ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের যে ১৭টা বিভাগ খোলা হয় তার মধ্যে ছিল স্বাস্থ্য বিভাগও।
‘স্বাস্থ্য ও ট্রেড ইউনিয়ন’ প্রবন্ধে কমরেড শংকর গুহ নিয়োগী বলেন—‘সম্ভবত কখনওই ভারতে ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের প্রশ্নকে নিজের সমগ্র কর্মসূচীর অন্তর্গত একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে সামিল করেনি। যদি বা কখনও স্বাস্থ্যের প্রশ্ন সামিল করা হয়েছে তখন সেটিকে পুঁজিবাদী মতাদর্শগত কাঠামোর মধ্যেই রাখা হয়েছে। এভাবে ট্রেড ইউনিয়ন চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, কার্যস্থলে লাগা আঘাত বা পঙ্গুত্বের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হওয়া শ্রমিকদের মানবিকতার দৃষ্টি থেকে বিকল্প কাজ দেওয়া, ইত্যাদি বিষয়গুলিতেই নিজেদের সীমিত রেখেছে।
…আমাদের এই প্রশ্নকে ওঠাতে হবে যে, যোগ্য বাসস্থান, স্কুল, চিকিৎসা, সাফসাফাই, জল, ইত্যাদি সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলির দায়িত্ব মালিককে নিতে হবে।…শ্রমিক শ্রেণী সমাজ-পরিবর্তনের অগ্রণী বাহিনী, তাই এটা তার দায়িত্ব যে সে অধিক প্রগতিশীল বিকল্প সামাজিক প্রণালীগুলির বিকাশের জন্য বিচার-বিবেচনা করবে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এর মধ্যে বিকল্প স্বাস্থ্য প্রণালীও অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে সঙ্গে এও প্রয়োজন যে শ্রমিক শ্রেণী আজকের উপলব্ধ উপকরণ এবং শক্তির উপর নির্ভর করে বিকল্প নমুনা দাঁড় করানোর প্রয়াস করুক।’
এই লেখায় নিয়োগীর যে ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় পরবর্তীকালে তা গ্রথিত হয় ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’-এর তত্ত্বে। সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতির সবচেয়ে সুন্দর প্রয়োগ হয়েছিল শহীদ হাসপাতালে। (সেই ভাবনাকেই আমরা এখন প্রয়োগ করে চলেছি আমাদের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।)
‘স্বাস্থ্যকে লিয়ে সংঘর্ষ করো’
১৯৮১-র ১৫ই আগস্ট স্বাস্থ্যের জন্য সংগ্রাম করো-র আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত। সেই সময়কার প্রচারপত্রে যে বিষয়গুলোকে বেছে নেওয়া হয়েছিল দেখছি সেগুলো এরকম—
- যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
- গর্ভবতী মহিলাদের নথিভুক্ত করা, তাঁদের যত্ন নেওয়া যাতে প্রসব নিরাপদে হয় এবং শিশুরা সুস্থ হয়।
- শিশুদের যত্ন নেওয়া, তাদের প্রতিপালন ও পুষ্টির ব্যবস্থা করা, সঠিক সময়ে টীকাকরণ।
- একটা ডিস্পেন্সারী চালানো, বিশেষত সে সব মানুষের জন্য যাঁরা বিএসপি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পান না।
- একটা হাসপাতাল চালানো যেখানে গ্রামের কৃষকরা প্রয়োজনীয় সেবা পাবেন।
- পরিবেশকে সুস্থ রাখা, বিশেষত পরিষ্কার পানীয় জলের প্রয়োজনীয়তার কথা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া, এভাবে কলেরা ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো।
- সংগঠন ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি পরিবারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং বিশ্লেষণ করা।
- সংগঠনের যেসব সদস্য স্বাস্থ্যের কাজে আগ্রহী, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘স্বাস্থ্য সংরক্ষক’ তৈরী করা, এঁদের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়া।
সাফাই আন্দোলন থেকে…
দল্লী-রাজহরার শ্রমিক বসতিগুলোতে সাফাইয়ের ব্যবস্থা ছিল না। একদিন শ্রমিক মোহল্লাগুলোর পুরুষ-মহিলা, ছাত্র-যুব-ব্যবসায়ী সবাই মিলে মোহল্লার ময়লা এক এক জায়গায় জড়ো করলেন। তারপর খনিতে মাল বওয়ার ১৩টা ট্রাককে আটকে তাতে জঞ্জাল ভরে নিয়ে যাওয়া হল মাইন্স ম্যানেজারের কোয়ার্টারের সামনে। ম্যানেজমেন্টকে ধমকি দেওয়া হলো—শ্রমিক বস্তি পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা না করলে এখন থেকে রোজ মাইন্স ম্যানেজারের কোয়ার্টারের সামনে ময়লা এনে ফেলা হবে।
ডাক্তাররা এলেন
১৯৮১-তে খনি শ্রমিকদের এক আন্দোলনের সূত্রে শংকর গুহ নিয়োগী ন্যাশানাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে বন্দী, শ্রমিক আন্দোলনকে ভেঙ্গে করার জন্য প্রশাসন বিভিন্ন দমনমূলক পদক্ষেপ চালাচ্ছে। পিপল’স ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস-এর এক তদন্ত দলের সদস্য হয়ে ডা বিনায়ক সেন এসেছিলেন দল্লী-রাজহরায়। জে এন ইউ-র সেন্টার অফ সোশ্যাল মেডিসিন এন্ড কমিউনিটি হেলথ-এ ১৯৭৬-১৯৭৮ অধ্যাপনার কাজ করার পর ১৯৭৮ থেকে তিনি জীবনের মানে খুঁজতে হোশাঙ্গাবাদ জেলার রসুলিয়ায় ফ্রেন্ডস’ রুরাল সেন্টারে যক্ষ্মারোগীদের নিয়ে কাজ করছেন। কাজে খুব একটা তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। দল্লী-রাজহরার শ্রমিক আন্দোলন তাঁকে আকৃষ্ট করল। তাঁর সঙ্গে এলেন তাঁর পত্নী সমাজবিজ্ঞানী ইলিনা সেন।
প্রায় একই সময় এলেন ডা আশীষ কুন্ডু। বাংলার বিপ্লবী মেডিকাল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আশীষ হাউসস্টাফশিপ শেষ করে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে নিজের পেশাগত জীবনকে মেলাতে তখন ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রগুলোয় কাজের সুযোগ খুঁজছেন।
তার মাস ছয়েক বাদে ডা পবিত্র গুহ যোগ দেন। ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার জন্য এ দফায় অবশ্য দীর্ঘ দিন তিনি থাকতে পারেন নি। শহীদ হাসপাতালে তিনি যোগ দেন নিয়োগীর মৃত্যুর পর ১৯৯২-এ। এখনও তিনি দল্লী-রাজহরাতেই আছেন।
এঁরা পাড়ায় পাড়ায়, কাজ শুরুর আগে খনির বিভিন্ন এলাকাগুলোতে ছোট ছোট সভা করে স্বাস্থ্যশিক্ষার কাজ চালাতে থাকেন।
স্বাস্থ্য কমিটি
আগে ইউনিয়নের ১৭টা বিভাগের অন্যতম যে স্বাস্থ্য বিভাগের কথা বলেছি তার কাজ ছিল বিএসপি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হলে তাঁদের চিকিৎসার তদারকি করা। ৭০-এর দশকের শেষ থেকে ৮০-র দশকের শুরু অবধি যে শরাব-বন্দী আন্দোলন (মদ্যপান-বিরোধী আন্দোলন) চলে তাতে সমগ্র ইউনিয়ন অংশ নিলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের। ৮১-র সাফাই আন্দোলনের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে, চিকিৎসকদের প্রচার-কাজে শিক্ষিত হয়ে যে শতাধিক শ্রমিক এগিয়ে আসেন তাঁদের ও চিকিৎসকদের নিয়ে গড়ে ওঠে স্বাস্থ্য কমিটি।
১৯৮২-র ২৬শে জানুয়ারী থেকে ইউনিয়ন অফিসের পাশের গ্যারেজে সকাল-বিকেল দুবেলা শুরু হয় স্বাস্থ্য পরিষেবা-প্রদানের কাজ—শহীদ ডিস্পেন্সারী। স্বাস্থ্য কমিটির কিছু সদস্য ডিস্পেন্সারী চালানোর কাজে চিকিৎসকদের পালাক্রমে সাহায্য করতে থাকেন, চিকিৎসকরা তাঁদের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে থাকেন। আর স্বাস্থ্য কমিটির বাকী সদস্যরা দায়িত্ব নেন একটা হাসপাতাল নির্মাণের।
১৯৮২-র ২৬শে জানুয়ারী থেকে ১৯৮৩-র ৩রা জুন হাসপাতাল চালু হওয়ার আগে অবধি প্রায় ৬০০০ মানুষ শহীদ ডিস্পেন্সারীতে চিকিৎসা পান।
১৯৭৭-এর ১১ জন শহীদ আর শহীদ হাসপাতাল
ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের জন্মের পর ঘর তৈরীর বাঁশ-বল্লীর ভাতার দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের আন্দোলনকে ভাঙ্গতে ’৭৭-এর ২রা জুন ইউনিয়ন দপ্তর থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় কমরেড নিয়োগীকে। নেতার মুক্তির দাবীতে শ্রমিকরা পুলিশদের আরেকটা দলকে ঘেরাও করে রাখে। ঘেরাওমুক্ত হতে পুলিশ প্রথমবার গুলি চালায় ২রা জুন রাতে, পরের দিন জেলার প্রধান শহর থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী দ্বিতীয়বার গুলি চালিয়ে ঘেরাও পুলিশদের মুক্ত করে।
২-৩রা জুনের গুলিকান্ডে শহীদ হন ১১ জন—অনুসুঈয়া বাই, জগদীশ, সুদামা, টিভুরাম, সোনউদাস, রামদয়াল, হেমনাথ, সমারু, পুনউরাম, ডেহরলাল ও জয়লাল। এই শহীদদের স্মৃতিতে ১৯৮৩-র শহীদ দিবসে উদ্বোধন হল শহীদ হাসপাতাল-এর। শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর প্রতীক হিসেবে এই হাসপাতালের দ্বারদ্ঘাটন করলেন খনির সবচেয়ে বয়স্ক শ্রমিক লহর সিং আর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষক হলাল খোর। সেদিন শ্রমিক সংঘের প্রচারপত্রে শ্লোগান ছিল—‘তুমনে মৌত দী, হমনে জিন্দগী’—তোমরা (শাসকরা) মৃত্যু দিয়েছ, আমরা জীবন দেব।
শ্রমিকদের শ্রমেই গড়ে ওঠে যোকোনও হাসপাতাল কিন্তু ছত্তিসগড়ের লোহাখনি শ্রমিকদের স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে ওঠা শহীদ হাসপাতালেই ভারতে প্রথম হাসপাতাল যার পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন শ্রমিকরা। শহীদ হাসপাতাল প্রকৃত অর্থে ছিল ‘মেহনতকশোঁকে লিয়ে মেহনতকশোঁকা অপনা কার্যক্রম’—শ্রমজীবী মানুষের জন্য শ্রমজীবীদের নিজস্ব কর্মসূচী।
হাসপাতাল শুরুর আগেই শহীদ ডিস্পেন্সারী পর্বে যোগ দেন ডা শৈবাল জানা। হাসপাতাল শুরুর পর ১৯৮৪-তে ডা চঞ্চলা সমাজদার।
এক নজরে শহীদ হাসপাতাল
৮৪ কিলোমিটার দূরে জেলাসদর দুর্গ, ৬২ কিলোমিটার দূরে রাজনাদগাঁও, ৬৬ কিলোমিটার দূরে রায়পুর জেলার ধমতরী, অন্যদিকে বস্তার জেলা-ঘেঁষা ডোন্ডী—এর মাঝে এক বিশাল আদিবাসী-বহুল এলাকার গরীব মানুষের চিকিৎসার প্রধান সম্বল হয়ে গড়ে ওঠে শহীদ হাসপাতাল। (এই যে ভৌগোলিক অবস্থান বললাম, তা ছোট রাজ্য ছত্তিশগড় গঠনের আগেকার। বর্তমানে দল্লী-রাজহরা বালোদ জেলায়।)
মঙ্গলবার বাদে সপ্তাহের ছয়দিন সকাল ৯-৩০টা থেকে ১২-৩০টা এবং বিকাল ৪-৩০টা থেকে ৭-৩০টা আউটডোর খোলা। ইমার্জেন্সির জন্য হাসপাতাল খোলা প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা। ১৯৮৩-তে হাসপাতাল শুরুর সময় শয্যাসংখ্যা ছিল ১৫, ১৯৮৯-তে দোতলা চালু হওয়ার পর তা বেড়ে হয় ৪৫, অবশ্য অতিরিক্ত শয্যা (রোগীদের বাড়ী থেকে নিয়ে আসা খাটিয়া) পেতে মোট ৭২ জন ভর্তি থাকতে পারতেন। হাসপাতালে সুলভে ওষুধপত্র কিনতে পাওয়া যায়। আছে প্যাথোলজি, এক্স-রে, ইসিজি-র ব্যবস্থা। আছে অপারেশন থিয়েটার এবং এম্বুলেন্স।
চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে চিকিৎসক ও একজন নার্স ছাড়া অন্যদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। শ্রমিক-কৃষক পরিবারের ছেলে-মেয়েরা প্রশিক্ষিত হয়ে চিকিৎসাকর্মীর কাজ করেন এ হাসপাতালে। আর এর বড় সম্পদ শ্রমিক-স্বেচ্ছাসেবীদের এক টীম, যাঁরা শহীদ ডিস্পেন্সারীর দিনগুলো থেকে চিকিৎসকদের সঙ্গে ছিলেন—জীবিকার জন্য এঁরা খনিতে কাজ করতেন আর বিকালে ও ছুটির দিনগুলোতে হাসপাতালে ও স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে কাজ করতেন বিনা পারিশ্রমিকে।
কেবল চিকিৎসা করা নয়, মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতন করা, স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলাও ছিল শহীদ হাসপাতালের কাজ।
কার অর্থে শহীদ হাসপাতাল?
১৯৮৩-তে ১৫ বেডের একতলা হাসপাতাল থেকে ’৯৪-এ আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বিশাল হাসপাতাল। কোথা থেকে এল এত অর্থ?
সেই সময়ে শহীদ হাসপাতাল সর্বতোভাবে গড়ে উঠেছিল শ্রমিকদের অর্থে। শুভানুধ্যায়ীরা বার-বার সাহায্য করতে চাইলেও শ্রমিকরা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কেন না তাঁরা নিজেদের সামর্থ্যের পরিমাপ করতে চেয়েছিলেন। শহীদ হাসপাতাল জনপ্রিয় হওয়ার পর প্রচুর আর্থিক অনুদানের প্রস্তাব এসেছে দেশী-বিদেশী ফান্ডিং এজেন্সির কাছ দেখে, দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে সে সব প্রস্তাব, কেন না শ্রমিকরা জানতেন বাইরে থেকে আসা অর্থের মানে বাইরের নিয়ন্ত্রণ।
‘ফল-ব্যাক ওয়েজ’ কথাটা আমাদের অধিকাংশের না জানা। শ্রমিক কাজে গিয়েছেন, অথচ মালিক কোনও কারণে কাজ দিতে পারছেন না, এই অবস্থায় ন্যূনতম মজুরীর ৮০% ফল-ব্যাক ওয়েজ হিসেবে শ্রমিকের প্রাপ্য হয়। দল্লী-রাজহরার শ্রমিকরাই ভারতে সর্বপ্রথম ফল-ব্যাক ওয়েজ আদায় করেন। সেই অর্থে হাসপাতাল তৈরীর ইঁট-পাথর-লোহা-সিমেন্ট কেনা হয়। এই সব মাল পরিবহনে সাহায্য করেন ছোট ট্রাকমালিকদের সংগঠন প্রগতশীল ট্রাক-ওনার্স অ্যাসোশিয়েসন। হাসপাতালের আসবাব-পত্র তৈরী করে দেন সহযোগী সংস্থা শহীদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সাথীরা।
হাসপাতালের শুরুতে ইউনিয়নের প্রত্যেক সদস্য একমাসের মাইন্স এলাউন্স ও হাউসরেন্ট এলাউন্স চাঁদা হিসেবে দেন। এই অর্থের একাংশে কেনা হয় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও যন্ত্রপাতি। বাকী অর্থে কেনা হয় একটা পুরোনো ট্রাক, ট্রাকটাকে ওয়াটার ট্যাংকারের রূপ দেওয়া হয়। খনিতে পানীয় জল সরবরাহ করত ট্যাংকারটা, অর্জিত অর্থে ডাক্তারদের ভাতা দেওয়া হতো।
শুরুর অর্থ এসেছিল এভাবে। তারপর যতোবার কোনও বিকাশ হয়েছে, নির্মাণ হয়েছে বা বড় যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, শ্রমিকরা নিজেরা চাঁদা দিয়ে অর্থ যুগিয়েছেন।
হাসপাতাল চালাতে যে অর্থ লাগে কর্মীদের ভাতা, ইত্যাদি বাবদ, তার জন্য রোগীদের কিছু খরচ করতে হতো—আউটডোরে রোগী দেখাতে ৫০ পয়সা (পরে বেড়ে হয় ১টাকা), ইন্ডোরে বেড ভাড়া দৈনিক ৩ টাকা (পরে বেড়ে হয় দৈনিক ৫ টাকা)। তবে আন্দোলনরত কর্মহীন শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের জন্য, সংগঠনের সারাক্ষণের কর্মীদের জন্য এবং খুব গরীব রোগীদের জন্য সমস্ত স্তরের চিকিৎসা পুরোপুরি বিনামূল্যে।
এভাবে স্থানীয় উৎসের ওপর নির্ভর করে স্বাবলম্বনের পথে এগিয়েছিল শহীদ হাসপাতাল।
যুক্তিসম্মত বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার লড়াই
একদিকে পরম্পরাগত ওঝা-বাইগাদের ঝাড়ফুঁক আর তুকতাক, অন্যদিকে পাশ করা-পাশ না করা চিকিৎসাব্যবসায়ীদের অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর ওষুধের ব্যবহার—এই দুয়ের মাঝে ছিলেন দল্লী-রাজহরার মানুষ। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার ধারণাটাই ছিল অনুপস্থিত।
কিছু উদাহরণ দিলে বুঝবেন—পরিশ্রমে ক্লান্ত খনি-শ্রমিকরা মনে করতেন প্রতি সপ্তাহে লালরং ভিটামিন ইঞ্জেকশন আর ক্যালসিয়াম ইঞ্জেকশন নিলে কমজোরী কাটবে। জ্বর কমাতে আকছার ব্যবহার করা হতো নিষিদ্ধ এনালজিন ইঞ্জেকশন—যার ফলে রক্তের দানাদার শ্বেতরক্তকোষ কমে যেতো, লিভার-কিডনী নষ্ট হতো। প্রসব দ্রুত করানোর জন্য ব্যবহৃত হতো পিটোসিন ইঞ্জেকশন—যাতে জরায়ুর প্রবল সংকোচনে জরায়ু ফেটে মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি।……
দল্লী-রাজহরার শ্রমিক স্বাস্থ্য-আন্দোলনেরই সমসাময়িক ভারতে ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের আন্দোলন। শ্রমিকরা যে ডাক্তারদের পেলেন তাঁরা সেই আন্দোলনের সাথী—কেউ পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগ একশন ফোরামের সঙ্গে যুক্ত, কেউ অল ইন্ডিয়া ড্রাগ একশন নেটওয়ার্কের সঙ্গে। ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের তত্ত্বের প্রথম বড়ো মাপের প্রয়োগক্ষেত্র ছিল শহীদ হাসপাতাল।
যেখানে ঘরোয়া চিকিৎসায় রোগ সারে, সেখানে ওষুধের ব্যবহারের বিরোধিতা করা হতো। যেমন—পেটের অসুখে লবণ-জলশূন্যতা সারাতে প্যাকেটের ওআরএস-এর বদলে বলা হতো ঘরে নুন-চিনি-লেবুর শরবৎ তৈরী করে খেতে। জ্বর কমাতে এনালজিন ইঞ্জেকশনের বদলে ঠান্ডা জলে গা-মোছা। খুসখুসে কাশিতে থ্রোট লজেন্স না চুষে হাল্কা গরম নুন জলে কুলকুচি করা। কাশিতে কফ সিরাপের পরিবর্তে গরম জলের ভাপ নেওয়া।…
ওষুধ যখন ব্যবহার করতে হবে তখন তা করা হতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা থেকে। ডাক্তাররা ওষুধ লিখতেন জেনেরিক নামে। অল্প কিছু বিজ্ঞানসম্মত ব্যতিক্রম বাদে একাধিক ওষুধের নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রণ ব্যবহার করা হতো না। ব্যবহার করা হতো না—এনালজিন, ফিনাইলবিউটাজোন, অক্সিফেনবিউটাজোন, ইত্যাদির মতো ক্ষতিকর ওষুধ। লেখা হতো না—কাশির সিরাপ, টনিক, হজমী এনজাইম, হিমাটিনিক, ইত্যাদির মতো অপ্রয়োজনীয় ওষুধ। যেখানে মুখে খাওয়ার ওষুধে কাজ চলে সেখানে ইঞ্জেকশনের বিরোধিতা করা হতো।……
শহীদ হাসপাতালে শল্য-চিকিৎসা
আলাদা করে এই বিভাগের কথা বলছি, কেন না মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে অল্প সরঞ্জামে কতো বেশী কাজ করা যায়, কি ভাবে আস্তে আস্তে বিকশিত হওয়া যায়—তার সুন্দর উদাহরণ এই বিভাগটা। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে—যোগ্যতায় জেনেরাল ফিজিশিয়ান হলেও সার্জারীতে প্রশিক্ষণ (হাউসস্টাফশিপ)-এর দৌলতে ৮ বছর আমি ছিলাম এ বিভাগের দায়িত্বে।
১৮ ফুট X ১১ ফুট একটা সাধারণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরই ছিল অপারেশন থিয়েটার প্রথম দশ বছর। পাশের একটা ৮.৫ ফুট X ৬ ফুট ঘর অপারেশনের সাজ-সরঞ্জাম রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো। সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করা হতো একটা এক ড্রামের অটোক্লেভে। ঘর জীবাণুমুক্ত করা হতো অপারেশনের আগের রাতে গন্ধক জ্বালিয়ে। ২০০ ওয়াটের একটা বাল্ব অপারেশনের আলো জোগাত। গভীরে করার সময় ৪ ব্যাটারীর একটা টর্চ। রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য ওপেন ইথার এনেস্থেশিয়া—প্রাগৈতিহাসিক যুগের হলেও যা বেশ নিরাপদ। যেখানে সম্ভব সেখানে লোকাল এনেস্থেশিয়া। যে সব হাসপাতালে কাজ শিখেছি সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মিল নেই। আমরা অনুপ্রেরণা পেতাম চীনের যুদ্ধক্ষেত্রে কম উপকরণ নিয়ে ডা নর্মান বেথুন, ডা কোটনিশের বড়ো বড়ো অপারেশন করার কাহিনী। আমরা ভাবতাম তাঁদের তুলনায় তো আমাদের উপকরণ বেশী!
অল্প যা কিছু যন্ত্রপাতি ছিল, তা দিয়ে ফোঁড়া কাটা, চোট সেলাই, হাইড্রোসিল, হার্নিয়া, অর্শ, ভগন্দরের অপারেশন করা হতো শুরুতে। ধীরে ধীরে যন্ত্রপাতি জোগাড় হতে থাকে, বাড়তে থাকে অপারেশনের সংখ্যা, ধরন ও গুরুত্ব।
বড়ো অপারেশনের শুরু ইমার্জেন্সি অপারেশন দিয়ে। মনে আছে প্রথম রোগী ছিল বছর তিনেক বয়সের এক ছেলে, গ্রাম থেকে এসেছে আন্ত্রিক অবরোধ (intestinal obstruction) নিয়ে। এমন সময় আসা বড়ো শহরে পাঠানো সম্ভব ছিল না। খুলতে হল। ছোট retractor নেই, tongue depressor দিয়ে কাজ চালানো হল। খুলে দেখা গেল ক্ষুদ্রান্ত্রের একাংশ পচে গেছে, কেটে বাদ দিয়ে ভালো প্রান্তদুটোকে জুড়তে হবে। Intestinal clamp চাই, এই ক্ল্যাম্প লাগিয়ে রাখলে অন্ত্রের মল বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে না, কাটা প্রান্ত থেকে রক্ত বেরোবে না। অভাব মেটাতে নামানো হল আরেক জন এসিস্ট্যান্ট। তার কাজ কেবল দু হাতের দুটো-দুটো আঙ্গুল দিয়ে অন্ত্রের দু-প্রান্ত চেপে ধরে থাকা। নির্বিঘ্নে কাজ মিটল। দ্বিতীয় রোগী বয়স্ক—পেপ্টিক পারফোরেশন-এর। রোগ নির্ণয় নিশ্চিত হতে পেটের এক্স-রে করে দেখতে হয়—মধ্যচ্ছদার নীচে লিভারের ওপর গ্যাসের ছায়া আছে কিনা। তখন শহীদ হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন নেই। দল্লী-রাজহরায় এক্স-রে হয় কেবল মিশনারী পুষ্পা হাসপাতালে—বিকেলের পর সেখানেও এক্স-রে হবে না। ক্লিনিকাল ডায়াগনোসিস নির্ভর করে পেট খুলতে হল……।
আস্তে আস্তে শল্যচিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে শহীদ হাসপাতালের পরিচিতি বাড়তে লাগল। বিএসপি হাসপাতালে এমএস ডিগ্রীধারী সার্জেন, গাইনিকোলজিস্ট সবই ছিলেন, কিন্তু একটু বড় অপারেশন হলেই তাঁরা পাঠিয়ে দিতেন ভিলাইয়ের মেন হসপিটালে, ৯১ কিলোমিটার দূরত্ব অনেকে বেঁচে পৌঁছতে পারতেন না। তখন ছুরি ধরতে হতো শহীদ হাসপাতালের এমবিবিএস-দের। অজ্ঞান করতেন যিনি, তাঁর অক্ষর জ্ঞান ছিল না, কিন্তু তাঁর হাতে ওপেন ইথার এনেস্থেশিয়ায় কোনও মৃত্যু হয়নি কখনও। পরে ইনি এয়ার ইথার মেশিন ব্যবহারেও দক্ষ হয়ে ওঠেন।
বড়ো অসুবিধা ছিল একই ঘরে অপারেশন আর প্রসবের কাজ চালাতে হতো। ’৮৯-এর এক আন্দোলনে বড়ো মাপের আর্থিক বিজয়ের পর শ্রমিকরা এক আধুনিক ওটি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজ নিলেন। শ্বেত পাথরের মেঝে-যুক্ত চার কক্ষের এই কমপ্লেক্স যে কোনও আধুনিক হাসপাতালের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু শুরুর সীমিত সাধ্যের দিনগুলোতে যে সব উপকরণ উদ্ভাবন করেছিলেন চিকিৎসক ও কর্মীরা, সে সবও স্থান পায় নতুন ওটি-তে। ১৯৯৩-এ নতুন ওটি চালু হওয়ার পর পুরোনো ঘরটা ব্যবহৃত হতে থাকে মাইনর ওটি ও লেবার রুম হিসেবে।
ধীরে ধীরে পরিচিতি এতোটাই বাড়ল যে, যাঁরা বিনা পয়সায় বিএসপি হাসপাতালে অপারেশন করাতে পারেন তাঁরাও পয়সা (কম হলেও) খরচ করে শহীদ হাসপাতালে অপারেশন করাতেন।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা
প্রথমে ডাক্তারের রোগী দেখার ঘরের এক পাশে ৮.৫ ফুট X ৪.৫ ফুট এক চিলতে জায়গায় ছিল ল্যাবরেটরী। রক্ত-মল-মূত্রের সাধারণ পরীক্ষা, কফ পরীক্ষা, বীর্য পরীক্ষা, ইত্যাদি পরীক্ষা করতেন মদন নামের এক আদিবাসী যুবক। মদন আগে ছিলেন ট্রাকের হেল্পার। যক্ষ্মায় তাঁর ফুসফুসের চারদিকে জল জমে, চিকিৎসা করানোর জন্য কয়েকমাস ভর্তি ছিলেন শহীদ হাসপাতালে, তখনই ডা শৈবাল জানার কাছ থেকে তাঁর কাজে দক্ষ হয়ে ওঠা।
ল্যাবরেটরীর আয় জমিয়ে একে একে কেনা হলো বিদ্যুৎচালিত সেন্ট্রিফিউজ, কলরিমিটার, ইনকিউবেটর। ১৯৯৩-এর প্রথমার্ধে গড়ে তোলা হলো বড়ো ল্যাবরেটরী কক্ষ, সেখানে কাজ করতে লাগলেন শহীদ হাসপাতালেই কাজ শেখা তিন জন কর্মী। পরীক্ষাগুলোতে খরচ পড়ত বাজারের তুলনায় ১/৪ থেকে ১/২।
আগে সাধারণ এক্স-রে করাতে পাঠাতে হতো পুষ্পা হাসপাতালে, বিশেষ এক্স-রে-র জন্য দুর্গ-ভিলাই। ১৯৯৩-এর সেপ্টেম্বরে ২০এমএ-র একটা এক্স-রে মেশিন কেনা হলো। হাসপাতালের সঞ্চয়ে কিছু টাকা ছিল, বাকী টাকার একাংশ প্রগতিশীল ট্রাক ওনার্স এসোশিয়েসনের সদস্যরা দান করলেন, বাকী অংশ সুদ-হীন দীর্ঘমেয়াদী ঋণ। এক্স-রে টেকনিশিয়ান হিসেবে মনোনীত হলো শ্রমিক-পরিবারের উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ এক ছেলে, কলকাতার এক রেডিওলজিস্ট বন্ধু মাস ছয়েক তাকে নিজের কাছে রেখে কাজ শিখিয়ে দিলেন।
ইসিজি মেশিন এল ১৯৯৪-এর ফেব্রুয়ারীতে।
এম্বুলেন্স এল
১৯৯০-এর আগে দল্লী-রাজহরা থেকে কোনও রোগীকে দুর্গ, ভিলাই বা রায়পুর নিয়ে যেতে হলে রোগীর পরিবারের মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ত। কেন না এম্বুলেন্স ছিল কেবল বিএসপি হাসপাতালে, আর ভিলাই অর্থাৎ ৯১ কিলোমিটার যেতে ভাড়া গুনতে হতো সাড়ে তিন হাজার টাকারও বেশী।
অনেক দিন ধরেই এম্বুলেন্স কেনার কথা ভাবা হচ্ছিল, কিন্তু কোথা থেকে আসবে দুই লাখেরও বেশী টাকা? ’৮৯-এ মেশিনীকরণ-বিরোধী আন্দোলনে বিজয়ের পর বিএসপি-র কিছু জুনিয়ার অফিসার ইউনিয়নের কাজে আগ্রহী হয়ে শহীদ হাসপাতালে কিছু সামগ্রী দান করতে চান। নিয়োগী তাঁদের জানালেন—হাসপাতাল বাইরের দান নেয় না। বরং তাঁরা বিএসপি-র একটা বাতিল এম্বুলেন্স যাতে ইউনিয়ন কিনতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিন। ১২ হাজার টাকায় একটা পুরোনো এম্বুলেন্স কেনা হলো, সারাতে খরচ হলো আরও ২৮ হাজার, ৪০ হাজারে প্রায় নতুনের মতো একটা এম্বুলেন্স হয়ে গেল।
ভাড়া ঠিক করতে ডাকা হলো এক নাগরিক সভা—ঠিক হলো কিলোমিটার প্রতি দেড় টাকা ভাড়া নেওয়া হবে, অর্থাৎ ভিলাই যেতে লাগতো ২৭০ টাকা, বিএসপি-র এম্বুলেন্সের ভাড়ার তুলনায় ০.০৭৭% ভাড়া। গরীব রোগীদের জন্য ভাড়া মকুব করার ব্যবস্থা হলো।
এত কম ভাড়া নিয়েও এম্বুলেন্সের আয় থেকেই বেরিয়ে আসত ডিজেলের খরচ, সারাই-এর খরচ, ড্রাইভারের ভাতা।
এক অভিনব ব্লাড ব্যাঙ্ক
কোন ব্লাড ব্যাঙ্ক ছিল না দল্লী-রাজহরায় অথচ রক্তের অভাবে মৃত্যুর সংখ্যা নেমে এল শূন্যে।
অন্যান্য যে কোনও জায়গার মতো এখানেও রক্তদান সম্পর্কে মানুষের মনে ভীতি ও বিভ্রান্তি ছিল। তা দূর করতে দেওয়াল পত্রিকা, পোস্টার-প্রদর্শনী নিয়ে প্রচার চলে, লোকস্বাস্থ্য শিক্ষামালায় বেরোয় পুস্তিকা—‘রক্তদান কে বারে মেঁ সহী জানকারী’। মানুষের ভুল ভাঙ্গাতে হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মীরা, ইউনিয়নের নেতারা রক্তদান করতে থাকলেন। অন্যরা যখন দেখলেন রক্ত দিলে কোনও ক্ষতি হয় না, বরং মুমূর্ষু মানুষের জীবন বাঁচে, তখন তাঁদের মধ্যে আগ্রহ দেখা দিল। রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করিয়ে তাঁরা নথিভুক্ত হতে থাকলেন স্বেচ্ছা-রক্তদাতাদের তালিকায়, সংখ্যা ক্রমে পাঁচশ ছাড়ালো।
কোনও রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে প্রথমে রক্ত দিতে বলা হতো আত্মীয়-স্বজনদের। তাঁদের মধ্যে উপযুক্ত রক্তদাতা না থাকলে বা গ্রুপ না মিললে খোঁজ পড়ত স্বেচ্ছা-রক্তদাতাদের। হাসপাতাল বা ইউনিয়ন অফিস থেকে সার্কুলার চলে যেত, এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে রক্তদাতা হাজির। হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মী-ইউনিয়নের নেতারা থাকতেন ইমার্জেন্সি স্টক হিসেবে।
এভাবেই গড়ে উঠেছিল এক ব্লাড ব্যাঙ্ক, যেখানে বাস্তবে ব্যাঙ্ক নেই, অথচ সব গ্রুপের রক্তই যেখানে মজুদ পর্যাপ্ত পরিমাণে। (বর্তমানে ব্লাড ব্যাঙ্ক চালানোর যে নিয়ম-কানুন, তাতে এভাবে ব্লাড ব্যাঙ্ক চালানো যায় না। কিন্তু আমি জানি দল্লী-রাজহরার শ্রমিকরা এই নিয়ম-কানুন মেনেও রক্তদান পরিষেবা নিশ্চয়ই চালাতে পারতেন।)
জাতীয় কর্মসূচীতেও অংশীদার শহীদ হাসপাতাল
জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূলন কর্মসূচী ও টীকাকরণ কর্মসূচীতে দুর্গ জেলায় এক নম্বর স্থানে ছিল শহীদ হাসপাতাল। ’৯০-এর দশকের গোড়ায় নয়া আর্থিক নীতি ও কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের ঠেলায় যক্ষ্মার ওষুধ ও টীকার সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
১৯৮৯-এ স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র দল্লী-রাজহরার শ্রমিক-বস্তিগুলোতে পোলিও রোগাক্রান্তদের এক সার্ভে চালায়। দেখা যায় ১৯৮৪ থেকে কোনও শিশু পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়নি। না, এর কৃতিত্ব কেবল শহীদ হাসপাতালের টীকাকরণ কর্মসূচীর নয়। ১৯৭৭ থেকে চলে আসা আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন,জনশিক্ষার বিস্তার এসবই হল আসল কৃতিত্বের অধিকারী।
শহীদ হাসপাতাল কিন্তু জাতীয় পরিবার কল্যাণ কর্মসূচীতে অংশ নেয়নি। কেন না সে সরকারের রাজনীতি—জনসংখ্যাই সব সমস্যার মূলে, বন্টনে অসাম্য নয়—এর বিরুদ্ধে।
স্বাস্থ্য আন্দোলনকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের অংশ হতে হবে
দল্লী-রাজহরার যে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কথা বলছি তা ছিল মেহনতী মানুষের নিজের অধিকার প্রাপ্তির জন্য চালানো এক বড় আন্দোলনের অংশ। শ্রমিকরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছিলেন—অধিকাংশ স্বাস্থ্য সমস্যার মূল থাকে আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে, তাই বর্তমান আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে অর্থাৎ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে বর্তমান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোরও মূলগত পরিবর্তন করা যায় না।
একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করা যাক। গরীব দেশগুলোর প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে এক বা দু’ নম্বরে থাকা রোগ ডায়রিয়া। অপুষ্টিগ্রস্ত মানুষদের, বিশেষত অপুষ্টিগ্রস্ত শিশুদের এ রোগ বেশী হয়। যেখান-সেখানে মলত্যাগে ও দূষিত পানীয় জলে এ রোগ ছড়ায়। ছোটো ছোটো অপরিচ্ছন্ন ঘরে যাঁরা থাকতে বাধ্য হন, তাঁদের মধ্যে এ রোগ মহামারীর রূপ ধারণ করে। শরীরে লবণ ও জল কমে গিয়ে ডায়রিয়া প্রাণঘাতী হতে পারে। কিন্তু মানুষ যদি জানেন যে নুন-চিনি-লেবুর শরবৎ বানিয়ে কিভাবে লবণ-জলশূন্যাতার মোকাবিলা করা যায়, তাহলে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনা যায়। যে সব দেশে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে এসেছে, সেসব দেশে সবার জন্য পানীয় জল, শৌচাগার, উপযুক্ত বাসস্থান, পেটভরা খাবার, শিক্ষার মাধ্যমেই এ কাজ সম্ভব হয়েছে।
কিছু স্বাস্থ্য কর্মসূচী কেবল ওষুধ দিয়ে ডায়রিয়ার চিকিৎসা করা। কিছু কর্মসূচী পেটের অসুখের প্রতিরোধের জন্য জল ফুটিয়ে খাবার কথা বলে আর চিকিৎসার জন্য শরবৎ ব্যবহারের কথা বলে। তারা মনে রাখে না, যাঁর কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য কেনার পয়সাই নেই, তিনি জল ফোটানোর জ্বালানী জোগাড় করবেন কি ভাবে? এদের প্রচারে পর্যাপ্ত খাদ্যের গুরুত্ব, বাসস্থানের গুরুত্ব উহ্য থেকে যায়, চাপা পড়ে থাকে পানীয় জলের দাবী।
দল্লী-রাজহরার স্বাস্থ্য কর্মসূচীর শুরুতেই প্রচারের এক কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ডায়রিয়াকে। প্রচারে জোর দেওয়া হয় ডায়রিয়ার আর্থ-সামাজিক কারণ, ডায়রিয়ায় ওষুধের প্রয়োজনহীনতা ও পরিষ্কার পানীয় জলের প্রয়োজনীয়তার ওপর। এবার সচেতন মানুষদের নিয়ে আন্দোলনে নামে ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ ও ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা। সরকার ও বিএসপি ম্যানেজমেন্ট বাধ্য হয় দল্লী-রাজহরা ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ১৭৯টা টিউবওয়েল বসাতে।
জনস্বাস্থ্যশিক্ষার মাধ্যম—শহীদ হাসপাতাল
স্বাস্থ্যশিক্ষার জন্য উপলব্ধ সবগুলো পদ্ধতিই শহীদ হাসপাতাল অবলম্বন করে। আউটডোর ও ইন্ডোরের রোগী ও তাঁদের পরিজনদের সঙ্গে ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীরা রোগের কারণ ও চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। হাসপাতালের ছুটির দিন মঙ্গলবার স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারদের দল গ্রামে-শ্রমিক বস্তিতে গিয়ে প্রচার চালাতেন পোস্টার-প্রদর্শনী, স্লাইড-শো, জাদুপ্রদর্শনী নিয়ে। এছাড়া হাসপাতালে বার করা হতো এক দেওয়াল-পত্রিকা, ‘স্বাস্থ্য সংগবারী’ (যার অর্থ স্বাস্থ্যের সঙ্গী)। ১৯৮৯ থেকে ’৯১ অবধি প্রতি দু’মাস ছাড়া বার করা হতো একটা করে স্বাস্থ্য-পুস্তিকা স্বাস্থ্যের সাধারণ সমস্যাগুলোকে নিয়ে, এই সিরিজের নাম ছিল ‘লোকস্বাস্থ্য শিক্ষামালা’।
জনশিক্ষায় যে বিষয়গুলোর জোর দেওয়া হতো সেগুলো এই রকম—
- স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারগুলোর পর্দা ফাঁস করা।
- চিকিৎসাব্যবসায়ীদের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা-পদ্ধতির স্বরূপ-উদ্ঘাটন করা।
- রোগ-প্রতিরোধ ও রোগ-চিকিৎসার সহজ প্রযুক্তির জ্ঞানে জনসাধারণের ক্ষমতায়ন।
- দেশী-বিদেশী ওষুধ-কোম্পানীর শোষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।…
সংগ্রামের এক হাতিয়ারও বটে
স্বাস্থ্য-প্রচারের মাধ্যমে জনতাকে সামাজিক সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন করে কিভাবে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হতো, তা বলেছি ডায়রিয়াকে কেন্দ্র করে পানীয় জলের দাবীকে সামনে আনার প্রসঙ্গে।
এছাড়া ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা পরিবারের কোনও সংগঠন যখন আন্দোলনে নামে তখন আন্দোলনের ফলে কর্মচ্যুত শ্রমিক-কৃষক ও তাঁদের পরিবারের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নিত শহীদ হাসপাতাল।
ভোপালের গ্যাসপীড়িতদের স্বাস্থ্যের দাবীতে আন্দোলনে, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে শহীদ হাসপাতালের উজ্জ্বল অংশগ্রহণ ছিল।
আগে দল্লী-রাজহরায় সরকারী হাসপাতাল ছিল না, বিএসপি হাসপাতালের ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। শহীদ হাসপাতালের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় শংকিত প্রশাসন ডোন্ডী-লোহারা বিধানসভা কেন্দ্রে ৭টা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বানায়। বিএসপি তার হাসপাতালে বেড-সংখ্যা বাড়ায়।
অভিনবত্ব ছিল পরিচালনাতেও
শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে যে কোনও প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় শ্রেণী-বিভাজনের প্রতিফলন ঘটে। তাই যে কোনও হাসপাতালের পরিচালনায় সবার ওপরে থাকেন প্রশাসক বা অধীক্ষক, তাঁর নীচে ধাপে-ধাপে বড়ো ডাক্তার, ছোটো ডাক্তার, নার্স, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মী, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীরা।
সংঘর্ষ ও নির্মাণের রাজনীতির রূপায়ণে শ্রেণীবিভক্ত শোষণভিত্তিক সমাজে শ্রেণীহীন সমাজের ভ্রূণের মডেল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল শহীদ হাসপাতালকে। তাই সেখানে কোন প্রশাসক বা অধীক্ষকের পদ ছিল না। মানসিক ও শারীরিক শ্রমে ফারাক ছিল না। ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসাকর্মী-শ্রমিক স্বাস্থ্যকর্মী-সাফাই কর্মী—সবাইকে নিয়ে গঠিত এক কমিটি সপ্তাহে এক নির্দিষ্ট দিনে বসে নীতিগত সিদ্ধান্ত, কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিত। সবার সেখানে মতপ্রকাশের সমান অধিকার—সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। খুব কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক সংগঠনকে প্রভাবিত করতে পারে, সে সব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতেন ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও।
সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে
মূলত লোকের অভাবে শহীদ হাসপাতাল শ্রমিকদের পেশাগত রোগ নিয়ে কাজ করতে পারে নি, যদিও খনি-শ্রমিকদের পেশাগত শ্বাসরোগ, ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকদের কোমরে-ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে কাজ করার দরকার ছিল।
আরেকটা দুর্বলতা চিকিৎসকের জন্য পশ্চিমবঙ্গ-নির্ভরতা। বিনায়কদা, আশীষদা, পবিত্রদা, শৈবালদা, চঞ্চলাদি—তারপর আমি—আমার পর ডা প্রদীপ দাস, ডা ভাস্কর সাহা—সবাই বাংলার সমাজ-পরিবর্তনকামী মেডিকাল ছাত্র-আন্দোলনের ফসল। এমনকি কমরেড নিয়োগীর মৃত্যুর পর যখন হাসপাতালে স্থায়ী ডাক্তার কেবল আমি ও শৈবালদা, এবং আমাদের অন্তত একজনকে যখন সংগঠনের কাজে দরকার, তখন আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাইরে থেকে এসেছেন কেবল এসেছেন বাংলার ডাক্তাররাই পালা করে ১০-১৫ দিনের জন্য কাজে সাহায্য করতে। প্রথম অবাঙ্গালী ডাক্তার রাজীবলোচন শর্মাও ছত্তিশগড়ের ছিলেন না, ইন্দোরের, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন থেকে আসা ১৯৯২-এ। ১৯৯৪-এর পর ছত্তিশগড়ের বা মহারাষ্ট্রের ডাক্তাররা এসেছেন বা আসছেন বটে, তবে না নিছকই সরকারী চাকরী বা পোস্টগ্র্যাজুয়েটে চান্স পাওয়ার আগের সময়টুকুর জন্য।
একটা সমস্যা দেখা যেতো—হাসপাতালের সব চিকিৎসাকর্মীই শ্রমিক-কৃষক পরিবার থেকে আসা। নিয়োগের সময় মুক্তি মোর্চার আন্দোলনের প্রতি তাঁদের আগ্রহ কতটা তাও দেখা হতো। তবু এঁদের মধ্যে অনেকে শহীদ হাসপাতালে কাজকে অন্য দুটো চাকরীর মতোই দেখতেন। স্বাস্থ্যের রাজনীতি, সাধারণ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, দেশের বিশেষ-বিশেষ ঘটনাগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ, সংগঠন ও আন্দোলনের কাজে যুক্ত করা, ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হতো।
গুরুতর সমস্যা—শহীদ হাসপাতালের পরিচালনায় অনেকটা ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করতেন শ্রমিক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। দেখা যেত তাঁরা যখন ম্যানেজারের কাজ করেন, তখন তাঁদের কয়েকজনের মধ্যে বিচ্যুতি দেখা যায়। খনিতে বিএসপি বা ঠিকাদারের ম্যানেজার যেমন ব্যবহার করে শ্রমিকদের সঙ্গে, তেমন ব্যবহার করতেন তাঁরা হাসপাতালের অন্য কর্মীদের সঙ্গে। তাই নিরন্তর মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হতো।
বিপরীত যাত্রা
১৯৯১-এ নিয়োগীর শহীদত্বের পর সংগঠনের নেতৃত্বের এক প্রভাবশালী অংশ সংগঠনকে প্রথমে শ্রেণীসংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়, সদস্যদের বড়ো অংশ বিরোধিতা করায় সংগঠনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জন দিতে থাকে। শহীদ হাসপাতালের ডাক্তাররা কেবল হাসপাতালে ডাক্তারী করার জন্য যাননি, তাঁরা ছিলেন ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সারা-সময়ের কর্মীও। তাই এই অবস্থায় আমি-সহ কয়েকজন শ্রেণীসংগ্রাম বনাম শ্রেণীসমঝোতা, সংগঠনে গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের মতাদর্শগত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৯৪-এ মেশিনীকরণের পক্ষে নেতাদের এক সমঝোতাকে বিরোধিতা করে প্রথমে সাসপেন্ড, পরে বহিষ্কৃত হই আমি, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ পাইনি। এই প্রথম শহীদ হাসপাতালে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যা হাসপাতালের ডাক্তার ও কর্মীরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নেননি। এই ঘটনার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন দু’জন ডাক্তার, রয়ে গেলেন দু’জন। এই সময় থেকে পিছনে হাঁটা শুরু।
যে দু’জন রইলেন তাঁদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ বছর দুয়েক শহীদ হাসপাতালে ছিলেন না, সেই সময়ে অন্যজন রোজগার বাড়ানোর নামে কেবিন চালু করলেন, অথচ সবার জন্য সমান পরিষেবাই ছিল আমাদের মন্ত্র।
কর্মীদের সবার ও ডাক্তারদের সবার ভাতা ছিল এক, কর্মকুশলতার নামে তাঁদের কিছুজনের ভাতা বাড়িয়ে দেওয়া হল। কর্মীরা হরতালে গেলেন।
নতুন কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে এলেন দুর্নীতি—হাসপাতালে প্রচুর রোগী, খেয়াল রাখার লোক কম, রাতে অপারেশন করে ভোরে ছেড়ে দেওয়া হতে থাকল, হাসপাতালে হিসেব রইল না, সেই ডাক্তার ও তাঁর চক্রের কয়েকজন কর্মী পয়সা ভাগ করতে লাগলেন।
শহীদ হাসপাতালের সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ ছিল তিক্ততায় ভরা, তাই অনেক দিন যাইনি। ১৩ বছর পর ডা বিনায়ক সেন যখন প্রথম বারের জন্য জেল-বন্দী তখন এক মিটিং-এ অংশ নিতে যাই শহীদ হাসপাতালে। মনে হয়েছিল না গেলেই বোধ হয় ভালো হতো। হাসপাতাল আয়তনে বেড়েছে অনেক গুণ, কিন্তু পিছন দিকে হাঁটছে—
- ওষুধের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার সেখানে করা হয় না।
- ১৯৯৪-এর পর স্বাস্থ্যপুস্তিকা বেরিয়েছে মাত্র একটা—সিকল সেল এনিমিয়া নিয়ে।
- শ্রমিক-কর্মীরা ম্যানেজারি করছেন—ম্যানেজারের আচরণ নিয়ে।
- কর্মীদের একাংশ দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে পড়েছেন।
- বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের পদ এখন ডিরেক্টরের।
- রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ কানে এসেছে।…
আসলে রাজনীতি নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে (politics in command) না থাকলে তো এমনটাই হওয়ার কথা।
তবু শহীদ হাসপাতাল বেঁচে আছে
বেঁচে আছে চেঙ্গাইলের শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, বেলিয়াতোড়ের মদন মুখার্জী স্মৃতি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে, চন্ডীপুরের ডা নর্মান বেথুন জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র-বারাসত সিটিজেন্স ফোরাম-জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন-মাথাভাঙ্গার ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে, নৈহাটির স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ ক্লিনিক, দত্তাবাদের প্রচেষ্টা-স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ ক্লিনিকে…. আমরা শহীদ হাসপাতালের শিক্ষাগুলোকে আরও বিকশিত করে চলেছি এই কেন্দ্রগুলোতে। নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকরা আকৃষ্ট হচ্ছেন, নতুন মূল্যবোধের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী গড়ে উঠছেন।
শহীদ হাসপাতালকে নিয়েও আশা শেষ হয়ে যায় নি
কেন না সেখানে এখনও আছেন আমাদের সহকর্মী ডা শৈবাল জানা, প্রধান সেবিকা আল্পনা দে সরকার। কাজের চাপে তাঁরা আদর্শগত বিষয়গুলোতে নজর দিতে পারেন নি এমনটাই ভেবে নেবো। যোগ দিয়েছেন মেডিক্যাল ছাত্র আন্দোলনে আমাদের নেতা ডা দীপঙ্কর সেনগুপ্ত। যোগ দিয়েছেন স্ত্রীরোগবিদ ডা শীলা কুন্ডু। আদর্শবান মানুষরা অনেকে মিলে আবার আদর্শের পথে শহীদ হাসপাতালকে ফিরিয়ে আনবেন—এমন আশা করাই যায়।
স্বপ্ন আর বাস্তবের মেলবন্ধন।