ডাঃ ড্যানিয়েল কারলেট গজডুসেকের রাতের ঘুম চলে গেছে। একটা রোগ হাজার হাজার লোকের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, আর সেটাকে শুধু মানসিক রোগ বলে এড়িয়ে যাওয়া কি উচিৎ হচ্ছে!
অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্র পাপুয়া নিউগিনি। জঙ্গল, পাহাড় আর নদীতে ভরা। অনেক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বসবাস সেখানে। তার মধ্যে একটি হল ফোর জনগোষ্ঠী।
এই ফোর জনগোষ্ঠীর লোকেরা প্রকৃত অর্থেই একেবারে অসভ্য। পশ্চিমি সভ্যতার কোন প্রভাবই তাদের উপর পড়েনি। যদিও শ্বেতাঙ্গদের সাহায্য ছাড়াও অনেক জনগোষ্ঠী রীতিমতো সভ্য হয়ে উঠেছে। তারা নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা গড়ে তুলেছে। কিন্তু ফোর গোষ্ঠীর মানুষেরা এখনও রয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর পেছনে। ডাইনি, অপদেবতা এইসবে পরিপূর্ণ তাদের অন্ধকারময় জীবন। অরণ্যের বা নারীর অধিকারের জন্য নিজের বা অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষের সাথে খুনোখুনি তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সবচেয়ে বীভৎস ব্যাপার হ’ল, তারা মানুষের মাংস খায়।
যুদ্ধে নিহত শত্রুর মাংস তো বটেই, এমনকি আত্মীয় স্বজন কেউ মারা গেলে তাকেও বাদ দেয় না। কেটে কুটে, আগুনে ঝলসে বা রীতিমতো রান্না করে মানুষের মাংস খাওয়া হয়। সমস্ত গ্রাম জুড়ে যেন উৎসব চলে। শিশু, মহিলা সকলেই পেট পুরে নরমাংস খায়।
এদের মধ্যেই ইদানীং একটা অসুখের বাড় বাড়ন্ত দেখা গেছে। অসুখটাকে ফোর জনগোষ্ঠীর মানুষরা নাম দিয়েছে কুরু। ফোর ভাষায় কুরিয়া শব্দের মানে কাঁপা। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের শরীর ক্রমাগত কাঁপতে থাকে।
তারা অবশ্য একে রোগ ভাবতো না। তাদের বিশ্বাস, এই রোগ ছিল ডাইনির অভিশাপ। ডাইনি যাকে ভর করত, আস্তে আস্তে সে দুর্বল হয়ে যেত। খাওয়া দাওয়া কমে যেত ও এক পর্যায়ে তা বন্ধ হয়ে যেত। তার হাত পা কাঁপতে শুরু করত। নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকত না নিজের হাত পা। কাঁপুনি শুরু হত সারা শরীর জুড়ে। ডাইনি আক্রান্ত লোকটির কথা বন্ধ হয়ে যেত। সারাদিন চুপচাপ পরে থাকত সে। মুখ থেকে একটি কাতর আওয়াজও বার হতো না।
এর পরের পর্যায়ই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এতদিন চুপ করে থাকা ডাইনি আক্রান্ত মানুষটি হঠাৎ হাসতে শুরু করত হো হো করে। হাসতে হাসতে শ্বাস কষ্ট উঠে যেত, দম আটকে আসত, হেঁচকি শুরু হত। তবু তার হাসি বন্ধ হত না।
জনগোষ্ঠীর অন্য মানুষগুলি বিশেষ কিছু করার ছিল না। প্রথম প্রথম তারা ঝাউ গাছের ছাল আর শুয়োরের মাংস থেকে তৈরি ওষুধ খাওয়াতো। হাসি আরম্ভ হলে বুঝতে পারত আর কিছু করার নেই। ডাইনি আক্রান্ত ব্যক্তির আয়ু ফুরিয়েছে। তারা বড় বড় ছুরি বার করে ধার দিত আর প্রতীক্ষা করত। হাসতে হাসতে লোকটি মারা গেলে তাঁকে কেটে কুটে মহাভোজ শুরু হবে।
এই হাসির জন্য শ্বেতাঙ্গরা এই রোগের নাম দিয়েছিল লাফিং সিকনেস। ১৯৫৩ সালে অফিসার জন ম্যাক আর্থার বেশ কিছু রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, এটি একটি মানসিক অসুখ। এবং এই তীব্র মানসিক বিকারের জন্য তিনি ফোর জনজাতির মানুষদের কুসংস্কার এবং কালো যাদু চর্চাকে দায়ী করেন।
১৯৫৭- ১৯৬০ এর মধ্যে কুরু রোগ প্রায় মহামারির মতো ছড়িয়ে যায়। এক হাজার জনেরও বেশি ফোর উপজাতির মানুষ মারা যায়। ডাঃ গজডুসেক কিছুতেই মানতে পারছিলেন না একটি মানসিক রোগ এতো গুলো মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তখন জার্ম থিয়োরির রমরমা। তিনি আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তে, শ্লেষ্মায় জীবাণু খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু রাত দিন চেষ্টা করেও সফল হলেন না।
এই কাজে তিনি সহকারী পেলেন ডাঃ ভিনসেন্ট জিগাসকে। জার্ম থিয়োরি দিয়ে মেলাতে না পারলেও তারা হাল ছাড়লেন না। দুজনে লক্ষ করলেন এই রোগ হচ্ছে মূলত শিশু আর মহিলাদের মধ্যে।
এরপর তাঁরা মানুষের মাংস খাওয়ার সাথে কুরু রোগের সম্পর্ক খুঁজে বার করার চেষ্টা শুরু করলেন। তাঁরা এক আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলেন। ফোর উপজাতির রীতি অনুযায়ী মৃত মানুষের মস্তিষ্ক শুধু শিশু আর নারীরাই ভক্ষণ করে। পুরুষরা সাধারণত মাংস খায়। তাহলে কি মৃত মানুষের ঘিলু খাওয়ার সাথে কুরু রোগের কোনও সম্পর্ক আছে?
তাঁরা একটি অত্যন্ত সহজ সরল পরীক্ষা করলেন। কুরু রোগে মৃত একটি এগারো বছরের মেয়ের ঘিলু কয়েকটি শিম্পাঞ্জিকে খাওয়ালেন। বছর দুয়েকের মধ্যেই ডেইজি বলে একটি শিম্পাঞ্জির মধ্যে কুরু রোগের লক্ষ্মণ প্রকাশ পেল।
তাঁরা মৃত মানুষের মস্তিষ্ক ব্যবচ্ছেদ করে দেখলেন ঘিলুটা কেমন স্পঞ্জের মতো হয়ে গেছে। মৃত শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কেও একই রকম পরিবর্তন পেলেন। তাঁরা নিশ্চিৎ হলেন মৃত মানুষের মস্তিষ্ক খেয়েই এই রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আরও বুঝতে পেরেছিলেন, ম্যাড কাউ রোগে মৃত মানুষদের মস্তিষ্কের সাথে কুরু রোগীদের মস্তিষ্কের পরিবর্তনের মিল আছে।
এই আবিষ্কারের জন্য ডাঃ ড্যানিয়েল কারলেট গজডুসেক ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরষ্কার পান। পরবর্তীকালে জানা গেছে এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের চেয়েও সরল গঠনের এক রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটিন অণু। যার নাম প্রায়ন প্রোটিন। কুরু ছাড়াও ক্রোয়েজফেল্ট-জ্যাকব, ম্যাড-কাউ, স্ক্রাপি প্রভৃতি রোগের জন্যও দায়ী এই প্রায়ন প্রোটিন। এরা মস্তিষ্কের কোষকে নষ্ট করে স্পঞ্জের মতো করে ফেলে। একে বলে স্পঞ্জিফর্ম এনকেফালোপ্যাথি।
কুরু রোগ ঠেকানোর জন্য ১৯৬০ সালে সরকার আইন করে নরমাংস খাওয়া বন্ধ করে দেয়। ম্যাজিকের মত রাতারাতি কুরু রোগীর সংখ্যা কমে যায়। তারপরেও বছরে একটি দুটি করে রোগী পাওয়া গেছে তার প্রধান কারণ নরমাংস খাওয়ার পরেও কুরু রোগ হতে অনেক সময় ১০ থেকে ৫০বছর (Long Incubation period) লেগে যায়। ২০০৫ সালের পরে নতুন করে কুরু রোগ পাওয়া যায়নি।
মাছের মাথায় কোনো সমস্যা নেই তো?? ??
খুব ভালো লাগলো। নতুন তথ্য।
দারুন ।।।।।
অনবদ্য
দারুণ। অনেককিছু জানতে পারলাম।
এই রোগ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম ।
দারুণ। যত গন্ডগোল ওই মগজেই।
Amezing
Like!! Great article post.Really thank you! Really Cool.
I am regular visitor, how are you everybody? This article posted at this web site is in fact pleasant.
These are actually great ideas in concerning blogging.