প্রত্যেক পরিবারের কাছে নবজাতক শিশুই তার বর্তমানের আনন্দ, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। প্রত্যেক মা-বাবাই নবজাতককে তাদের অস্তিত্বের নিদর্শন হিসাবে রেখে যেতে চান। তাই সংসারে যে নতুন অতিথির আগমন ঘটলো তাকে নিয়ে মা-বাবার আনন্দের যেমন শেষ থাকে না, তেমনি দুশ্চিন্তারও কোন শেষ থাকে না। তাকে কি করে ভালো রাখা যায়, কি করে শিশু ভালো থাকবে তাই নিয়েই মা-বাবা ব্যস্ত থাকেন। এখনকার দিনে চিন্তা আরো বেশি, কারণ এখন বড়োজোর একটি কি দুটি বাচ্চা হয়। তাই অনভিজ্ঞ মা-বাবা বুঝতে পারেন না কিভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া উচিৎ। অজ্ঞতার কারণে বা প্রতিবেশী সাবেকি দাই বা বয়স্কদের কথামতো এমন কিছু কাজ করেন, যা করা উচিৎ নয়। যেমন স্নান করানো। অনেক পরিবারে শিশু জন্মানোর সাথে সাথে তাকে স্নান করিয়ে দেওয়া হয়। এটা একদম করানো উচিৎ নয়। এর বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে। আসুন, যুক্তির এবং বিজ্ঞানের আলোকে দেখি—প্রাণ ভরে দাও আরো প্রাণ
দাও আরো মুক্ত শুদ্ধ বায়ু
আলো, আরো আলো দাও
দাও মোরে অক্ষয় পরমায়ু
–এটাই শিশুর কচিকন্ঠের কাতর আবেদন তার ভূমিষ্ঠ হবার ক্ষণে। শিশুর ভূমিষ্ঠ হবার ক্ষণটি তার নিজের এবং পরিবারের কাছে সারা জীবন মনে রাখার মতো ঘটনা। পরিবারের সবাই সেই ক্ষণে শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে শিশুকে স্বাগত জানায়। সেই মুহূর্তে আকাশে বাতাসে আলোড়ন ওঠে, সে এসেছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে খবর ছোটে। সবাই শিশুকে তার নিজের মতো করে গ্রহণ করে নেয়।
কিন্তু যে এলো, সে কিভাবে এলো? কোথায় এলো? তার কাছে পৃথিবী কেমন? কোথা থেকে এলো? কোন পরিবেশে এলো? আসুন, দেখে নিই।
এতদিন শিশু মায়ের জঠরে ছিল মায়েরই একটি অংশ হয়ে। এই প্রথম শিশু তার নিজের অস্তিত্বে এলো। একদিকে তাকে খেতে হবে, শ্বাস নিতে হবে, বাঁচতে হবে। অথচ করার কিছু নেই। ধরে খাবার ক্ষমতা নেই। কিভাবে খেতে হবে জানে না। কাউকে কিছু বলে বোঝাতে পারে না। চাইতে পারে না। এমন কি কম ওজনের ছোট শিশুর খাওয়ার ক্ষমতাও থাকে না।
যেখান থেকে এলো সেখানকার তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রায়। আর এসে পড়লো কোথায়? শীতের দিনে ১০ বা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, গরমে ২৫-৩০ ডিগ্রিতে। অর্থাৎ হঠাৎ তাপমাত্রা কমে গেল ৫-২৫ ডিগ্রি।
কেউ কি দেখেছেন, এমন হলে কেমন লাগে? আমাদের হঠাৎ করে বরফের ঘরে ঢুকিয়ে দিলে যেমন লাগবে, প্রায় সেরকমই। ঠান্ডা। অথচ ঠান্ডা লাগলেও বলার উপায় নেই। কিছুই বলতে পারে না সে। তার উপর যদি ঠাকুমা, দিদিমারা তাকে স্নান করায়, তবে?
এতো পরের ব্যাপার। তার আগে আরো আছে। আমরা জানি অক্সিজেন না হলে মানুষ একদন্ড বাঁচে না। আমাদের শ্বাস নেবার সময় বাতাসের অক্সিজেন ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে রক্তে ঢোকে। রক্তের হিমোগ্লোবিন তাকে ধরে নিয়ে কোষে কোষে পৌঁছে দেয়। গর্ভাবস্থায় এই অক্সিজেন ধরার কাজটি করে দিত মা। মায়ের রক্ত থেকে হিমগ্লোবিন যেত ভ্রূণের রক্তে।
কিন্তু জন্মাবার পর মুহূর্তে? নাড়ি কাটার সাথে সাথে মায়ের কাছ থেকে অক্সিজেন পাওয়া গেল না। নবজাতক নিজে জন্মালো তার ফুসফুসভর্তি জল নিয়ে। সেখানে কোন হাওয়া নেই। জন্মাবার পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপে এদিক সেদিক চাপ খেয়ে কিছুটা জল বেরিয়ে গেল। কিছুটা থাকলো ফুসফুস ভর্তি হয়ে।
কিন্তু শিশুকে বাঁচতে হবে। অক্সিজেন চাইই চাই। ঠান্ডায় কাঁপলে চলবে না। আগে বাঁচা, তারপর অন্যসব। হাওয়া চাই, অক্সিজেন চাই। আর এই পরিস্থিতিতেই সে নিজের বাঁচার জন্যই চীৎকার করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো।
বাইরের লোক শুনলো, ম্যাম্যা, প্যাঁ, প্যাঁ- শাখ বাজলো উলুধ্বনি শুরু হলো দিকে দিকে বার্তা রটে গেলো। ডাক্তার নিশ্চিন্ত হলো, দাই নিশ্চিন্ত হলো। বাচ্চা কেঁদেছে।
কিন্তু কোন কারণে– শারীরিক অক্ষমতার জন্যে বা অপুষ্টির জন্যে যদি সে শ্বাস নিতে না পারে? তখন? তখন তার শরীর নীল হতে শুরু করে। আরো নীল নেতিয়ে যায় একেবারে এবং আশেপাশে থাকা ডাক্তারবদ্যি-সিষ্টার মিলে তাকে কাঁদবার জন্যে আপ্রান চেষ্টা করে, শুধু একবার কাঁদুক। একবার শ্বাস নিক। অক্সিজেন আসে, যন্ত্রপাতি আসে। তা সত্বেও কাজ না হলে নবজাতকের মস্তিষ্কের কোষ মরতে শুরু করে। আর মস্তিষ্কের কোষ মরে গেলে আর জন্মায় না, সারা জীবনের জন্যে সেই কোষ অকেজো হয়ে যায়। ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘সেরিব্রাল অ্যানক্সিয়া’। ফল বড় হয়ে বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় না। না মানসিক, না শারীরিক। সে চলতে পারে না, বলতে পারে না। মা-বাবার সারাজীবনের দুঃখ ও বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ রোগের ডাক্তারি নাম ‘সেরিব্রাল পলসি’। কম ওজনের শিশুদের বা আগে জন্মানো শিশুদের এই রোগ বেশি হয়।
কাজেই শিশু গর্ভাবস্থায় যাতে ঠিক বাড়ে,পুষ্ট হয়, নিশ্চিত করতে মায়ের গর্ভধারণ হবার পর থেকেই স্ত্রী-রোগবিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।
সব আয়োজন সত্বেও কিছু নবজাতককে শ্বাস নেওয়ানো যায় না। সেখানেই তার পরমায়ু শেষ।
যারা শ্বাস নিলো অর্থাৎ অক্সিজেন ধরতে পারলো, তাদের রক্তের কাজ হলো সেই অক্সিজেনকে বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেওয়া। আর এই রক্ত চালানোর পাম্পের কাজ করে হৃদযন্ত্র। শিশুর হৃদযন্ত্র গর্ভধারণের ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শুরু করে। কাজেই কাজটা তার কাছে নতুন নয়। কিন্তু গর্ভাবস্থায় তাকে মায়ের রক্ত নিয়ে চলতে হতো, মা সেটি শোধন করে দিত। এখন সে নিজেই এসব করছে। কাজেই হৃদযন্ত্রের কাজ কিছু এদিক ওদিক করতে হয়, হৃদযন্ত্রের অনেক ফুটো বন্ধ করে দিতে হয়। সারা শরীরবৃত্তীয় কাজে একটা আমূল বোঝাপড়া করে নিতে হয়। অক্সিজেন সহজে পেলে এই কাজগুলো সহজে হয়। অক্সিজেন না পেলে এখানেও গোলমালের সম্ভাবনা থাকে। জন্ম থেকেই হৃদযন্ত্র অস্বাভাবিক থেকে যায়।
এবার আগের কথায় আসি। সেই তাপমাত্রার কথায়। দেখি, যার জন্যে এত সব আয়োজন, এত কোলাহল, সে এলো যেখান থেকে সে কেমন জায়গা। কথায় ছিলো সে এতোদিন?
চল্লিশ সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে সে শরীরের আকার পেয়েছে। শুরু করেছিল একটি কোষের থেকে, যা তার মায়ের শরীরেরই একটি অংশ ছিল। তারপর সেটি নিষিক্ত হলো পিতার শুক্রাণুতে – শুরু হল কোষবিভাজন। একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি, তার পরে অনেক, তারপর অসংখ্য। তৈরি হল ভ্রূণ। ভ্রূণের হাত-পা গজালো, মুখ তৈরি হলো, অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি হতে থাকলো।
এ যেন নরম একতাল মাটি। তার উপর বিধাতা নিজের হাতের পালকের হাল্কা ছোঁয়ায় একটু একটু করে এঁকে দিচ্ছেন তার সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর বস্তুটিকে। একটুও চাপ না লাগে। লাগলে গলে যাবে বা বেঁকে যাবে। তাকে রাখতে হবে এমন জায়গায়, যেখানে কোন আঘাত লাগবে না। তাই জঠরে শিশুর চারিদিক ঘিরে রাখে জলের মতো অ্যামনিয়টিক ফ্লুইড। শিশু জলে ভাসতে থাকে।
তাকে রাখতে হবে এমন তাপমাত্রায়, যেখানে ঠান্ডা-গরমের ভয় নেই। তাপমাত্রা সব সময় মায়ের শরীরের সমান। তার জন্যে সবকিছুই করে রাখা আছে-কারণ একটু এদিক ওদিক হলেই বিকৃত হবে নবজাতক, বিকৃত হবে মানুষের উত্তরসূরী। তা কোন মতেই হতে দেওয়া যাবে না। তাই তার স্থান হলো মাতৃজঠরে। ডাক্তারি পরিভাষায় ইউটেরাসের মধ্যে।
জঠর বা ইউটেরাস কেমন? এর তুলনা চলে ফুটবলের সাথে। হাওয়ার বদলে যদি ফুটবলের ব্লাডারে জলভরা হয়, তবে যেমন হত-অনেকটা সেরকম। বাইরে মাংসল শক্ত আবরণ। তার মধ্যে ব্লাডারের মতো অ্যামনিয়টিক ক্যাভিটি। তার মধ্যে জল। সেই জলের মধ্যে আলতো ভাবে শুয়ে থাকে মানবসন্তান।
সেখানে ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, গরম নেই, ঠান্ডা নেই।সবসময় তাপমাত্রা ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। মায়ের রক্তের বা শরীরের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা। একমাত্র মায়ের সাথেই তার সম্পর্ক। কোন কারণে মায়ের শরীরের তাপমাত্রা ওঠানামা করলে তবেই সেখানকার তাপমাত্রার পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেখানেও বিপদ। বেশি ওঠানামা সে সইতে পারে না।এ যেন সেই জগন্নাথের মূর্তি তৈরী। কোনো রকম চাপ তাপ পড়লে অপূর্ণ অবস্থায় বেরিয়ে আসবে মানবের উত্তরসূরী- ভ্রূণ অবস্থায়। বাইরে থেকে আমরা বলবো ‘মিসক্যারেজ’। সাদা বাংলায় গর্ভপাত।
সেইজন্য গর্ভবতী মায়েদের রাখতে হয় আলতো করে। তাদের শরীরের উপর নজর দিতে হয় সবসময়। গর্ভবতী মায়েদের জ্বর বেশি হলে সমস্যা। সমস্যা পায়খানা বমি হয়ে গা হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলে। তেমনি যে কোন আঘাত থেকেও তাকে থাকতে হবে দূরে।
তাপমাত্রার থার্মোষ্ট্যাট রয়েছে মাথার মধ্যে হাইপোথ্যালামাসে। সে নিয়ন্ত্রণ করছে শরীরের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের দিনে বাইরের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি হলেও তাপমাত্রার তফাৎ হলো ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। কাজেই যে শিশু নতুন আলো দেখবে বলে এলো– সে প্রথমেই এলো বরফের দেশে। তার শ্বাস নেবার ক্ষমতা জন্মায়নি, চোখে তখনো আবছা দেখে, কথা বলতে পারে না। হাতপা বের করেই বুঝলো বরফের দেশে এসেছে। সে তাপমাত্রা বাড়াতে চেষ্টা করলো, কাপতে শুরু করলো– হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করলো যাতে পেশির সংকোচন-প্রসারনের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়।
তখন তার দরকার উষ্ণ অভ্যর্থনা। গরম ঘরে, গরম কাপড়ে, গরম হতে। সেই জন্ম মুহূর্তে বাড়ির লোকের বা মায়ের কিছু করণীয় নেই। হাসপাতালের ডাক্তারবদ্যিরা ত্পাতালে। কিন্তু তারপরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব, মাকেই তার কোলের মধ্যে শিশুকে জড়িয়ে নিয়ে থাকতে হবে।মায়ের শরীরের গরমেই সে গরম থাকবে। মায়ের গায়ের গন্ধে, দুধের গন্ধের মধ্যে সে ধীরে ধীরে নিশ্চিন্তে বড়ো হয়ে উঠব। চোখ মেলে সে মাকেই আগে দেখবে।তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল তার মা।
আর আমরা স্লোগান তুলবো-‘মায়ে-ছায়ে গায়ে-গায়ে’। না কোন আলাদা গদি নয়, হিটার নয়, মা-ই তার সবকিছু।
সব শিশুর জন্মমুহূর্ত তাই শুধু পরিবারের কাছে নয়, তার নিজের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঁচা-মরার লড়াই।