মুখোশের আড়ালে কারুর মুখে আজকাল হাসি নেই। সক্কলের মন বড্ডই খারাপ। একটা ছোঁয়াচে রোগ বিচ্ছিরি হাওয়ার মতো হুহু করে ছড়াচ্ছে। আমাদের হাতুড়ে বুড়োর মনটনও খারাপ। কয়েক টন খারাপবাসা সব ভালবাসাকে হারিয়ে দিয়ে মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। একটা পুরোনো নীল শিখাহীন লাইটার হাতে নিয়ে বুড়ো খালপাড়ে যতোবার আলো জ্বালাবার চেষ্টা করছে ততবারই নিভে যাচ্ছিলো। অবশেষে সিগারেটে আগুন ধরলো। হুহু হাওয়া বয়ে এলো। বুড়োর মুখে হাসি ফুটলো।
কোন যেন উদাসী সাইকেলওয়ালা সাইকেলে এফএম বাজিয়ে যাচ্ছে। চাকায় চাকায় সুর বাজছে– ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে …..
বুড়োর মনে আসে মুখার্জির কথা। তখন বাইশ দিনের তফাতে বুড়োর মা বাবা দুজনেই চলে গেছেন অন্য কোথাও। তীব্র সংস্কার-বিদ্বেষী হাতুড়ে দ্বিধাগ্রস্ত। মা বাবার জীবৎকালে ওদের জন্য যা যা করা উচিত ছিল কিছুই তো করা হয় নি। এ যদি পাপ হয় তাহলে তো ক্ষমাও চাওয়া তো হয়নি ঐ দুজন মানুষের কাছে। এখন কী করে চাইবে ক্ষমা?
তবুও টাকা বড়ই গরজ। ধারদেনায় তখন জর্জরিত বুড়ো- শোধও তো করতে হবে তাই ভাঙা মনে শুরু হয় রোগী দেখা আর খুপরিযাপন।
সেদিন একটু ভীড় ছিলো। ঐ ভীড়ের মধ্যে একটি মেয়ে (নাকি মহিলা?) বহুক্ষণ হলো বসে আছে। দেখে রোগী বলেও মনে হচ্ছে না। কোন এক মনের কোণায় মনে হয় মুখটি বড়ো চেনা চেনা। বহুক্ষণ বসে আছে। হাতে একটা থলি।
“আপনি নাম লেখেননি?”
মেয়ে অভিমানে ঘাড় নাড়ে, “না”।
বুড়ো একটু তাকিয়ে থাকে। স্মৃতি হাতড়ায় “অনেক গুলো সাত আছে আপনার ফোন নম্বরে, তাই না?”
কন্যার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। “এখন আর ঐ নম্বরটা নেই– আমি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে এসেছি।”
(বুড়োর মনে পড়ে এই মেয়েটার বাবা এই হাতুড়ের হাতেই মারা গেছিলেন), হাতুড়ে বুড়ো বাকি রোগীদের মুখে প্রশ্রয়ের ছাপ দেখে কন্যাকে ভেতরে ডাকলেন।
দীর্ঘাঙ্গী নিচু হয়ে প্রণাম করতে গেল। হাতুড়েবুড়ো ভারি আপত্তি করে ওঠেন। মেয়েটি উঠে চোখে চোখ রাখে। “মেয়ে বাবাকে প্রণাম করবে তাতে তোমার আপত্তি কিসের?”
বাক্যহারা বুড়ো প্রণাম গ্রহণ করেন। মেয়েটি একটা পাজামা পাঞ্জাবি বার করে হাতে তুলে দ্যায় “নাও এটা পরবে।”
কেনো কে জানে হাতুড়েবুড়ো মেয়েটিকে খুপরি থেকে ঠেলে বার করে দেন।
অদম্য বালিকা দরজা ঠেলে ফিরে আসে। হেসে বলে “ওও এইজন্যে বার করে দিলে?” সাদা ওড়নায় বুড়োর চোখ মুছে দ্যায়। একগাল হেসে বলে “এটা নেবে না? মান্না দের সব গান আছে এতে …..তুমি তো গান ভালবাসো?”
কদিন আগে বহু সাধনায় কন্যার একটি ছানা হয়েছে। হাতুড়ে প্রার্থনা করে হে সপ্তর্ষি, হে আলোকবর্ষ দূরের নীহারিকা তোমরা দেখো ওরা যেন এই অস্থির সময়ে ভালো থাকে। হ্যাঁ ঐ মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে গানটি দিয়েই ঐ লম্বা মেয়েটার মান্নার গানের সঙ্কলনটা আরম্ভ।
ক্যাডবেরি যদি সিঁদুর পরে ‘আঙ্কেল’ হয়, তখন বুড়োর মন ভালো হয়। তখন বুড়োর মা স্মৃতিভ্রষ্টা। হাসপাতালে। জ্যৈষ্ঠের তপ্ত সন্ধ্যা। একটা ঘুপচি খুপরিতে বুড়ো টাক ঘামিয়ে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করছে। একটি মোটাসোটা গোলগাল ঘেমে লাল মেয়ে এসে হাজির। “কাকু আজ তোমার জন্মদিন না?” ছোট্ট বেলা থেকেই ক্যাডবেরি বিনিময় প্রথায় উভয়ের ভাব ভালবাসা জমে ওঠে। এখন অবশ্য বছর খানেক একটু ঝড়বাদলে অভিমান চলছে। সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। পরে ভুল বোঝাবুঝি ঠিক বোঝাবুঝি হয়ে উঠবে। সেই তপ্ত সন্ধ্যায় সেই মেয়েটি হাতুড়ের ক্যাডবেরি আঙ্কেল এক টিফিন কৌটো পায়েস করে এনেছে। হঠাৎ করে সেই ক্যাডবেরি আঙ্কেল সেদিন কি ভাবে যেনো ছোট্ট মা হয়ে উঠলো। রোগীদের আটকে রেখে বুড়োকে পায়েস খাইয়ে তবে গেলো সেই ডাকাতিয়া মেয়ে।
অথবা সেই মৃত্যু রহস্য। ঈনা মীনা খাতুন দুই বোন। একটি বোবা কালা। মা পরের বাড়িতে কাজ করে। বাস স্ট্যান্ডের পাশে খালপাড়ে মসজিদের গায়ে যে বস্তি সেখানকার আদি এবং পাকা বাসিন্দা। বাবা বেকার। ভাই তালা চাবি সারায়। ওদের পাড়ারই এক বুড়ো– অবশ্যই হাতুড়ের রোগী সে। ফুসফুসের ক্যানসারে মারা গেছে– বুড়োর ছেলেপুলেরা এসে ডেথ সার্টিফিকেট চাইলো। ক্যানসারের রোগী – শেষ অবস্থায়ই ছিলো।
হাতুড়ে বললো “ঠিক আছে চেম্বার শেষে যাবো”।
কিছু পরে ঈনা মীনা খাতুনের মা এসে হাজির। হাতে পায়েসের বাটি নেই কিম্বা নেই নতুন জামা কাপড়। উল্টে ওর বেশ আলুথালু। হিজাবের হদিশ নেই। গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ। “ডাক্তার দাদা তুমি যেওনা– পায়ে পড়ি ওদের সাট্টিফিকে দিও না।”
অনেক কষ্টে জানা গেলো ঐ ক্যানসারের বুড়োকে কারা যেনো সম্পত্তির লোভে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে। দাদা তুমি যেও না….. তারপর সে এক মস্ত ঘটনা। কবর থেকে মৃতদেহ তোলা ….. পুলিশ … আরও কত কী….
এই সব স্মৃতির মাঝে যেমন দিন কেটে যায়। তেমনি করোনাও চলে যাবে কিন্তু এই সব ভালবাসার কোলাজগুলো টুকরোটাকরা জমতে থাকবে। ডাক্তার সিগারেটের ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় নানা ছবি দেখে আপন মনে হেসে উঠবে। রাস্তার কুকুরগুলো অবাক হয়ে বুড়োর পা চেটে দেবে। হাতুড়ে খুব ভালো আছে।
অসামান্য এক জীবনের জলছবি!