(১
বাবলুর দুষ্টুমির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ক্লাস এইটের মিড-সেশনেই সতীশবাবু ওকে পুরনো স্কুল ছাড়িয়ে একটি মিশনস্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। মিশনের মহারাজের সঙ্গে বহুদিনের চেনা পরিচিতি থাকার জন্য সতীশবাবুকে ভর্তির ব্যাপারে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। হোস্টেলের অ্যালোটেড ঘরে বাবলুকে ঢুকিয়ে দিয়ে গজড়াতে গজড়াতে বলেছিলেন,
— ফের যদি কোনোদিন কারও সাইকেলের টিউব নষ্ট করেছিস তাহলে জেনে রাখবি সেদিন থেকে তোর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। নিজের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা নিজে করে নিবি।
(২)
এমনিতে ছাত্র হিসেবে বাবলু বেশ ভালোই ছিল। ফার্স্ট-সেকেণ্ড না হলেও প্রতিবছর প্রথম দশেই থাকত ওর নাম। আর সে জন্যই বার দুয়েক ক্ষমাঘেন্না করে দিয়েছিলেন আগের স্কুলের হেডমাস্টার পঞ্চাননবাবু। কিন্তু যেদিন দেখলেন নিজের সাইকেলের সামনের টায়ারটা ফর্দাফাঁই হয়ে গেছে আর ভেতরের টিউবটা উধাও সেদিন আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। অপরাধী যে বাবলুই সেটা তিনি সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। কারণ, এরকম অদ্ভুত ঘটনা আগেও দু’বার ঘটেছিল আর দু’বারই বাবলু দোষ স্বীকার করে নিয়েছিল। বলতে পারেন, বাবলুর এটা একটা মস্ত বড় গুণ ছিল। সে অপরাধ করলেও কখনো তা লুকাতো না।
টিফিন আওয়ারে পঞ্চাননবাবু একটা মোটা বেত নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পেছনের মাঠে গিয়ে দেখেছিলেন বাবলু একমনে গুলতি দিয়ে পাখি মারছে। কোনোদিকে খেয়াল ছিল না ওর। বেতটা দিয়ে বাবলুর পেছনে চড়াম করে মারতেই ওর হুঁশ ফিরেছিল। তারপর হেডস্যার ওর কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনেছিলেন নিজের অফিসে।
— বল হারামজাদা, আমার সাইকেলের টায়ার কেন কেটেছিস?
বাবলু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
— বল। চুপ করে থাকবি না। কোথায় রেখেছিস টিউবটা?
— এই যে স্যার। গুলতির কালো রঙের রাবারব্যাণ্ডটি দেখিয়ে বাবলু উত্তর দিয়েছিল।
এরপর হেডস্যার মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন নি। বাবলুর বন্ধুরা বাইরে থেকে শুধু ঠাঁই-ঠাঁই, ঠাঁস-ঠাঁস আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে উঃ-আঃ, বাবাগো, মাগো, মরে গেলুম গো টাইপের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল।
(৩)
পরেরদিন যথারীতি স্কুলে ডাক পড়েছিল সতীশবাবুর। পঞ্চাননবাবুর সাথে প্রায় একঘণ্টা কথা হয়েছিল তাঁর।
— স্যার, তাহলে কী করবো?
— কী আর করবেন? ছেলেকে ডাক্তার দেখান।
— দেখিয়েছিলাম। কোনো লাভ হয়নি। এই রোগটা বেশ পুরনো। ওর সাত বছর বয়সে প্রথম লক্ষ্য করি। কী বলি বলুন তো! এই গুলতি বানানোর অত্যাচারে পাঁচ বছর হলো জাঙ্গিয়া পরাই ছেড়ে দিয়েছি। একটারও ইল্যাস্টিক গোটা রাখে নি।
— মানে! সেকি! আপনি নিচে কিছু পরেন না?
— না না। পরি তো! দড়ি দেওয়া আন্ডারওয়্যার।
— মিঃ পুরকায়েত, দ্যাট ইস ইওর প্রবলেম। আমরা আপনার ছেলেকে এই স্কুলে রাখতে পারছি না। এক্সট্রিমলি সরি! আপনি বাবলুকে কোনো মিশনের হোস্টেলে রাখুন আর পাশাপাশি ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।
(৪)
মিশনের কড়া শাসন কিম্বা সাইকিয়াট্রিস্টের সুচিকিৎসা যেটার প্রভাবেই হোক, আগামী পাঁচ বছর বাবলু আর গুলতিতে হাতই দিলো না। বাবলুর উচ্চমাধ্যমিকের মার্কস আর সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারবাবুর অনুপ্রেরণায় ডাক্তারিতে চান্স সকলকে চমকিয়ে দিয়েছিল সেদিন। সতীশবাবু এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলেন। বাবলুর পুরনো স্কুলে যথেষ্ট অপমানিত হয়েছিলেন তিনি। মনে পড়লেই বুকের বামদিকটা চিনচিন করে উঠতো।
সতীশবাবু সকাল সকাল এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পঞ্চাননবাবুর বাড়িতে।
— দেখলেন তো স্যার, সেদিন বাবলুকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে না দিলে আজ কার মুখ উজ্জ্বল হতো? বেশ বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন সতীশবাবু।
পঞ্চাননবাবু কোনো জবাব দিতে পারেন নি। শুধু বলেছিলেন,
— বাবলু আরও বড়ো হোক শুধু এই প্রার্থনা করি।
— আপনি বললেও হবে, না বললেও হবে। যাক মিষ্টিগুলো রেখে গেলাম। সময় করে খাবেন কিন্তু!
— সতীশবাবু, এগুলোর দরকার নেই। আমার হাই সুগার।
— দ্যাট ইস ইওর প্রবলেম, স্যার। আমার রেখে যাওয়া কর্তব্য তাই রেখে গেলাম।
অপমানের শোধ তুলতে পেরেছেন ঠিক এরকম একটা আত্মতুষ্টি নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে এসেছিলেন সতীশবাবু।
(৫)
দেখতে দেখতে বাবলু ডাক্তারিও পাশ করে গেল। এক সপ্তাহ আগেই ওর ফাইনাল এমবিবিএস এর রেজাল্ট বেরিয়েছে। এই খুশিতে বাবলু ফেসবুকে একটা পোস্টও করেছে, “নাও আই ক্যান অফিসিয়ালি রাইট মাই নেম অ্যাজ ডাঃ বাবলু পুরকায়স্থ।”
বাবলুর ইন্টার্নশীপ শুরু হয়েছে মেডিসিন দিয়ে। গতকাল সারা দিনে ওদের ইউনিটে তেইশজন জ্বর, সতেরোজন ডায়রিয়া, আটজন স্ট্রোক, পাঁচজন বুকে ব্যথা আর দু’জন সাপেকাটা রোগী ভর্তি হয়েছে। আজ পোস্ট-অ্যাডমিশন ডে। সবার ব্লাড ইনভেস্টিগেশন পাঠাতে হবে। পিজিটি, হাউসস্টাফ, সিস্টাররা রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন সময় একজন পিজিটি দাদা বাবলুর হাতে একটা বেড নম্বরের লিস্ট আর একটা টুর্নিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— যা চটপট ব্লাডগুলো টেনে ফ্যাল।
দেড় ঘণ্টা পরেও বাবলু যখন ব্লাড নিয়ে ফিরল না তখন ওর খোঁজ শুরু হল। ওয়ার্ডে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালিয়েও ওর দেখা পাওয়া গেল না। ওর কো-ইন্টার্নরাও কিছু বলতে পারল না। এদিকে বাবলুর ফোনে যতবার ফোন করা হল ততবারই বলল ‘স্যুইচড অফ’। অবশেষে হোস্টেলে ওর রুমমেটকে ফোন করে জানা গেল বাবলু ঘন্টাখানেক আগে হোস্টেলে ফিরেছে। তারপর কী একটা বিশেষ কাজ আছে বলে ছাদে উঠেছে।
অজানা আশঙ্কায় সবার বুকটা ধড়াস করে উঠল। রুদ্ধশ্বাসে সবাই ছুটল হোস্টেলের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে পাঁচতলার ছাদে উঠতে গিয়ে কয়েকজন হোঁচট খেয়ে পড়েও গেল। ছাদে উঠে সবাই বাবলুকে পেছন থেকে জাপটে ধরে চেঁচিয়ে উঠল,
— কার্ণিশের ধারে কী করছিস বাবলু!
— ধুস! তোরা পাখিটাকে উড়িয়ে দিলি।
বলেই বেশ বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো বাবলু।
দেখা গেল বাবলুর হাতে একটা গুলতি আর সেটা বানানো হয়েছে রক্ত টানার টুর্নিকেটটা দিয়ে।