৮
মোইদুল-ই শহরে এল। বলল, “তোমার কথা যদি গোপন হয়, তাহলে তো আমার ঘরে বসে বলা যাবে না কারণ ইউনিভার্সিটি এখনও আমার নিজের ঘর দিতে পারেনি। দু’জন কোলিগের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। আর আমার ইউনিভার্সিটির ওই নো-ম্যান’স-ল্যান্ডে অন্য কোথাও বসার জায়গা কই? স্টুডেন্টস’ ক্যানটিনেও পাউরুটি ঘুগনি আর অখাদ্য এক চা ছাড়া আর যে কিছুই পাওয়া যায় না।”
শ্রীপর্ণর কলেজের কাছের ক্যাফে-টা খালিই ছিল। কফিতে চুমুক দিতে দিতে পুরো ব্যাপারটা শুনে মোইদুল গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “আশ্চর্য! সারা গ্রামে কেউ নেই, যে ওকে আগে দেখেনি? কোনও ছেলে ছিল না যে ওর দিকে তাকিয়ে থাকত? ওর স্কুলে পড়ত যে মেয়েরা…”
শ্রীপর্ণকে কিছুটা সময় কাটাতে হলো মোইদুলকে ব্যাপারটা বোঝাতে। এক তো শানু গ্রামে ফিরেইছে প্রায় বছর পঁচিশেক পরে। ফলে তখনকার শানুর চেহারাটা খুব কম লোকেরই মনে আছে। গ্রামটা অনেক আগে থেকেই খালি হতে শুরু করেছিল। ওদের সমবয়সী মেয়েদের শ্রীপর্ণ ভালো করে তখনও চিনত না, আর এখন তো তারা বিয়েটিয়ে হয়ে কোথায় চলে গেছে, ওর পক্ষে খোঁজ করা স্বাভাবিকও না, সম্ভবও না। ছেলেরাও, যারা শ্রীপর্ণর বন্ধু ছিল, প্রায় কেউ নেই বললেই চলে আর। চাকরি-টাকরি নিয়ে চলে গেছে। যারা আছে, তাদের সকলকে জনে জনে জিজ্ঞেস করতে পারেনি শ্রীপর্ণ, কিন্তু যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারাও কেউ আজকের শানুকে কাছ থেকে দেখেনি। শানু হয় বেরোয়ই না বাড়ি থেকে, বেরোলেও জমিদারবাড়ি-সুলভ দূরত্ব বজায় রাখে। চোখে বিরাট রোদ-চশমা থাকে, চুলে, গলায় স্কার্ফ থাকে… সে বেশ শ্রীপর্ণও দেখেছে। রইল পড়ে ওর বাড়িতে যারা কাজ করে। তারাও আগের শানুকে চেনে না… শানু যখন গ্রাম ছাড়ে তখন তাদের বয়স সাত-আট, কেউ বড়োজোর বছর দশেক।
“তোমার যে ভাই… সে তো অত ছোটো না… সে-ও চিনতে পারবে না?”
শ্রীপর্ণ কী বলবে বুঝতে পারল না। চিতুকে ও বুদ্ধিহীন মনে করে না। কিন্তু ছোটোবেলা থেকে ‘বোকা’, ‘হাঁদা’, ‘গঙ্গারাম’ জাতীয় কথা শুনে শুনে চিতুর কোনও বিষয়ে আত্মপ্রত্যয় একেবারেই নেই। তাই কোনও কিছু নিয়ে দাদাদের কাছে কোনও মতামত চট করে প্রকাশ করে না। বিশেষ করে জিজ্ঞেস করলে তো নয়ই… তবে জিতুদা হয়ত…
“ছবি নেই? তোমার দাদাকে পাঠাও। সে ঠিক বলতে পারবে।”
জিতুদা হয়ত পারবে। কিন্তু ছবি তো নেই। যে যে পরিস্থিতিতে ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাতে ঠিক — আসুন, বা নিদেন এসো, একটা সেলফি তুলি… বলে ছবি তোলা যায় না, যায়ওনি।
“মিনিও তোলেনি?”
মাথা নাড়ল শ্রীপর্ণ। “প্রথম দিন তো প্রশ্নই ছিল না। আর মিনি যেদিন পরে গেছিল, সেদিনও বোধহয় কিছু একটা হয়েছিল।”
“কী হয়েছিল?”
মিঞ্জিরি কী একটা উপহার আবার ফিরিয়ে এনেছিল না দিয়ে…
“মিনিকে বলতেই হবে শ্রীপর্ণদা। ওকে না বলে তুমি এগোতে পারবে না।”
কথাটা শ্রীপর্ণরও মনে হয়েছিল, কিন্তু সেটা এড়াতে করতে চাইছিল বলেই এত ভাবনাচিন্তা, এত আলোচনা, মোইদুলকে ডাকা… শ্রীপর্ণর বিমর্ষ ভাবটা মোইদুলের নজরে পড়ল। বলল, “এত ভাবার কিছু নেই। দেখো, ব্যাপারটা তো তোমার মনের ভুল নয়…”
মাথা নাড়ল শ্রীপর্ণ। ভুল নয়।
“তাহলে তোমার সামনে দুটো রাস্তা রয়েছে। হয় ব্যাপারটা ইগনোর করা…”
“ইগনোর?”
“ঠিক… মানছি, ইগনোর করা সম্ভব না। তাহলে দ্বিতীয় রাস্তা হলো কিছু একটা করা…”
“কী?”
“ভেবে দেখো… করার যদি হয়, তারও অপশন বেশি নেই।”
“আমার মাথা কাজ করছে না। তুই বল…”
মোইদুল হাতের আঙুলের ডগা টেনে টেনে বলতে থাকল, “গ্রামে কারও সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না — কেউ ওদের চেনে না, অতীতে যারা চিনত তারা হয় নেই, নয় অতিবৃদ্ধ — ওই পিসি, এবং যেহেতু ওরা জমিদার, আগেও কেউ ওদের কাছের লোক ছিল না। তাই তারা কেউ এগিয়ে এসে তোমার পাশে দাঁড়াবে না।”
দ্বিতীয় আঙুলের ডগা ধরে মোইদুল বলে চলল, “জমিদারবাড়ির ফ্যামিলি প্রায় শেষ, ওই মহিলার অন্তত কোনও আপন ভাইবোন, বা আপন খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইবোন নেই, মামাবাড়ির কোনও খবর তোমার কাছে নেই।”
ঘাড় নাড়ল শ্রীপর্ণ। ঠিক।
“তা ছাড়াও, যে কারণে তোমার মনে খটকা লেগেছে, সেটা এতই গোপন একটা ব্যাপার, যে সেটা যে কোনও লোককে বুঝিয়ে বলা-ই মুশকিল। কিন্তু সেটা না বললে ব্যাপারটা দাঁড় করানো যাবে না।”
শ্রীপর্ণর একটা কথা খেয়াল হলো। বলল, “একটা উপায় আছে। তা হলো শানুর অতীতের ডকুমেন্ট বের করা। কোথাও না কোথাও তো ওকে লোকে চেনে। তাদের যদি যোগাযোগ করা যায়…” বলতে বলতেই ব্যাপারটা কতটা অসম্ভব ভেবে থেমে গেল।
“কে যাবে কোথায়? ও কোথায় কোথায় ছিল, তা-ই তুমি বলছ কেউ ভালো করে জানে না। ওকে তো জিজ্ঞেস করেছ। বলেছে?”
আগের দিন ব্রাসেলস সম্বন্ধে কী যেন বলছিল, কিন্তু শ্রীপর্ণ খেয়াল করে শোনেনি।
“তাহলে? এবারে এই সমস্যা নিয়ে কার কাছে যাওয়া যায়?”
শ্রীপর্ণ মূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইল মোইদুলের দিকে।
“একমাত্র পুলিশের কাছে যাওয়া যায়, শ্রীপর্ণদা। আর পুলিশের কাছে যাওয়া মানে সেটা নিয়ে জল ঘোলা হবেই। পুলিশ তোমাকেও একেবারে ছেড়ে কথা বলবে না। কোনও স্টেপ নেওয়ার আগে সব খতিয়ে দেখে তবেই নেবে। পুলিশ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। বিশেষ করে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, বা সিবিআই অত্যন্ত করিৎকর্মা, তুখোড় বুদ্ধিমান সব অফিসার…”
ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট… ডিডি… শ্রীপর্ণর খেয়ালই ছিল না। মুখটা হাসিতে ভরে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু পরমুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে গেল। এবারে মিঞ্জিরিকে পুরো ব্যাপারটা না বলে আর কিছুই করা যাবে না।
বলল, “তাহলে মিনিকে বলতেই হবে…”
মোইদুল বলল, “দাদা, একটা কথা বলো তো? এই মহিলার সঙ্গে তোমার কোনও অ্যাফেয়ার হয়েছে এর মধ্যে?”
শ্রীপর্ণ অস্বস্তির হাসি হেসে বলল, “কাছাকাছি চোখের দেখা দেখেছি দু’বার। তার মধ্যে একবার মিনিও ছিল…”
“আর দ্বিতীয়বার? সেদিন যখন ওদের বাড়িতে ওর হাজবেন্ড ছিল না… খোলামেলা পোশাক পরে সামনা-সামনি…”
মাথা নাড়ল শ্রীপর্ণ। “না। ততক্ষণে তো আমি শিওর হয়ে গেছি।”
“তাহলে তোমার মিনিকে বলার ব্যাপারে এত হেজিটেশন কেন?”
“কারণ ছোটোবেলার সব কথাগুলো মিনি জানে না।”
হুস করে উড়িয়ে দেবার ভাব করে মোইদুল বলল, “আরে, ধ্যাত, ওইটুকু ব্যাপার নিয়ে ভাবলে চলবে?”
শ্রীপর্ণ হেসে বলল, “ওরে, তুই একটা পুরুষমানুষ। তোর ভাবনা আর মিনির ভাবনা একই খাতে বইতে হবে এমন কোনও আইন নেই…” তারপরে কথা ঘুরিয়ে বলল, “এলিই যখন, বাড়ি চল, মিনিকে বলে দিচ্ছি, একেবারে খেয়ে ফিরবি…”
পরে, রাতে, যখন মোইদুল লাস্ট ট্রেন ধরতে বেরিয়ে গেছে, ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ওকে টা-টা বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে শ্রীপর্ণ সিগারেট ধরিয়েছে, মিঞ্জিরি এসে বলল, “সিগারেটটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না আজকাল?”
শ্রীপর্ণ সিগারেট এখন আগের চেয়ে অনেক কমই খায়, এখনও খুব যে খেতে ইচ্ছে করছিল, তা-ও নয়, শুধু অভ্যেসবশতই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধরিয়ে ফেলেছিল। “বেশি খাচ্ছি? কই?” বলে ফেলে দিয়ে মিঞ্জিরির মুখোমুখি দাঁড়াল। সন্ধেটা গেছে খোশগল্পে। মোইদুল স্মার্ট ছেলে, অযাচিতভাবে শ্রীপর্ণর দুশ্চিন্তার কথা মিঞ্জিরির সামনে বলেনি। এবার শ্রীপর্ণকেই বলতে হবে সবটা।
“কই আবার কী?” বলে মিঞ্জিরি শ্রীপর্ণর টি-শার্টের বুকের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, “আজ মোইদুল আসার সুযোগ নিয়ে কটা খেলে বলো? অন্তত চারটে… না পাঁচটা?”
গোনেনি শ্রীপর্ণ। মিঞ্জিরির কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে এসে বলল, “গুনিনি। শোনো। কথা আছে।”
“সে আমি জানি,” বলে মিঞ্জিরি জামা ধরে টেনে ঘরে নিয়ে এল। “সেই সেদিন ফিরে এসে থেকে দেখছি বাবু আনমনা…”
দাঁতে দাঁত চেপে শ্রীপর্ণ কথাটা বলেই ফেলল। একবার বলতে শুরু করলে হয়ত অত কঠিন লাগবে না… “একটা বাজে ব্যাপার। কী করব ভাবছি।”
মিঞ্জিরি সুরে এবার উদ্বেগ, “কী হলো?”
হুড়মুড়িয়ে বলে ফেলল শ্রীপর্ণ। “সেদিন মানিকের সঙ্গে ফিরব ঠিক করার পরে স্টেশনে ফেরার তাগিদ ছিল না, আমি পেছনের বাগানে পুকুরটা দেখতে গেছিলাম। বাড়ি তৈরি শেষ হলে ওদিকটা নিয়ে পড়তে হবে। ওদের বাগানে শানু ছিল। আমাকে ডাকল।”
শ্রীপর্ণ বুঝতে পারল দু’হাতের মধ্যে মিঞ্জিরির শরীরটা কাঁটা হয়ে উঠল। বলল, “শোনো মন দিয়ে। ব্যাপারটা সিরিয়াস কিন্তু…” বলেই বুঝল এরকম ভাবে বললে মিঞ্জিরি মোটেই নিশ্চিন্ত হবে না। তাই আর দেরি না করে সেদিনের ঘটনার সবটাই বলল।
মিঞ্জিরি বলল, “তারপর? এরকম তো প্রথম থেকেই চলছে। চিনতে পেরেও চিনছে না। তুমি এত কেন বিচলিত হচ্ছ? বাড়িতে ডেকে ফ্লার্ট করেছিল বলে? সেটাও তো আমি বলব স্বাভাবিকের পর্যায়ে পড়ে…”
শ্রীপর্ণ বলল, “বিচলিত হচ্ছি, কারণ শানু সেদিন দুটো কথা বলেছিল, যেগুলো একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।”
“কী বলেছিল?”
“বলেছিল, যে আমাদের দুটো পরিবারের সামাজিক অবস্থানের জন্য আমাদের ছোটোবেলায় বন্ধুত্ব হয়নি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এখন আমরা বন্ধু হতে পারব না…”
মিঞ্জিরি অবাক হলো না। এমন কথাই ও-ও আগে শুনেছে। বলল, “বলল? তুমি বললে না তোমাদের কতটা বন্ধুত্ব ছিল, আর সেটা ও ভুলে গেছে বলে তুমি কতটা আপসেট?”
“আপসেট আমি নই, কিন্তু যে বন্ধুত্ব ভুলে যায়, তাকে এরকম কথা বলে মনে করানো যায়?”
“তা বটে। আর দ্বিতীয়টা কী বলেছিল?”
“বলেছিল, ও জমিদারের মেয়ে না হলে আমাদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলে বা ক্রিকেট খেলে বন্ধু হতে পারত…”
মিঞ্জিরির মুখ হাঁ হয়ে গেল। “তোমাদের গ্রামে ছেলেরা এক্কাদোক্কা খেলত আর মেয়েরা ক্রিকেট?”
শ্রীপর্ণ বলল, “সেটাই বলছি। ছেলেরা যে এক্কাদোক্কা খেলে না, আর তখন গ্রামে ক্রিকেট কেউই খেলত না, ফুটবল খেলত, সেটা ও জানেই না। অর্থাৎ, এই মহিলা কোনও দিন কেবল আমাদের গ্রামে না, হয়ত কোনও গ্রামেই থাকেনি।”
“পর্ণো, খুব সাংঘাতিক অ্যালিগেশন। শিওর না হয়ে বোলো না কিন্তু।”
শ্রীপর্ণ অসহিষ্ণুভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “কাউকে কিছু বলছি না। কিন্তু আরও আছে…” এবার, আর অপেক্ষা না করে বলে ফেলতে হবে… “শানুর বিষয়ে বিষয়ে দুটো জিনিস আমি জানি, যেটা গ্রামের আর কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না।”
মিঞ্জিরি কিছু না বলে ভুরু বাঁকিয়ে তাকাল।
“শানুর দুটো জন্মগত অসঙ্গতি ছিল। একটা সহজে দেখা যায়, অন্যটা অত সহজে চোখে পড়ে না। তুমি শানুর পা দেখেছ?”
একটু অবাক হলো মিঞ্জিরি। “পা? কই না। দু’দিনই চটি পরে ছিল না?”
শ্রীপর্ণ বলল, “এক্স্যাক্টলি। ক্রক’স। পা ঢাকা… আমারও তাই চোখে পড়েনি। কিন্তু কাল… মানে সেদিন, সন্ধেবেলা যখন ও দরজা খুলে বাগান থেকে বাড়িতে ঢুকছে তখন চটি বদলাচ্ছিল বলে চোখে পড়ল।”
শ্রীপর্ণ থেমে ঘরে ঢুকে খাবার টেবিল অবধি হেঁটে গিয়ে গ্লাস তুলে নিয়ে জল খেল। মিঞ্জিরি পেছন পেছন এসেছিল, বলল, “আরে, আরে, কী চোখে পড়ল? বলবে তো, এখনই জল খেতে বসল…”
শ্রীপর্ণ হেসে বলল, “তেষ্টা পেলে কী করব?”
কপট রাগ দেখিয়ে টেবিল থেকে জলের জগ হাতে নিয়ে মিঞ্জিরি বলল, “দেব জল ঢেলে?”
শ্রীপর্ণ হাসি থামিয়ে বলল, “না, শোনো, ব্যাপারটা সিরিয়াস। ওর বাঁ পায়ে ছটা আঙুল ছিল। এখন নেই।”
“নেই মানে? এখন পাঁচটা আঙুল?”
“হ্যাঁ। তোমার-আমার মতো।”
“ভুল দেখোনি তো? হয়ত বাঁ পায়ে নয়, ডান পায়ে? তুমি ভুলে গেছ। শানু তো তোমাকেই ভুলে গেছে।”
শ্রীপর্ণ মাথা নাড়ল জোরে। “না, না। ভুল হয়নি। বাঁ পায়ে, আমি জানি। শুধু তাই না, ও যখন চটি খুলছে, তখন ওর বাঁ পা আমার দিকে। তখনই খেয়াল হয়েছে। আর ভেতরে ঢুকে ও ঘুরে দাঁড়িয়ে চটি পরছে, তখন ওর ডান পা দেখতে পাচ্ছি। কোনও পায়েই ছটা আঙুল নেই। আমি এতটাই বিচলিত হয়ে গেছিলাম, যে ঘরে ঢুকতে গিয়ে একটা মিস-স্টেপ করে প্রায় পড়ে গেছিলাম, শানু ধরে না ফেললে হয়ত পড়েই যেতাম…”
“প্লাস্টিক সার্জারি হয়ে থাকতে পারে?”
“জানি না। কিন্তু আর একটা ব্যাপার আছে।”
মিঞ্জিরি বলল, “আবার কী ব্যাপার।”
“বললাম না, শানুর দুটো জন্মগত অসঙ্গতি ছিল? অন্যটা দেখা যায় না।”
আবার মিঞ্জিরির ভুরু বেঁকে উঠল।
ঢোঁক গিলে শ্রীপর্ণ বলেই ফেলল। “ওর বাঁ গলার নিচ থেকে বাঁদিকের কাঁধ, বুক, পেট, পিঠে — একটা জন্মদাগ ছিল…”
“তুমি জানলে কী করে?”
বন্দুকের গুলির মতো প্রশ্নটা এল। এটাই শ্রীপর্ণর অস্বস্তি ছিল। এবারে পুরো ঘটনাটা বলতেই হবে। “ও-ই বলেছিল। বলেছিল ওর মা-বাবা সেটা নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করে। বিয়ে হবে কী করে? যত দিন যাচ্ছিল, তত নাকি মা-বাবার আলোচনা বাড়ছিল। ওর সামনেই। ওর অসুবিধে এই যে বড়ো বাড়ি হলেও, ওদের ফ্যামিলি ততদিনে খুব ছোটো। ওর বাবা একা ভাই, ওর পিসি নিঃসন্তান বিধবা, আর ও-ও একমাত্র সন্তান। মা-বাবা-পিসির আলোচনা সারাক্ষণ চলত — তোর বিয়ে হবে না। ওরকম একটা বিরাট জন্মদাগের কথা কাউকে না বলে বিয়ে দেওয়া যাবে না, আর বললে কি মেয়েকে কেউ ঘরে নেবে?”
“তখনকার দিনে একটা সমস্যা বটে,” মেনে নিল মিঞ্জিরি।
“ওর-ও আলোচনা করার কেউ ছিল না। তখন তো ওর একমাত্র বন্ধু আমি। একদিন বলেছিল। আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি এসেছিল, বলেছিলাম, কেমন দাগ না দেখলে বলব কী করে, কেউ বিয়ে করবে কি না? তখন একটুখানি দেখিয়েছিল…”
“মেয়েদের বুক দেখার জন্য কতো বুদ্ধি!”
শ্রীপর্ণ বলল, “কী করি বলো? গ্রামের ছেলের এক্সপোজারই বা কতটুকু? তবে না, বুক দেখিনি। গলা আর কাঁধ-টুকুই দেখিয়েছিল, ও তো কলারওয়ালা গলাবন্ধ ব্লাউজ পরত…”
“আ-হা-রে, বেচারা…” কপট সহানুভুতি ঝরে পড়ল মিঞ্জিরির কণ্ঠে। “সাধে কী মা বাবা নাম রেখেছে শ্রী-পর্ণো?”
শ্রীপর্ণ উত্তর দিল না। এই তামাশাটা পরিচয়ের প্রথম থেকেই মিঞ্জিরি করে। শানুকে রক্ষা করার জন্য মিথ্যে বলে সব দায় প্রায় নিজের ওপরেই নিয়েছে। ও শানুকে বলেনি কিছু। শানুই দেখাতে চেয়েছিল। ওর সাহস-ই হচ্ছিল না। কাঁধ আর ঘাড়ে দাগ দেখেই ক্ষান্ত দিয়েছিল। শানুই সবটা খুলে দেখায়। শানুই ওর হাতটা টেনে নিয়ে বুকের ওপর রাখে, বলে, “দেখ, হাত দিয়ে কিছু বোঝা-ই যায় না।” শ্রীপর্ণর জীবনে সেই প্রথম নারী-শরীর, সেই প্রথম প্রেমের অঙ্গীকার। ‘তোকে কেউ বিয়ে করবে না কেন ভাবিস? তুই এত সুন্দর…’ ‘এই দাগ নিয়ে কে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে বল? তুই করবি?’ ‘আমাদের বাড়ি থেকে করতে দেবে না।’ ‘পালিয়ে গিয়ে? পারবি না, আমাকে নিয়ে পালাতে?’ পারত? জানে না শ্রীপর্ণ। তখনও জানত না, কিন্তু বলেছিল, ‘পারব। একদিন তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব…’ সে স্মৃতি আজও শিহরিত করে শ্রীপর্ণকে। সে সব শানু ভুলে গেছে — সেটাই ও মানতে পারছে না শুরু থেকেই…
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুমি তো ওকে দেখেছ বেশ কয়েকবার। কী পোশাকে দেখেছ?”
একটু ভেবে উত্তর দিল মিঞ্জিরি। “বেশিরভাগ সময়েই সালোয়ার কুর্তা। একদিন দেখেছিলাম বাগানে — শার্ট আর জিন্স্ পরে।”
শ্রীপর্ণ বলল, “মানে সবসময়েই গলা, বুক, পেট ঢাকা — তাই তো?”
মিঞ্জিরি বলল, “ইয়েস। আর যতদূর মনে পড়ছে কামিজ বা কুর্তিরও বেশ গলা উঁচু, আর কলার — ওই স্ট্যান্ড আপ ম্যান্ডারিন কলার দেওয়া।”
শ্রীপর্ণও বলল, “ইয়েস। ছোটোবেলায় ওর স্কুলের শাড়ির ব্লাউজও ওরকম উঁচু কলারওয়ালা ছিল। কাল শাড়ি পরেছিল। বলেছিল সোমেশ্বরবাবু নাকি পছন্দ করেন না শরীর দেখানো পোশাক। তাই উনি নেই বলে পরেছিল। শাড়ি, আর খুব ছোটো স্লিভলেস ব্লাউজ। একটা স্টোল ছিল কাঁধে। ঘরে ঢুকে সেটা খুলে ফেলেছিল। তারপরে যখন আমাকে ধরতে কাছে এসেছিল, তখন সামনা সামনি দেখেছিলাম… শাড়িটাও বেশ সি-থ্রু। ওই তোমাদের কী — জর্জেট না শিফন…”
মিঞ্জিরি হেসে বলল, “জর্জেট, শিভন, ভয়েল, কোটা… সবই সি-থ্রু হতে পারে। তা থ্রু দিয়ে কী সি করলে?”
“কোনও দাগ নেই। পরিষ্কার স্কিন।”
একটু চুপ করে থেকে মিঞ্জিরি বলল, “কোনও দাগ নেই? তা হয়? তুমি যে জায়গাটা আগে দেখেছিলে, কালও সেটাই দেখেছিলে?”
ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলে শ্রীপর্ণ হাতের তালুটা বাঁ কাঁধ আর ঘাড়ের সংযোগস্থলে রেখে বলল, “এইখানটা। বলেছিল, এছাড়া বাঁ কাঁধ, বুক, আর পেটের ওপরের ভাগ সর্বত্র রয়েছে। বগলেও। সেদিন ওর সরু, স্লিভলেস ব্লাউজে কেবল বুকটুকুই ঢাকা ছিল। বগল, কাঁধ, গলা, পেট — সবই খোলা।”
“বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে যেতে পারে জন্মদাগ? বা চিকিৎসা করা যায়?”
শ্রীপর্ণর ভুরু কুঁচকে রয়েছে। বলল, “জানি না। যায়?”
জানে না মিঞ্জিরিও। বলল, “জানো, আমিও তোমাকে বলিনি, তুমি কষ্ট পাবে বলে, কিন্তু দ্বিতীয় দিন যেদিন আমি একা ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, সেদিনও বলেছিল — ছোটোবেলায় তোমাকে ও চিনতই না।”
“চিনত না? বলে দিল?”
“তুমি বললে তো ও তোমাদের গ্রামে ছোটোবেলায় থাকত না। না থাকলে চিনবে কী করে? সেইজন্যই গ্রামের কিছুই চিনতে পারে না… হতে পারে না?”
শ্রীপর্ণ বলল, “ভাবতে পারছ তার অর্থ কী দাঁড়ায়?”
“পারছি,” বলল মিঞ্জিরি। সেই জন্যই বলছি, এত সাংঘাতিক একটা অ্যালিগেশন করার আগে ভাবতে হবে।”
“আমি ভেবে পাচ্ছি না। কী করা যায় বলো তো?”
“জানি না। দাঁড়াও, একটু ভাবি,” বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল মিঞ্জিরি। “রাত প্রায় দেড়টা। ঘুমোবে, না গার্লফ্রেন্ডের বুকের জন্মদাগ নিয়ে বসে থাকবে?
সকালে কলেজ নেই? আমার আটটায় প্রিনসিপ্যাল সেক্রেটারির সঙ্গে মিটিং আছে অনলাইন… তারপরে বিহানতলা যাব। ঘুমোতে হবে।”
বলল বটে, কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে মিঞ্জিরিই শ্রীপর্ণকে ঠেলে তুলে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই দেখো, উইকিপিডিয়া বলছে কিছু জন্মদাগ বড়ো হবার সঙ্গে হালকা হয়ে যায়, আবার লেজার ট্রিটমেন্টও করা যায়…”
৯
পরদিন সকালে প্রিনসিপ্যাল সেক্রেটারির সঙ্গে অনলাইন মিটিং করতে করতে মিঞ্জিরিকে টেবিলের নিচ থেকে লুকিয়ে ফোন করে শ্রীপর্ণকে ঘুম থেকে তুলতে হলো। মিঞ্জিরির মিটিং শেষ হতে হতে শ্রীপর্ণ বেরিয়ে গেছে। খাবার টেবিলে এক টুকরো কাগজে লিখে রেখে গেছে — থ্যাঙ্কস ফর দি ওয়েক আপ কল। সায়ংকালে দেখা হবে? বিহানতলা থেকে কখন ফিরবে?
আজকাল কেউ এরকম নোট লেখে না। সবই মোবাইল ফোন খেয়ে নিয়েছে। শ্রীপর্ণ অভ্যাসটা ছাড়েনি। ওর ছোটো ছোটো নোটের কাগজ থাকে — কলেজ থেকে সব বাড়তি কাগজ — পুরোনো নোটিস, অপ্রয়োজনীয় চিঠি, রাফ কাগজ… নিয়ে আসে, তারপরে নোট-পেপারের সাইজে কেটে নেয়।
চট করে ঘড়ি দেখে নিয়ে ব্রেকফাস্টের টোস্ট বানাতে বানাতে মিঞ্জিরি মোবাইল তুলে উত্তর লিখল, ‘বিহানতলা থেকে দ্বিপ্রহরেই ফিরব। সায়ংকালে বাড়িতে থাকব।’
শ্রীপর্ণ সন্ধে ছটা নাগাদ ফোন করল। “মেট্রোতে ঢুকছি।”
ঘণ্টাখানেক বাদে বাড়িতে ঢুকল শ্রীপর্ণ। মিঞ্জিরি জিজ্ঞেস করল, “এখনই বেরোবে? না কফি খাবে?”
শ্রীপর্ণ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখনই… কোথায় বেরোব? সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে আছ? কোথায় যাবে…”
মিঞ্জিরি বলল, “দেবাঙ্কনদার বাড়ি যাব। ফোন করে বলে রেখেছি।”
শ্রীপর্ণ বেসিনে হাত মুখ ধুতে ধুতে থেমে ঘুরে দাঁড়াল। “দেবাঙ্কন? তার মানে তোমার মাথায়ও এখন শানু ঘুরছে?”
মিঞ্জিরি বলল, “ঘোরা থামাতে পারছি না। অনেকগুলো গণ্ডগোল — তাই না? কেমন তোমাকে না-চিনতে পারা, ছোটোবেলার কথা অসমাপ্ত রেখে, কিছু না বলে, কথা ঘুরিয়ে দেওয়া, ভুলভাল বলা… তারপর এই… সব… সব…”
সারা দিন শ্রীপর্ণও কথাটা বার বার ভেবেছে। সেদিনও শানু যখন সোমেশ্বরের ইচ্ছেমতো শরীর-ঢাকা পোশাক পরার কথাটা বলছিল — তখনও জন্মদাগ দেখানোর বিষয়টা ওর মনে পড়ল না? ওই বাগানেই তো ঘটেছিল সব। ওই পুকুরেরই এপার, আর ওপার। স্কুল থেকে ফেরার পথে শানু বলেছিল, “ফিরে পুকুরপাড়ে আসবি?” শ্রীপর্ণ যাবার পরে ঠিক ওই ভঙ্গীতে হাত নেড়ে ডেকেছিল। দু’বাড়ির চোখের এড়িয়ে পেছনের জংলা জায়গাটায় বিশাল একটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঘটেছিল ঘটনাটা। এই রকম একটা কথা শানু ভুলে গেছে, তা-ও শ্রীপর্ণ মানতে রাজি নয়।
আগের দিন ক্যাফেতে বসে মোইদুল যখন বলেছিল পুলিশকে জানাতে হবে তখনও শ্রীপর্ণর দেবাঙ্কনের কথাই মনে হয়েছিল। মিঞ্জিরিরও ওর পাতানো দাদার কথাই মনে হয়েছে। না হলেও আজ শ্রীপর্ণই মনে করাতো।
১০
“এটা পুলিশের কাজ নয়।”এক কথায় ডিসমিস করে দিল দেবাঙ্কন।
“তবে কার কাজ?” জানতে চাইল শ্রীপর্ণ।
“জানি না। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, নিদেন শার্লক হোমস… কিন্তু পুলিশ তো নির্দিষ্ট কমপ্লেন না পেলে তদন্ত করতে পারে না। পারে কি? থানায় একটা কমপ্লেন হবে, ডায়রি হবে… তবে না?”
দেবাঙ্কন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অফিসার। হবু বড়োকর্তা হিসেবে ওর নাম মাঝেমাঝেই ঘনিষ্ট মহলে আলোচিত হয়। শ্রীপর্ণ ভেবেছিল ওর কাছে এলে একটা সুরাহা হবে। কিন্তু…
বলল, “ওই নামগুলো তো কাল্পনিক চরিত্রের। আসল জীবনে এমন কেউ আছে?”
দেবাঙ্কন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “তোর নালিশটাও তো কাল্পনিক। কোনও প্রমাণ আছে যে মহিলা নকল?”
শ্রীপর্ণ বলল, “রিজনেব্ল্ সাসপিশনেরও জায়গা নেই বলছিস?”
দেবাঙ্কন ঘাড় নাড়ল। বলল, “রিজনেব্ল্ কি না জানি না, কিন্তু সাশপিশনের জায়গা আছে। কিন্তু সেটার ওপর স্টেপ নেবার রাস্তাটা কোথায়? কে কমপ্লেন করবে, কার কাছে? তুই ডায়রি করবি?”
শ্রীপর্ণ বলল, “একটাই সমস্যা। যদি আমি ডায়রি করি, সেটা প্রকাশ হলে কী হবে? যদি তদন্তে দেখা যায় যে আমার ভুল হয়েছিল, তাহলে ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় হবে।”
দেবাঙ্কন বলল, “বললি তো তোদের সঙ্গে ওদের এমনিই আদায়-কাঁচকলায় ছিল দুই তিন পুরুষ আগে।”
শ্রীপর্ণ বলল, “সেটা তো আমাদের বাবা-রা ঘুচিয়ে দিয়েছিল। আবার তৈরি করার কারণ দেখি না তো।”
মিঞ্জিরি ঝুঁকে পড়ে নাটকীয় ফিশফিশ করে বলল, “তার ওপর আবার তিনি গার্লফ্রেন্ডও ছিলেন ছোটোবেলায়।”
দেবাঙ্কন বলল, “লেট আস বি প্র্যাকটিক্যাল। ধর তুই কমপ্লেন করলি। তারপরে এগোন’র রাস্তা আছে? কী করবে পুলিশ? ওদের কাছে গিয়ে পেপার্স চাইবে? তোর ধারণা মেয়েটা আসল না, অন্য কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে নকল নথির অভাব হবে? সে সব ইনভেস্টিগেট করা মুখের কথা?”
জানে না শ্রীপর্ণ। এসব কি একজন কলেজ-শিক্ষকের জানার কথা? চুপ করে রইল।
মিঞ্জিরি বলল, “ওদের কাছে না জিজ্ঞেস করে বের করার অন্য উপায় নেই?”
দেবাঙ্কন বলল, “কী সেটা? এরকম পরিস্থিতিতে দু’রকম উপায় থাকতে পারে। এক কাগজপত্র — যেমন আধার কার্ড, পাসপোর্ট, ইত্যাদি। অন্যথায় উইটনেস। তোদের গ্রামে কেউ নেই, যে ওকে চিনতে পারবে? বা ওর আত্মীয়স্বজন কাউকে খবর দেওয়া যেতে পারে?”
আবার মাথা নাড়ল শ্রীপর্ণ। আবার বলল, “গ্রামে কেউ ওকে চোখেই দেখেইনি বিশ বছরের ওপর। তার ওপর তখনও শানুর বন্ধুবান্ধব কেউ ছিল না আমি ছাড়া। জমিদারি না থাকলেও জমিদারের মেয়ে-সুলভ চলাফেরা আচার আচরণ ওর। বাড়ি থেকেও অনুমতি ছিল না কারও সঙ্গে বেশি দহরম-মহরম করার।”
“ফ্যামিলি? আত্মীয়?”
আবার মাথা নাড়া। “শানুর পিসি ও বাড়িতেই থাকেন। অশীতিপর বৃদ্ধা — চোখে দেখেন না, কানে শোনেন না, কথা বলতে পারেন না ঠিক করে। শানু প্রথম দিন আমাদের নিয়ে গিয়েছিল।” বার বার — শ্রীপর্ণ… পাশের বাড়ি… বাবার নাম, ঠাকুর্দার নাম বলা সত্ত্বেও কোনও স্মৃতিই জাগানো যায়নি।
“মামাবাড়ির খবর জানি না। গ্রামে আর কেউ জানে কি না খোঁজ করা যেতে পারে, কিন্তু সে-ও কেউ বলতে পারবে কি না কে জানে… উপরন্তু সে খবর যদি ওদের কাছে আবার পৌঁছে যায়…”
মিঞ্জিরি একটু ভাবিত হয়ে বলল, “কাম টু থিঙ্ক অফ ইট, সেদিনও পিসিকে শানু কেবল — দেখো কে এসেছে, বলে আর কিছু বলেনি। তোমার নাম, ডাকনাম, বাপ-ঠাকুর্দার নাম — এমনকি পদবিটাও তুমিই বলেছ।”
শ্রীপর্ণ বলল, “আমি যত দেখছি, তত ভাবছি ব্যাপারটা পুরোটা গোলমেলে।”
দেবাঙ্কন কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, “গুড। তাহলে তুই থানায় যাবি, তাই তো?”
থানায়? দেবাঙ্কনের দিকে অনিশ্চয়তার দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শ্রীপর্ণ। দেবাঙ্কন হেসে বলল, “দেখলি? যতই দেখছিস, ততই ভাবছিস, কিন্তু শিওর হতে পারছিস না। তাহলে?”
সকলেই চুপ। দেবাঙ্কন বলল, “তাহলে আমিই বলি। সত্যিই এমন পরিস্থিতিতে প্রাইভেট ডিটেকটিভরা ভালো রেজাল্ট দিতে পারে। কিন্তু তাদের তো ফি দিতে হবে। কে দেবে? তুই?”
শ্রীপর্ণ বলল, “ফি কত? খুব বেশি হলে…”
দেবাঙ্কন বলল, “কমও হবে না। কাজটাতেই খরচা আছে। বে-আইনি কিছু করতে হতে পারে… যেমন ধর আধার কার্ড বা পাসপোর্টের ডিটেইল জোগাড় করা… আমি আনঅফিশিয়ালি হেল্প করতে পারি, কিন্তু আনঅফিশিয়াল হেল্প কতটা করা যায়? তারও লিমিটেশন আছে। কোথাও কোথাও টাকা দিয়ে ইনফরমেশন বের করতে হতে পারে। সে কত হবে তার বাজেট কেউ দিতে পারে না। তবে সবার আগে ঠিক কর পরের বাড়ির মালিক নিয়ে এইরকম খরচ করার দরকার আছে কি না।”
একটু ভাবল শ্রীপর্ণ। তারপর বলল, “একটা কথা বলি… একটু আগে যেমন বললাম, পাশের বাড়িতে যে থাকবে তার সঙ্গে অসদ্ভাব যেমন করতে চাই না, তেমনই পাশের বাড়ির বাসিন্দা হয়ত ভুয়ো, আসলে অন্য কেউ — এমন হলেও সেটা নিতে পারব না। সারাক্ষণ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে হবে, অথচ মনের মধ্যে খোঁচ থাকবে — এ অন্য কেউ না তো? এমনভাবে থাকা যাবে?”
“বুঝলাম। তাহলে একটু দেরি হবে। তাড়া নেই তো? রাতে খেয়ে যা। আমি শ্রীমানকে বলে দিচ্ছি…”
ব্যাচেলর দেবাঙ্কনের বাড়ির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব বহু বছর ধরে শ্রীমানের। ডাকামাত্র এসে বলল, “তাহলে আরসালানের বিরিয়ানি আর কাবাব বলে দি’? বাড়িতে তো তিনজনের খাবার মতো অত নেইকো।”
“সে যা খুশি করো, তবে তিন নয়, চারজনের…” বলে শ্রীমানকে বিদায় করে দেবাঙ্কন ফোন করে কাকে বলল, “স্বপ্ন দেখছ, না খুব ব্যস্ত?” তারপরে বলল, “কিছু যদি না করো তাহলে আমার বাড়ি চলে এসো, বিরিয়ানি খেয়ে যাবে… আরে, হ্যাঁ, এখনই।”
ফোন রেখে বলল, “স্বপ্ননীল সখের গোয়েন্দা। বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। আর সখের বলে খুব পয়সার খাঁই নেই। দেখি, কী বলে।”
“এখনই আসছে?”
“এই তো এখানেই থাকে — পাড়ার ছেলে। বলল পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছে।”
(ক্রমশঃ)