সল্টলেক
————–
সল্টলেক উপনগরী এক সময় চোরদের মুক্তাঞ্চল ছিল। সেখানে তখন খুবই কম লোকজন। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা, দূরে দূরে বাড়ি। সন্ধ্যে নামলে সে তো তেপান্তরের মাঠ। সেন্ট্রাল পার্কে শেয়ালের আস্তানা।
নিক্কো পার্কের জায়গায় ছিল ঝিলমিল। কু-ঝিকঝিক ট্রেন। পাখিরালয়।
কলকাতার বেশ পশ এরিয়া তখন সল্টলেক।
সল্টলেকের বাসিন্দারা বুকের তিরিশ ইঞ্চি ছাতি ছত্রিশ ইঞ্চি করে বলত,
‘সল্লেকে থাকি।’ তারা কলেজে আমাদের মত তেল-চকচকে চুলের চপ্পল পরা, জামা-না-গোঁজা মফঃস্বলি চেহারাগুলোকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখবে- এ আর আশ্চর্য কি?
বাসিন্দাদের নিরাপত্তা তখনও ছিল না, এখনও নেই। তবে তখন কোনো বাড়িতে চুরি করে একবার বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে এক্কেবারে পগার পার। আর আজকাল সল্টলেকের রাস্তায় জোরে হাঁটতে গেলেও কারো না কারো সাথে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা। দৌড়লে তো আর দেখতে হবে না! পিছনে সমাবেত স্বরে ‘চোর চোর’ চিৎকার উঠবে। তারপর ধরা পড়লে ঘিরে ধরে হাটুরে মার।
সে যুগে পচা খাল বা ‘পগার’ ছিল সল্টলেকের চারিদিকে। এখনও তার কিছুটা রয়ে গেছে। এই খালই উপনগরীকে উত্তর কলকাতা ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে আলাদা করে রেখেছিল। সল্টলেকে ঢোকার আদত রাস্তা ছিল দুটো। একটা উল্টোডাঙা থেকে, অন্যটা ই এম বাইপাস হয়ে। আরো প্রবেশপথের প্রয়োজন থাকলেও সল্টলেকের বাসিন্দাদের আপত্তিতে তা আর করা যেত না। তাদের ভয় ছিল প্রবেশপথের সংখ্যা বাড়লেই আশেপাশের অঞ্চল থেকে আরো আরো চোর সল্টলেকে ঢুকে পড়বে।
ঢুকে পড়তও। সঙ্গে লুকোনো সিঁদকাটি ওরফে গামছা (সাংকেতিক নাম) নিয়ে। তারপর সুযোগ বুঝে বাড়িতে সিঁদকেটে ঢুকে টাকাকড়ি, গয়নাগাটি, জিনিসপত্র হাতিয়ে হাওয়া। খাল পার হয়ে স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যেত তারা।
অনেকদিন আগে আমার এক কলেজ-তুতো ভাই আমাকে রোগী দেখাতে নিয়ে গেল সল্টলেকে। রোগী আসলে সেই কলেজ-তুতো ভাইয়ের আত্মীয়। সন্ধ্যের রাউন্ড শেষ করে সাতটা নাগাদ মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়েছি। সল্টলেক তখন আমার কাছে সেরেঙ্গেটির জঙ্গল। এখানে-ওখানে টিউশনি পড়ানো আর সিনেমা দেখার সুবাদে কলকাতার অন্যান্য অঞ্চল তবু অল্পবিস্তর চিনি। কিন্তু সল্টলেক সেই স্কুল জীবনে বাবার হাত ধরে। তারপর আর সেখানে নিয়মিত যাওয়া হয় নি।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। শীতের সন্ধ্যেয় সল্টলেক লেপমুড়ি দিয়ে জবুথবু। উল্টোডাঙায় বাস থেকে নেমে অটো ধরতে হল। ‘ধরতে হল’ মানে অটোই আমাদের ধরল। তারপর বসিয়ে রাখল আধঘন্টা, যদি আরো দুজন যাত্রী হয়! কিন্তু অটোওয়ালার বিধি বাম। তখন আমাদের দুজনকে নিয়েই চলল বাধ্য হয়ে।
কোনো একটা জায়গায় দেখি একটা লম্বা বাঁশ ফেলে রাস্তা আটকানো। পরে বুঝেছি সেটা দত্তাবাদ হতে পারে। উর্দিপরা দুটো মুখ অটোর পেছনের সীটে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আমাদের নামাল। ‘তোমরা কারা?’
‘আ-আমরা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার। রোগী দেখতে যাচ্ছি।’
ডাক্তার! অটোয় চড়ে সল্টলেকে রোগী দেখতে যাচ্ছে! তুলসী হাতে গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। তারাও বিশ্বাস করল না। আরো সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাদের মাপতে থাকল।
তখনও মোবাইল ফোন সেভাবে সহজলভ্য হয় নি। যার বাড়িতে যাচ্ছি তাকে যে ফোন করে পুলিশের সাথে যে কথা বলিয়ে দেব – তারও কোনো উপায় নেই।
সেই যুগে আমাদের দুজনের চেহারাতেই একটা চোর-চোর ভাব থাকলেও আমরা যে আসলে চোর নই- চোর ধরার টার্গেট নিয়ে বসে থাকা পুলিশের কাছে সেটা প্রমাণ করাও প্রায় দুঃসাধ্য। হাতের কাছে নিজেদের ডাক্তার প্রমাণ করার মত কোনো পরিচয়পত্রও পাচ্ছি না। শেষে কলেজ-তুতো ভাইয়ের স্টেথোস্কোপ আর অনেক খোঁজাখুঁজির পরে আমার ব্যাগের মধ্যে পাওয়া মেডিক্যাল কলেজের লাইব্রেরী কার্ড দেখিয়ে সে যাত্রা নিষ্কৃতি মেলে।
সল্টলেকের চুরির একটা আসল ঘটনা বলি। সুশান্ত ও প্রশান্ত দুই ভাই। বড়ভাই প্রশান্তবাবু সরকারি উচ্চপদ থেকে রিটায়ারমেন্টের আগে আগে সল্টলেকে জমি বাগিয়ে দোতলা বাড়ি করেছেন। উপর তলাটা তাঁর। নীচেটা ছোটভাই সুশান্ত-র। কিন্তু তিনি আমেরিকা প্রবাসী। বছরে একবার-দুবার আসেন। ঘটনাচক্রে সেদিন রাতেই তাঁর আসার কথা।
মাঝরাতে হেডলাইট নিভিয়ে একটা গাড়ি মৃদু ঘড়ঘড় শব্দে এসে থামল বাড়ির দোরগোড়ায়। ছোট একটা ‘ক্যাঁচ’ আওয়াজের পরে খুটুর-খুটুর শব্দ হতে থাকল নীচের তলা থেকে। প্রশান্তবাবু ভাবলেন, ছোটভাই সুশান্ত এসে পৌঁছেছে। এত রাতে দাদাকে আর বিরক্ত করবে না বলে উপরে আসছে না।
তাও তিনি উপর তলা থেকে একটা হাঁক দিলেন, ‘ঘনা এলি না কি?’ ঘনা হল সুশান্তবাবু-র ডাকনাম।
নীচে থেকে উত্তর এল- ‘হুঁ’
এই ‘হুঁ’ যে দু-এক বছর বাদে বাদে দেশে আসা ছোটভাইয়ের ‘হুঁ’ নয়- সেটা বুঝতে গেলে কানের জোর লাগে। সেই জোর প্রশান্তবাবুর আর নেই। তাই তিনি আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালে প্রবল চেঁচামেচিতে প্রশান্তবাবুর ঘুম ভাঙল। আসল সুশান্তবাবু এয়ারপোর্টে নেমে ভোর ভোর বাড়িতে পৌঁছেছেন। তাঁর ফ্লাইট লেট ছিল। ঘরে পৌঁছে দেখেন সদর দরজা হাট করে খোলা। ঘর পুরো খালি। টিভি, ফ্রিজ, এসি মেশিন, আলমারি, আসবাব – কিচ্ছু নেই।
পোলট্রি
————
কয়েকদিন আগে এক রোগিনী এসেছিলেন আমাকে দেখাতে। তাঁর আদত বাড়ি বর্ধমান। কিন্ত স্বামী মারা যাওয়ার পরে মেয়ের কাছাকাছি থাকার জন্য সম্প্রতি হৃদয়পুরে বাড়ি করেছেন। বর্ধমানের কোথায় থাকতেন জিজ্ঞেস করায় তিনি আমাকে বললেন, ‘বর্ধমানে একটা পোলট্রি আছে জানেন নিশ্চয়ই।’
‘পোলট্রি?
পোলট্রি মানে মুরগী। আগেকার দিনে মুরগী ও পোলট্রির কথা শুনলেই লোকে নাক সিঁটকাতো। মনে আছে, আমার বাবা আমাদের ছোটবেলায় একবার অফিস ফেরতা মুরগীর মাংস টিফিন কৌটোয় ভরে ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল। আর মা লুকিয়ে সেই মাংস রেঁধে আমাদের খাইয়েছিল। আমার বৈষ্ণব ঠাকুমা সেকথা জানতে পার নি। পারলে বাবার কপালে অনেক দুঃখ ছিল।
কিন্তু আজকাল মুরগী ছাড়া মানুষের চলে না। তাই বর্ধমানে পোলট্রি থাকবে- এতে আর আশ্চর্যের কি আছে!
‘এ পোলট্রি মুরগীর পোলট্রি নয়, ডাক্তারদের পোলট্রি। খোসবাগান। আপনি তো ডাক্তার, খোসবাগানের কথা জানেন নিশ্চয়ই। ওখানেই আমাদের বাড়ি ছিল।’
বর্ধমানের খোসবাগান সত্যিই এক আশ্চর্য জায়গা। প্রতিটা বাড়ি ঘেঁষাঘেঁষি। তার নীচে-উপরে অসংখ্য খুপরি। ডাক্তারদের চেম্বার, পলিক্লিনিক, ল্যাবরেটরি। সেই খোসবাগানের একটা ছোট্ট গল্প বলি।
এক পরিবার সাঁইথিয়ার কাছের এক গ্রাম থেকে বর্ধমানে এসেছে ডাক্তার দেখাতে। সাঁইথিয়া শহর থেকে একজন ডাক্তার ডাঃ মাহাতো রোগীকে বর্ধমানের বিশিষ্ট স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ডাঃ ঘোষ-এর কাছে রেফার করেছেন। ডাক্তার মাহাতো ডাঃ ঘোষের চেম্বারের নাম রোগীর প্রেশক্রিপশনে লিখে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছু নেই। রোগী বা তার পরিবার কেউই পড়তে জানে না। তার উপরে প্রেসক্রিপশনের সবকিছু ইংরেজীতে লেখা।
ট্রেন থেকে নেমেই তারা পড়ল খোসবাগানের রিক্সাওয়ালার পাল্লায়। এই বর্ধমান ষ্টেশনের রিক্সাওয়ালাদের সাথে একমাত্র পুরীর পান্ডাদের তুলনা চলতে পারে। তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সত্যিই মুশকিল। বিশেষতঃ সঙ্গে যদি রোগী থাকে। তাহলে তারা আপনাকে খোসবাগানে নিয়ে ফেলবেই।
রোগীর স্ত্রী রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল সে ডাঃ ঘোষের চেম্বার চেনে কিনা।
সে বলল, ‘চিনব না? রোজ সকাল-বিকেলে ওনার চেম্বারে রোগী নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা নিশ্চিন্তে উঠে পড়ুন।’
রিক্সাওয়ালা ডাক্তার ঘোষকে ডাক্তার বোস শুনেছিল। সুতরাং সে সটান প্যাসেঞ্জার নিয়ে খোসবাগানে ডাক্তার বোসের চেম্বারে উপস্থিত হল।
ডাক্তার বোস একজন নবীন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি এই মৃগী ও হাত-পা দুর্বলতার স্নায়ুরোগীকে নিয়ে কি করবেন? কোনো মতেই একে চর্মরোগী বলে চালানো যায় না। তাছাড়া এককালে কলেজে নিউরোলজিষ্ট ডাঃ ঘোষের ক্লাস করেছেন তিনি। মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে মাঝে মাঝে দেখাও হয় স্যারের সাথে। উনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছো?’
আর তাছাড়া এই রোগীকে ডাক্তার ঘোষের কাছে রেফার করা হয়েছে। সুতরাং ডাঃ বোস এই রোগী-কে প্রত্যাখ্যান করে ডাঃ ঘোষের চেম্বারে নিয়ে যেতে বললেন।
ততক্ষণে চেম্বারের বাইরে বেশ হইচই শুরু হয়েছে। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশতঃ ডাঃ ঘোষের চেম্বার খোসবাগান থেকে অনেকটা দূরে। রোগীর স্ত্রী সেখানে যাওয়ার বাড়তি ভাড়া দিতে চায় না। রিক্সাওয়ালার বাড়তি আয় হয় নি। চেম্বারের মালিক কোনো টাকা দিতে রাজী নয়। তাই রিক্সাওয়ালাও বিনা ভাড়ায় রোগীকে আবার ডাঃ ঘোষের চেম্বারে নিয়ে যেতে রাজী হচ্ছে না।
ডাক্তার বোস দেখলেন, আরো কিছুক্ষণ এরকম চেঁচামেচি চললে খুব লোক জানাজানি হবে। তাতে ব্যাপারটা কারো পক্ষেই ভালো হবে না। সব দিক ভেবেচিন্তে তিনি চেম্বারের বাইরে এলেন। তারপর চুপচাপ নিজেই ভাড়া মিটিয়ে রিক্সাকে ডাঃ ঘোষের চেম্বারের দিকে রওনা করিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি শান্ত হল।
রমণীমোহন
—————–
দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট্ট সুসজ্জিত রেস্তোরাঁর এক কোনার টেবিল। টেবিলের একদিকে ঋতু। অন্যদিকে অভীক। ঋতুর হাত অভীকের বাঁ হাতে। অভীকের ডান হাত চামচে করে ‘বেকড আলাস্কা’ তুলে দিচ্ছে ঋতুর মুখে। ‘বেকড আলাস্কা’ এক ধরনের ডেসার্ট। ঋতু সেই ডেসার্ট আদরের সাথে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে অভীকের হাত থেকে। ঋতু কমলেশের বান্ধবী। তিন বছরের গভীর সম্পর্ক। গত এক বছর একসাথেই থাকে তারা। কমলেশ এখন অফিসের কাজে চারদিনের জন্য মুম্বাইতে।
অভীক কমলেশের স্কুলের বন্ধু। চেহারা ও চরিত্র রমণীমোহন। ঘটনাচক্রে দশদিন হল কমলেশ তার বান্ধবীর সাথে অভীকের আলাপ করিয়ে দিয়েছে। আলাপ থেকে পরিচয়। আধঘন্টায় আপনি থেকে তুমি। একদিনে রূপের প্রশংসা। দু-দিনে সুন্দর চোখের প্রশংসা। তিনদিনে আকর্ষণীয় ফিগারের প্রশংসা। চারদিনে চুম্বন। সাতদিনে ঋতু সালোয়ার-কামিজ থেকে জিনস, জিনস থেকে মিনিস্কার্ট। দশদিনে ডেট।
রাত দশটা বাজে। ঋতু জানে না, এরপর অভীক তাকে কোথায় নিয়ে যাবে।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে চৌর্যকৃত