এ নিয়ে হাজার একটা কথার ফুলঝুরি হয়ে যাওয়ার পরেও দুটো লাইন লিখতে ইচ্ছে হল। কারণ একটাই। বহুবার দেখেছি যে নাকের ডগায় বুম আর মুখে তাগ করে জুম এই অবস্থায় দুম করে বলে দেওয়া কথাবার্তার ওপরে দাঁড়িয়েই আজকাল জনমত তৈরির চেষ্টা চলছে এবং সেটা সফলও হচ্ছে। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, ওসব অবকাশ নেই, দু মিনিট ইনস্ট্যান্ট ম্যাগীর মতো ইনস্ট্যান্ট সব সমাধান চলে আসছে আমাদের সামনে আর আমরাও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সেগুলো টপাটপ গিলে ফেলেছি। অথচ একটু তলিয়ে ভাবলে আমরা কি দেখতে পাবো?
যে সব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়তে যথেষ্ট সংখ্যক সিসিটিভি আছে সেগুলোর সব ক’টাতে র্যাগিং বন্ধ হয়ে গেছে? উত্তরটা হল, না বন্ধ হয় নি। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে র্যাগিং বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলির সবকটিতে সিসিটিভি বসানো আছে? এর ও উত্তর হল না, বসানো নেই। র্যাগিং বন্ধে সিসিটিভির অনস্বীকার্য কোনো ভূমিকা তাই আদৌ প্রতিষ্ঠিত নয়। এবার যাঁরা প্রবল ভাবে চাইছেন যে সিসিটিভি দিয়ে যাদবপুর মুড়ে ফেলা হোক, প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি ইঞ্চিতে তাঁদের দাবির যথার্থতা মেনে নিয়েই (সিসিটিভি বসান, কোনো আপত্তি নেই, পয়সার অভাব থাকলে বলবেন, চাঁদা দেবো) প্রশ্ন থেকে যায়। আচ্ছা, সিসিটিভি বসালে ঠিক কি সুবিধে হবে র্যাগিং আটকানোর? আজ্ঞে না, এটা বোকার মতো প্রশ্ন নয়, সত্যি করেই বলুন না কি কি সুবিধে হবে। অনেকেই বলবেন, কেন, এতে ওই দুষ্কৃতী ধরা পড়বে, দেখতে পাওয়া যাবে কে বা কারা ওই অপকর্ম করছে, মানুষের চোখকে ফাঁকি দেয়া যায়, ক্যামেরার চোখকে নয়। ঠিকই তো। এই বার আসছে দ্বিতীয় প্রশ্ন।
যাঁরা নজরদারি চালাবেন সেই কর্তৃপক্ষের চোখে, ধরে নিলাম যে, ওই অপকর্মের খলনায়করা ধরা পড়লো (যদিও তার সম্ভাবনা খুবই কম কারণ ওই অপকর্মের বেশিরভাগটাই হয় হোস্টেলে বন্ধ দরজার আড়ালে যেখানে সিসিটিভি-র চোখ নেই)। তারপর? আপনি আমি কি শিওর যে তারপরে কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কি বলে?
যে কিশোর ছাত্রটি মারা গেল, তার হোস্টেলে একজন সুপার ছিলেন, মনে পড়ে? হোক সামান্য বেতনভুক কর্মচারী, ছিলেন তো একজন। তাঁর অভিজ্ঞতা কি? তিনি খোলাখুলি স্বীকার করছেন যে তিনি হোস্টেলের বারান্দা ঘর কোনো কিছুতেই টহল দিতেন না, নজরদারি চালাতেন না, বলা ভালো, পারতেন না ভয়ের চোটে। হোস্টেলের গেটে সিকিউরিটি কর্মীরা মোতায়েন ছিলেন। হতে পারে তাঁরা আরো সামান্য বেতনের নগণ্য কর্মচারী, তবুও ছিলেন তো।তাঁদের সামনে দিয়ে বহিরাগতদের অবাধ আনাগোনা, নিষিদ্ধ মাদকের চালান, কোনো কিছুই বাদ যায় নি। তাঁরা আটকানোর চেষ্টাই করেন নি, বা পারেন নি, ভয়ের চোটে।
দিনের শেষে মোদ্দা কথা এটাই দাঁড়ায় যে অনৈতিক, অসামাজিক এবং অপরাধমূলক কাজকর্ম বন্ধ করতে সিসিটিভি কোনো জাদুমন্ত্র হতে পারে না যেমনটা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বা অব্যবহার বা অপব্যবহার নয়, শেষ কথা বলে কর্তৃপক্ষের, প্রশাসকের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, এবং সাহস। কোন কর্তৃপক্ষের, কোন প্রশাসকের, এবং তাদের মূল পৃষ্ঠপোষক দেশের কোন শাসক দলের মধ্যে আমি আপনি সেই সদিচ্ছা, সেই আন্তরিকতা সেই সাহস দেখেছি? ঘটনার নৈতিক দায় নিয়ে ওই দায়িত্বে থাকা মানুষজনের একজনও পদত্যাগ করেছেন?
রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে যাওয়ার নামে, লাশের রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে যাদবপুরের মাটিতে নিজেদের দলের একটু জমি শক্ত করার কুৎসিত প্রতিযোগিতা ছাড়া তাদের কাছ থেকে আমরা কি উপহার পেয়েছি? একটি কিশোরের অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত, বিচলিত, ক্রুদ্ধ জনতা যাতে এই অস্বস্তিকর প্রশ্ন না তুলতে পারে তার জন্যই তার মুখে ওই সিসিটিভি-র ললিপপ গুঁজে দেয়ার এত তোড়জোড়। প্রশ্ন করিস না বাপ। সিসিটিভি চুষে খা। লাগাও সিসিটিভি, লাগাও।