প্রিয় পাঠক, প্রথমেই উপরের ছবিটা খেয়াল করুন। ছবিটা ‘নেলসন টেক্সটবুক অফ পিডিয়াট্রিক্স’ থেকে নেওয়া। সারা পৃথিবীতে শিশুদের চিকিৎসায় এই বইটিকে বেদতুল্য (রূপকার্থে) বলে ধরে নেওয়া হয় এবং সম্ভবত ধরাধামে এমন কোনও মানুষ নেই যিনি এই বইটির কথাবার্তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারেন। নিচের ছবিতে কী লিখছে? বাচ্চাদের খিঁচুনি-রোগের চিকিৎসা বিষয়ে বলতে গিয়ে নেলসন বলছে, খিঁচুনি বন্ধ করার ওষুধ খেয়ে রোগী সুস্থ থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের ওষুধ থেকে জেনেরিক ওষুধ বা এক জেনেরিক ওষুধ থেকে আরেক জেনেরিক ওষুধে পরিবর্তন করা উচিত নয়। সেক্ষেত্রে ‘ব্রেক থ্রু সিজার’ বা নতুন করে খিঁচুনি হ’তে পারে কিংবা অন্যান্য কু-প্রভাব পড়তে পারে।
এর মানে কী দাঁড়ায়? নেলসন ধরেই নিচ্ছে, একই ওষুধের ব্র্যান্ড এবং জেনেরিক ওষুধে সক্রিয় উপাদানের তারতম্য হ’তে পারে। নেলসনের অধিকাংশ তথ্যই আমেরিকার। নেলসন লাইনগুলো লেখার আগে পরীক্ষা, তথ্য বা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছাড়া গালগল্প লেখে না। আমেরিকাতেই ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এরকম সন্দেহ থাকলে ভারতে ব্যাপারটা কেমন হবে? যেখানে হাজারে হাজারে ছোট-বড় কোম্পানি, হাজারে হাজারে ওষুধের ব্র্যান্ড? যেখানে মানুষের জীবন সস্তা, যেখানে প্রেস্ক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ দোকানদার বা হাতুড়ের পরামর্শে চিকিৎসা চলে? যেখানে একটা বড়সড় অংশের মানুষ বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নয়, বিভিন্ন অপ্রচলিত ছদ্ম-বিজ্ঞান (কাঠের ছিপি-কাচের শিশি, জড়িবুটি-পুরিয়া) বা ভাগ্যের ভরসায় দিন কাটায়? যেখানে মোড়ে মোড়ে কোটি কোটি ওষুধ দোকান এবং অধিকাংশ জায়গায় পাশ করা ফার্মাসিস্ট নেই? এরকম জায়গায় ওষুধের গুণগত মান পরীক্ষা কেমন হয়?
ডাক্তারকে জেনেরিক ওষুধ লিখতে বাধ্য করার আইন আনা খুব সোজা। এমনিতেই এই একটা প্রজাতির মধ্যে কোনও একতা নেই। সবাই নিজেকে লেজবিশিষ্ট ইয়ে ভাবে এবং একে অন্যকে ‘ও কিস্যু জানে না’ বলে বেড়ায়। এ ধরনের সহজ লক্ষ্যে আঘাত করা সহজ এবং সেটা ‘লোকে খায়’। সিগারেটের বা মদের প্যাকেটে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ ইত্যাদি না লাগিয়ে, অনেক সহজ হয় না, জিনিসগুলো তৈরি বন্ধ করে দেওয়া? সেগুলো হবে না কারণ এই কোম্পানিগুলো বহু টাকার ভেট দেয়। সরকার নিজেই যদি জেনেরিক নামে গুণমানসম্পন্ন ওষুধ বানায় তাহলে সবারই লাভ। সেটা হয় কি? বা হ’লে কতটা হয়? তা কত শতাংশ দেশবাসীর প্রয়োজনীয়তা মেটায়? সরকার বলতেই পারে, ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ বানানো বন্ধ করে দিক। তা হবে না কেননা সরকারের সেই পরিকাঠামো নেই।
এবার ধরা যাক, ডাক্তার জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলেন। সে ওষুধটা পাওয়া যাবে কোথায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে ওষুধটা মিলবে সেটা কম দামের ব্র্যান্ডের ওষুধ। এবং, সেটা ঠিক করে দেবে কে? ওষুধ দোকানের মাধ্যমিক না টপকানো ছেলে। সে স্বাভাবিকভাবেই যে ওষুধে লাভ সবচেয়ে বেশি সেটাই দেবে। এবার পুরোটাই গুণগত মানের প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, গুণগত মান না থাকলে ওষুধ বাজারে আসছে কীভাবে? এই প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তরও খুব কঠিন নয়।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ধরা যাক, আপনার একটা জামা কেনার মতো অর্থের অভাব নেই, ব্র্যান্ডের নামও আপনার জানা। এবার, আপনি বাজারে গিয়ে ভ্যান হুসেইন, লুই ফিলিপ, লিভাইস ইত্যাদি খোঁজেন নাকি ‘একটা ভালো কটনের জামা দিন তো দাদা’ এভাবে খোঁজেন? এবং, এভাবে দেখলে চাল, ডাল, বিস্কুট, তেল, বাড়িঘর তৈরির মালমশলা, ছেলেমেয়ের স্কুল, সোনার গয়না, গাড়ি, মোবাইল, জুতো, ঘড়ি ইত্যাদি সবকিছুতেই আপনি ব্র্যান্ড খোঁজেন। কেন খোঁজেন? তার চেয়ে কম দামেই সংশ্লিষ্ট জিনিসটা পাওয়া যায় তো… তবু আপনি ব্র্যান্ড দেখে কেনেন কারণ তারা গুণমানের একটা নিশ্চয়তা দেয়। অন্তত বেশিরভাগ সময়। আপনি সেই নিশ্চয়তাটার জন্য বাড়তি টাকা দেন। আপনি বলবেন, যাঁর পকেটে ব্র্যান্ড কেনার পয়সা নেই? সোজা কথা, তিনি সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না কেন? সেখানে প্রায় বিনে পয়সায় চিকিৎসা হয় এবং বেশিরভাগ ওষুধ জেনেরিক নামেই লেখা হয়। যদিও যে ওষুধ পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই কম দামের ব্র্যান্ড। সে সব ওষুধ কীভাবে আসে সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। কথা হ’ল যাঁর অর্থের জোর নেই, তিনি হাসপাতালের বাইরে ডাক্তার দেখাতে চাইছেন কেন? কারণ, সেখানেও ব্র্যান্ডের গল্প। অথবা, সরকারি হাসপাতালে সময় নষ্ট কিংবা ডাক্তারকে সময় নিয়ে দেখাতে না পারার ব্যাপারগুলো আসবে। ঘুরে ফিরে তো সেই গুণগত মানের কথাই আসছে। বাসমতী চাল খুদকুঁড়োর দামে চাইলে তো মুশকিল। আপনি বলবেন, চিকিৎসার মতো একটা মৌলিক চাহিদার সাথে চিনি-বিস্কুটের তুলনা? না, প্রিয় পাঠক, আমাদের দেশের সংবিধান ‘স্বাস্থ্য’কে মৌলিক চাহিদা বলে স্বীকৃতি দেয় না। কেননা, সেক্ষেত্রে জনগণের স্বাস্থ্যের যাবতীয় দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে যায়। তাছাড়া আপনি বাদবাকি বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন- বাড়ি তৈরির ইঁট, রড, ছেলেমেয়ের বিদ্যালয়, চাল, ডাল। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এগুলো তো কিন্তু জীবনের বুনিয়াদি বিষয়। সেসব জায়গায় প্রশ্ন তোলেন কি? আসলে একমাত্র স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই আপনার হয়ে ব্র্যান্ড বেছে দিচ্ছেন অন্য কেউ। সেখানেই সম্ভবত বিভিন্ন সময় অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে। তা যদি হয়ও, তাহলেও সমস্যাটা বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়েই হওয়া উচিত। তাকে সামগ্রিকভাবে ধরে ফেললে মুশকিল।
যে চিকিৎসক রোগীকে প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেখবেন তিনি অবশ্যই ওষুধের গুণগত মান সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হ’তে চাইবেন। ধরা যাক, গলায় ব্যাক্টিরিয়াঘটিত সংক্রমণের রোগী এসেছেন। আগে অন্য কোথাও চিকিৎসা (অধিকাংশ সময়েই স্ব-চিকিৎসা বা হাতুড়ে চিকিৎসা) চলছিল। সারেনি বলে ডাক্তারের শরণাপন্ন। ধরা যাক, ওষুধটা ছিল, কোনও অপরিচিত ব্র্যান্ডের অ্যামক্সিসিলিন। এবার, পাশ করা ডাক্তার কীভাবে নির্ধারণ করবেন, এটা খারাপ গুণমানের ওষুধের জন্য হচ্ছে (সেক্ষেত্রে পরিচিত ব্র্যান্ডের অ্যামক্সিসিলিন লাগবে) নাকি সবশুদ্ধ ওষুধটাই বদলানো দরকার? এই প্রশ্নে ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়া’ তৈরির প্রসঙ্গও আসবে।
এতটা পড়ার পরে আপনি যদি মনে করেন, আমি জেনেরিক ওষুধ লেখার বিরোধী, তাহলে ভুল করছেন। আমিও জেনেরিক ওষুধ লেখার পক্ষে। অনেক সময়েই ব্র্যান্ডের নাম দেখে ওষুধ বোঝা যায় না। গুগল করতে হয় আর রোগীর বাড়ির লোক ভাবেন, এ ডাক্তার কিচ্ছু জানে না! জেনেরিক নামেই ওষুধ লেখা দরকার তবে তার আগে সঠিক গুণমানের জেনেরিক ওষুধ (কমদামী ব্র্যান্ড নয়) পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারে আসতে হবে। প্রতিটি ওষুধের দোকানে পাশ করা ফার্মাসিস্ট লাগবে। পাশ করা ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এতগুলো জিনিস আগে ঠিক না করে জেনেরিক ওষুধ লেখা প্রচলন করতে গেলে গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়ার মতো অবস্থা হয়।
এতক্ষণে অনেকেই ওষুধ কোম্পানির কমিশন ইত্যাদি নিয়ে আদাজল খেয়ে লেগে পড়তে চাইছেন। কথাটা একদম মিথ্যেও নয়। তবে তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। দিনের শেষে রোগীকে সুস্থ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ডাক্তারেরই। তখন আর চোখে আঙুল দাদাদের পাওয়া যায় না। তাছাড়া, যে কোনও কোম্পানি তাদের বহুল প্রচলিত আর প্রচারিত ওষুধ নতুন করে প্রচার করে না। বরং, তুলনায় স্বল্প-পরিচিত ওষুধ প্রচারের দায় অনেক বেশি থাকে। আশা করি, বোঝাতে পারলাম।
নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও একটু বলে যাই। যদিও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ‘বিজ্ঞান’ বলে না, তবুও বলি। ৭৮% ছাড় দেয় এরকম একটি (বা এক ধরনের দোকান। নাম বললে ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়বে) দোকান থেকে প্যারাসিটামল আর সেট্রিজিন কিনে খেয়ে দেখেছি অন্তত দু-তিনখানা একসাথে না খেলে কাজ হয় না। এই গিনিপিগ হওয়ার খেলাটা রোগীর ওপর করি কোন সাহসে?
ওষুধ তৈরি থেকে বিক্রি সব নিয়ম মেনে হোক, আমিও জেনেরিক ওষুধ লেখা বাধ্যতামূলক করাকে দু’হাত তুলে সমর্থন করবো। তার আগে নয়। যে বাচ্চাটা শ্বাসকষ্টে ভুগছে, যে বাচ্চাটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তাকে উপশম দেওয়া আমার কাজ। ঠান্ডা ঘরে বসে যাঁরা বাস্তব অবস্থা না বুঝে নিয়ম বানান তাঁদের সে দায় নেই, বলাই বাহুল্য। আর প্রতিবারই যা বলি, সরকার সবার স্বাস্থ্যের যাবতীয় দায়িত্ব নিক। পুরো স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা সরকারি ছাতার তলায় আসুক। এতগুলো দেশ জনগণের স্বাস্থ্যের (প্রায়) যাবতীয় দায়িত্ব নিতে পারলে আমাদের দেশই বা পারবে না কেন? সেই সদিচ্ছা থাকলে তো এসব লোক দেখানো গিমিক দিয়ে নিজেদের অপারগতা ঢাকতে হ’ত না…