অনেক পুরনো কাগজ ঝাড়াই বাছাই চলছিল বাড়িতে। যেমন সব পরিবারেই হয়ে থাকে।
কাগজ আর অব্যবহৃত জিনিষের ভীড়ে যখন ওষ্ঠাগত প্রাণ, তখন সব বাড়িতেই শুরু হয় তাক, আলমারি পরিষ্কার করার তাড়া, আবার একগাদা নতুন কাগজের জন্য জায়গা বানানো! বেরিয়ে আসে বাজারের রসিদপত্তর, তামাদি হয়ে যাওয়া কম্পিউটার আর মোবাইলের ওয়ারেন্টি, মরচে ধরা ব্যাটারি, না জ্বলা টর্চ আরো কত কি!
এ ভাবেই পুরনো কাগজ আর অব্যবহৃত জিনিসপত্রের চক্র চলতে থাকে। তবে মাঝেমধ্যে আচমকাই ফালতু দ্রব্যাদির মধ্যে থেকে পুরনো স্মৃতি জেগে ওঠে।
কাগজপত্রের ভিতর থেকে একখানি শংসাপত্র বেরিয়ে এলো আজ। বাজে কাগজের ভীড় ঠেলে।
ছোটবেলা থেকেই কবিতা বলার শখ ছিল আমার।।পাড়ায় জলসা হলেই অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘ফিলার’ হিসাবে আমার আবৃত্তিকে ব্যবহার করা হতো খুব। আর আমিও স্টেজে উঠেই ফরফর করে কবিতা বলতে শুরু করে দিতাম। এই করে বীরপুরুষ, প্রশ্ন এসব বোধহয় বার আষ্টেক বলে ফেলা হয়েছিলো। বিভিন্ন জায়গায়।
তবে আরেকটু বড় হলে নাটক আমাকে টানতো খুব। পাড়ায় রবীন্দ্র বা নজরুল জয়ন্তী থেকে শুরু করে বিজয়া সম্মিলনী পর্যন্ত নাটকের একটা স্থান ছিল পাকা। মনোজ মিত্র ছিলেন সেইসময় আমাদের হট ফেভারিট। সত্যি ভূতের গপ্পো থেকে মহাবিদ্যা, নরক গুলজার সবই করেছি তখন ।
ডাক্তারি পড়তে ঢুকি ১৯৮৮ সাল, খুব সম্ভবত অগাষ্ট মাস। একদিন সকালে খবর পেলাম, বাড়ির বাইরে থেকে কেউ নাম ধরে ডাকাডাকি করছে।বারান্দায় এসে দেখি কলেজের ফিফথ ইয়ারের দুই দাদা। হীরক আর জ্যোতিদা।
দেখে অবাক হলেও ওদের বক্তব্য শুনে আরোই চমকে গেলাম।
আমাদের কলেজ ফেস্ট ‘অ্যাগন’ আর দু দিন বাদে শুরু হতে চলেছে। সদ্য কলেজে ঢোকা আমরা এই সব নিয়ে খুব উৎসাহিত। গরম গরম আলোচনা চলছে ক্লাসে। কিছু ছাত্রছাত্রী বেশ অগ্রণী ভূমিকায় এই কদিনেই। আমরা মূলত শ্রোতা। শুনছি আর অবাক হচ্ছি।
ওদের কাছে শুনলাম, আমাদের ন্যাশনালের একটি নাটকের দল তাতে অংশ গ্রহণ করতে চলেছে। কলেজের অভ্যন্তরীণ আরো দুটি নাটকের দলকে কম্পিটিশনে হারিয়ে এই দলটি ফাইনাল রাউন্ডে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে।
কিন্তু মুশকিল হয়েছে তাদের এই ‘কাক চরিত্র’ নামক নাটকটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘সাধুবাবা’ চরিত্রে অংশগ্রহণকারী ছাত্রটি অসুস্থ হয়ে পরায়। হঠাৎই। সে ‘অ্যাগনে’ নাটক করতে পারবে না!
তাই এই দু দিনের মধ্যে ওই রোলটি আমাকে তুলে, করে দিতে হবে। যে ভাবেই হোক। কেন না এর সাথে নাকি কলেজের সম্মান জড়িয়ে আছে!
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। একে এদের কাউকে আমি চিনি না তার উপর দু দিনের মধ্যে মুখস্থ করে এই রোলটা নামানো তো বেশ কঠিন। বললামও সে কথা।
ওদের বক্তব্য ওরা খবর পেয়েছেন যে আমি একটি নাটকের দলের সাথে যুক্ত এবং বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম করে বেড়াই। তাই অন্য কারো উপর ভরসা না করে আমার কাছে এসেছেন।
এতটাই অভিভূত হয়ে পড়লাম এইসব শুনে যে নতুন কলেজের সম্মানরক্ষার দায়িত্বটা নিয়েই ফেললাম।
হোস্টেলে সারা রাত জেগে চললো রিহার্সাল। নতুন একজন পেশাদার নির্দেশক এলেন, গ্রুপথিয়েটারের। প্রথম দেখলাম একজনের নির্দেশনা কি ভাবে বদলে দিতে পারে সম্পূর্ণ প্রোডাকশন। আর জুটলো তুমুল বকা। সেই দাদার নামটা আমার এখন আর মনে নেই। তবে একরাতেই নাটকের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিলেন।
যথাসময়ে নাটক মঞ্চস্থ হলো। সসম্মানে উত্তীর্ণ হলো আমাদের কলেজ। উতরে গেলাম আমিও। ফার্স্ট প্রাইজ ‘অ্যাগন’-এ, প্রথম বারেই। তুমুল আনন্দে ভেসে গেলাম সবাই।
আসলে সার্টিফিকেটটাই মনে করিয়ে দিল এইসব কথা।
পুরনো কাগজ মাঝেমাঝেই যত্ন করে ধুলো সরিয়ে দেয় স্মৃতির পাতা থেকে। শুধু আবর্জনাই বাড়ায় না। আর মাঝবয়সে এসে ফেলে আসা দিনগুলো হাতছানি দেয় সুযোগ পেলেই। প্রায়শই।