আমি, সেই ১৯৮৩র শেষদিক থেকে চেম্বারে রুগী দেখা শুরু করি।
আদতে আমি আমার প্র্যাকটিসিং এলাকার ‘সন অফ দ্য সয়েল।’
এই এতদিনে, যেমন বহু লোক আমায় চেনে, তেমনি, আমিও কম লোককে চিনিনা!
এই চেনাচিনির একটা অ্যাডভানটেজ আছে। সেটা হল, ছোটখাটো সমস্যা হলেও, সম্পর্ক ভালোই থাকে, টিঁকেও থাকে। ডাক্তারির নলেজ বা সফল প্রয়োগবিদ্যা বাদেও, দীর্ঘদিন মানুষের ভালোবাসা পেতে চাইলে যা অত্যন্ত জরুরী।
সেদিন ছিল ৮ই জুলাই। একটা অচেনা রোগী এসে ঢুকলো। এমনিতেই আমি করোনার আবহে একটু সাবধানী, তাই ঐ অচেনা হবু মা, যার আর মাত্র এক দেড় সপ্তাহ বাকী আছে, তাকে বলি সরকারী হাসপাতালে যোগাযোগ করতে।
ওর সঙ্গে এসেছিল ওর স্বামী, যে একটা হোসিয়ারি কারখানার শ্রমিক, আর একজন ছিল। আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, যাদের বাড়ির অনেকগুলি মহিলা আমার কাছে বিভিন্ন কারণে চিকিৎসিত, এক সব্জিওয়ালা। তার সনির্বন্ধ অনুরোধে মেয়েটিকে দেখি, পরদিন করোনা টেস্টের জন্য লিখে দিই।
৯ তারিখ সকালে এসে মেয়েটি RTPCR test এর জন্য প্রাইভেট ল্যাবে স্যাম্পল জমা দিয়ে যায়।
ঐদিন রাতেই মেয়েটির অল্প ব্যথা শুরু হতে, ওরা ওকে নিয়ে চলে আসে।
ভর্তি করে রেখে দিই।
ওষুধে সাময়িক ব্যথা কমে যায়।
দুদিন অপেক্ষা করি কোভিড রিপোর্টের জন্য।
দেরি হচ্ছিল।
১১তারিখ দুপুরে মেয়েটির জটিলতা বাড়তে থাকায়, তখনো রিপোর্ট আসেনি, কিন্তু সার্জারি করবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই।
সেইদিন সন্ধ্যায় রিপোর্ট আসে, মেয়েটি করোনা পজিটিভ।
নবজাতক শিশুটিকে তখনো মায়ের কাছে দেওয়া হয়নি।
তাকে, বাড়িতে পাঠিয়ে দিই।
তৎক্ষণাৎ স্থানীয় প্রশাসনকে জানাই ব্যাপারটা।
তাঁরা জানান, ব্যাপারটা দেখবেন। আমাকে একটা গাড়ি জোগাড় করতে বলেন।
ঐ রাতে করোনা পজিটিভ রোগী নিয়ে যেতে হবে শুনে কেউ রাজি হয়নি।
প্রশাসন থেকে জানানো হল, সকাল হলে একটা ব্যবস্থা করা হবে।
কিন্তু, পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো জেলা স্তরের একজন আধিকারিকের ধমকপূর্ণ ফোনে। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় এইসব হচ্ছে, তাই কোনো সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে না। আমাকেই সব দায়িত্ব নিয়ে রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
তাঁকে জানালাম, গরীব মানুষ, সেটা পারবেনা, আর গাড়ি ব্যবস্থা করা অসম্ভব।
তিনি কোন কথা কানে নেননি।
এই ফাঁকে এইসব জেনে, পেসেন্ট পার্টি হাওয়া হয়ে গেছে। কেটে পড়েছে।
খবর রটে গেছে।
রোগীর যেখানে বাড়ি, সেখানকার রাজনৈতিক নেতাদের আগমন ঘটলো। তাদের বললাম, কিছু বিহিত করুন। আমাদের, এই রোগীকে চিকিৎসা করবার কোনো পরিকাঠামো নেই।
তারা, স্থানীয় প্রশাসনের সাথে দেখা করলো।
পরিণতি হলো, স্থানীয় প্রশাসন আমাকে জানালো, এই মূহূর্তে তাঁদের আর কোন ক্ষমতা নেই রোগীকে সরকারীভাবে নথিভুক্ত করে কোথাও ভর্তি করবার। পরিবর্তে রোগী আমার ক্লিনিকেই থেকে যাবে, যেহেতু সে আপাতভাবে ভালো আছে।
রোগী এখানেই থেকে গেল।
এমনকি, পাড়ার লোকের চাপে সেই নবজাতককেও বাড়ির লোক আমাদের কাছেই আবার এনে দিল।
তখন আমি ব্যাপক চাপ খাচ্ছি।
কোনদিকে যাই, কী যে হবে!
রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কী যে হবে, ভাবতেই যেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
ওদিকে, রোগির স্বামীর পাত্তাই নেই। মোবাইল সুইচড অফ।
আমার ছেলেরাই একটা আইসোলেশন ফ্লোর বানিয়ে, পিপিই কিট পরে রোগিনীকে সবরকম সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।
আমি ভাবতেও পারিনি এই পরিস্থিতিতে পড়বো। সেই প্রথম, ICMR-এর কোভিড ট্রিটমেন্টের গাইডলাইন পড়ে সেটা ফলো করলাম।
সরকারী নির্দেশে আমার টিমের চোদ্দজনের করোনা টেস্ট হল পাঁচদিন পরে, সৌভাগ্যক্রমে কেউ পজিটিভ হয়নি।
একসপ্তাহ কেটে গেল।
আস্তে আস্তে মানসিক শক্তি বাড়ছে। রোগীটাও ভালো আছে। তাকে হাই প্রোটিন ফুড খাইয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি, এ যাত্রা মেয়েটাকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠাতে পারলে, আমার পুনর্জন্ম হবে একটা।
এইসময়ে একদিন হঠাৎই রোগীর স্বামীকে ফোনে পেয়ে যাই। সে বলে, তার কাছে My Gov মোবাইলে মেসেজ এসেছে আমরা ওর স্ত্রী ও বাচ্চার কোভিড টেস্ট করাচ্ছি। তাকে বললাম, হ্যাঁ, তবে তুমি টাকাপয়সা দাও।
সে উল্টে বলে, আমাকে উল্টে বলে, আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করা হয়েছে। আর কোনরকম টাকাপয়সা জমা দিতে বারণ করা হয়েছে।
কে বারণ করেছে?
বিডিও।
সত্যি বলছো? বিডিও বারণ করেছে?
না, আমি সেটা শুনিনি। আমাকে আমাদের এখানকার নেতারা বলেছে। বলেছে, সব দায়িত্ব ডাক্তারের। একদম টাকা পয়সা দিবি না।
ছেলেটা, সেই নেতাদের নামও বলে রেখেছে আমাকে।
তাকে বললাম, এত খরচ হচ্ছে, প্রাইভেটে টেস্ট হচ্ছে, তোর বৌএর করোনা হওয়ার কারণ আমি নাকি? যে তুই খরচা দিবিনা?
সে বলে, আপনি এ যাত্রা ওকে ভালো করে দিন, আপনার অনেক সুনাম করবো, আরো অনেক রোগী এনে দেবো।
বললাম, আমার বয়সটা বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস! এখনো সুনামের পেছনে দৌড়তে হবে আমাকে! তাতে, তোর সাহায্য দরকার আমার? গরীব মানুষ হলেও, কথা বার্তা ভালোই জানিস। যাকগে, তুই খরচা না দিলেও আমি গরীব হয়ে যাবো না। তবে, আমি সেই প্রথমদিনই আন্দাজ করেছিলাম, এই রোগীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবেনা। আমার সিক্সথ সেন্স সেটাই বলছিল। শুধুশুধু ঐ সব্জিওয়ালাটার কথা শুনে ফেঁসে গেলাম আজ। সেই সব্জিওয়ালাটাও বেপাত্তা। আর এদিকে ঘেঁষেনি।
২২ তারিখে, আমি আর আমার স্ত্রী যাই, আমাদের টেস্ট করাবার জন্য, সেই সময়ে রোগিনীটিরও নাম নথিভুক্ত করে রেখেছিলাম। যিনি স্যাম্পল সংগ্রহ করতে এসেছিলেন, তিনি রোগিনীর বাবার কাছে খরচটা চেয়ে বসতেই ভদ্রলোক রেগে গেলেন। আমার কাছে এসে চেঁচাতে শুরু করেন। যেন টাকা পয়সা চাওয়াটা ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি এই বলে যে, আপনার মেয়ের খরচাটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ব্যাপার স্যাপার দেখে আমার মিসেস রেগে কাঁই। লোকটির সঙ্গে তর্কাতর্কি জুড়ে দেয়। হায়রে, ডাক্তারের বৌ কী করে জানবে, একটা ডাক্তারকে কতদিক সামলে চলতে হয়!
ঘরে ফিরে বৌ বলে, তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন। লোকটার চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে।
তাকে বোঝাই, কখনো কখনো যুদ্ধে জিততে হলে দু পা পিছিয়ে আসতে হয়। এখন মূল লক্ষ্য, মেয়েটাকে ভালোয় ভালোয় বাড়ি পাঠানো। এই ঘটনায় লাভ ক্ষতি দেখতে যেওনা।
কিন্তু সে তো জানে, এই ঘটনায় জড়িয়ে আমার কতগুলো বিনিদ্র রজনী কেটেছে বা কাটছে।!
শেষপর্যন্ত মেয়েটাকে ছুটি দিই, দু সপ্তাহ পার করে। মেয়েটির বাবা এসে নিয়ে গেছে। ঐ অকৃতজ্ঞ স্বামীটা আর দেখাই করেনি এখনো পর্যন্ত!
সেদিন, খবরে পড়লাম, ছোট শহরেও, কোন রোগীর কোন ধরনের অপারেশনের আগে করোনা টেস্ট করানো আবশ্যক। নাহলে, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা সরবরাহকারীদের কপালে দুর্ভোগ আছে।
তবে, একটা কথা, এই এপিসোডে স্থানীয় প্রশাসন, বিডিও, পঞ্চায়েত, বিএমওএইচ এবং থানা স্টাফ, এঁরা প্রত্যেকেই যথাসাধ্য ভালো ব্যবহার করেছেন আমার সাথে। এঁদেরকে আমার তরফ থেকে অনেক ধন্যবাদ। এঁদের সংস্পর্শে এসেই জানলাম, করোনা নিয়ন্ত্রণে কী দক্ষযজ্ঞ চালাচ্ছেন এঁরা।
কিন্তু, ততদিনে, অন্য এক কানেকশনে আমার বাড়িতে করোনা ঢুকে গেছে।
সে কাহিনী অন্যদিন।
___________
আমি এই ঘটনাটা লিখতাম না। লিখে ফেললাম, শ্যামনগরের প্রয়াত ডাক্তারবাবুর ঘটনাটা পড়বার পরে। এই ডাক্তারবাবুর অকালপ্রয়াণ আমাকে এই মূহূর্তে খুবই পীড়িত করেছে। তুই মরে যাওয়ার পরে চতুর্দিকে তোর গুণগান, তোর কী কাজে লাগছে বল!
আমার বন্ধু ডাক্তারদের এই ঘটনা জেনে রাখা উচিৎ। আজকাল আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, যে যেখানে সবল, সে সেখানে তার সুপ্রীমেসি ফলিয়েই যাবে। এটাই চলবে।
আমাদের বেশিরভাগ লোকজন, প্রতিষ্ঠান, সেরকমই। এটাই ট্রেণ্ড।
কী হবে, নাকে কেঁদে?
_________
এরকম একটা চেম্বার ডায়েরী লিখতে হবে, কোনোকালেই ভাবিনি।
যা যা লিখেছি, সবকিছুর প্রমাণ রেখে দিয়েছি। দিনকাল খুব খারাপ।
শেষে, একটু রসিকতা :
করোনাকে এবার খালি চোখেই দেখতে পাওয়া যাবে, যেমন আমি দেখছি!