একবিংশ শতাব্দীতে এই যে বিশাল ওষুধ ও জৈব প্রযুক্তির বিশ্ব বাজার ও বহুজাতিক কোম্পানির রমরমা ১৯ শতাব্দীর থেকে তার সূত্রপাত। দীর্ঘদিন যে লৌকিক জ্ঞানের ভিত্তিতে ঔষধ বিক্রেতা ও ভেষজবিদদের মাধ্যমে চিকিৎসা চলছিল তা থেকেই ওষুধশিল্পের জন্ম। এই apothecary বা ওষুধের দোকান থেকেই যারা তৈরি করত মরফিন, কুইনইন, strychnine ইত্যাদি ওষুধ, তারা ধীরে ধীরে ওষুধ উৎপাদন শুরু করল। ডাই (রঞ্জক) ও রাসায়নিক কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠা করল গবেষণাগার ও ১৮৮০ সালের পর থেকে তৈরি হতে লাগল আধুনিক ওষুধ। জার্মানির Merck বা মার্ক সম্ভবত প্রথম কোম্পানি যারা এভাবে ওষুধ তৈরি করতে শুরু করল। Darmstadt-এ ১৬৬৮ সালে যে ফার্মেসি তৈরি হয়েছিল তাকে পাইকারীভাবে ওষুধ উৎপাদনের কোম্পানিতে রূপান্তরিত করলেন হেনরি ইমানুয়েল মার্ক ১৮২৭ সালে। তেমন ভাবে Glaxo Smith Kline যা শুরু হয়েছিল ১৭১৫ সালে, তার সাথে বিচাম যুক্ত হল ১৯ শতাব্দীর মধ্যভাগে ও ১৮৪২ সাল থেকে তৈরি করল পেটেন্টেড ওষুধ। পৃথিবীর প্রথম শুধু ওষুধ তৈরির কারখানা তৈরি করল ১৮৫৯ সালে। অপরদিকে ১৮৪৯ সালে দুই জার্মান অভিবাসী আমেরিকাতে তৈরি করলেন Pfizer যা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ব্যথানাশক ও এন্টিসেপটিক বা বীজবারক সরবরাহ করে বিপুল মুনাফা করল। অপরদিকে Pfizer যখন যুদ্ধে প্রয়োজনীয় ওষুধ যোগাচ্ছে, ওই অশ্বারোহী বাহিনীর এক কমান্ডার ছিলেন কর্নেল ইলি লিলি। উনি ছিলেন একজন প্রশিক্ষিত ভেষজবিশেষজ্ঞ রসায়নবিদ (chemist)। উনি ছিলেন উনিশ শতকের বহুগুণসম্পন্ন প্রগতিশীল শিল্পপতি যিনি প্রথম রিসার্চ এর ওপর গুরুত্ব দেন উৎপাদন ছাড়া। এছাড়াও এ সময়ে তৈরি জার্মানীতে শেরিং, ইংল্যান্ডে বরোস ওয়েলকাম, আবট, পার্ক ডেভিস, Upjohn সবই আমেরিকায়।
আরেকজন সামরিক বাহিনীর মানুষ পরবর্তীকালে ওষুধ ব্যবসায় এসেছিলেন। তাঁর নাম এডওয়ার্ড রবিনসন স্কোইব(Squib)। উনি ছিলেন নৌবাহিনীর চিকিৎসক যিনি আমেরিকা মেক্সিকোর যুদ্ধে ওষুধ জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন গুণগত মান ঠিক না থাকায়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৮৫৮ সালে উনি তৈরিও করলেন আজকের ব্রিস্টল মেয়ের স্কুইব এর ভিত্তি।
১৯ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সুইজারল্যান্ডের টেক্সটাইল ও ডাই শিল্পের হাত ধরে উত্থান ওষুধশিল্পের যেহেতু তারা বুঝল ডাইস্টাফ এর এন্টিসেপটিক ও অন্য ভেষজ গুণ আছে। এই সময় স্যান্ডোজ, সিবা গায়গি, রোস, এসব কোম্পানির উত্থান। শুধু সুইস কোম্পানি নয় ১৮৬৩ সালে আরেকটা ডাই তৈরি করা কোম্পানি যার উৎপত্তি কার্ল মার্ক্সের অন্যতম সহযোগী ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বাড়ি যে উপেরটালে সেখান থেকে। কোম্পানীর নাম বায়ার। এরাই Aspirin-র বাণিজ্যিক সওদা করা শুরু করলেন।
তখনো ফার্মাসিউটিক্যাল ও কেমিকেলের পৃথক অস্তিত্ব সেভাবে ছিল না ফলে যারা টুথপেস্ট, কড লিভার অয়েল তৈরি করে তারাই ওষুধ তৈরি করত। যেমন আপনারা দেখবেন বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডকে। যাক, ইতিমধ্যে অনেক কোম্পানি যেমন ওয়েথ, সিবা MSD এরাও এসে গেছে ।
১৯১৮ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে দুটো ঘটনা আজকের ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি বা ওষুধ শিল্পের উত্তরণের পূর্বাভাস সূচিত করল। এক, ফ্রেডরিক ব্যানটিং ও তার সহযোগীরা ইনসুলিন আবিষ্কার করলেন যা diabetes বা মধুমেহ রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষ দরকারি। ইনসুলিনের গবেষণা ও বাণিজ্যিকভাবে তাকে নিয়ে আসতে ইলি লিলি কোম্পানির বিজ্ঞানীরা বিশেষ সহায়তা করলেন।
আরেকটি হল পেনিসিলিন আবিষ্কার, যা ওষুধের জগতে যুগান্ত আনল। ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করলেও হয়ার্ড ফ্লোরে ও এরনস্ট চেইন একে সম্পূর্ণ করলেন, যাকে মার্ক, ফাইজার ও স্কোইব গণউৎপাদন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর সেনাবাহিনীর প্রাণ বাঁচায় ও প্রচুর মুনাফা লাভ করে।
এরপর এক এক করে একেকটি ওষুধ সমস্ত পরিস্থিতি বদলে দিল। ১৯৬০- এর সময় গর্ভনিরোধক পিল, ১৯৬৩ সালে diazepam আনল রোস, মনোরোগের ওষুধ haloperidol , ১৯৭০ এ ক্যান্সার ড্রাগ বা ACE inhibitor ১৯৭৫সালেএসব চিকিৎসা ক্ষেত্রে যুগান্ত আনল।
কিন্তু এর সাথে গোটা ওষুধ গবেষণা ও শিল্প কিছু বহুজাতিকের হাতে বন্দি হয়ে গেল। কিভাবে আলোচনা করব পরের পর্বে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র:
1. https://www.wonderslist.com/10-popular-companies-profited-nazis/
2. Government’s Policies and Growth of Pharmaceutical Industry in India 1947-2018 :A Review Discussion Paper Prasanta Kumar Ghosh published by RIS (Research and Information System for developing Countries)
3. Federation of Medical and Sales Representatives’ Associations of India, news and conference documents Patna 2019
4. শ্যামল চক্রবর্তী, ঐতিহ্য উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১১ সাল
5. অসুস্থ ওষুধের জগত Association of Health Service Doctors, West Bengal Medical and Sales Representatives Union লেখক ডাঃ তাপস সেন শ্রী অমিতাভ গুহ, এপ্রিল ২০০৮
6 পেটেন্ট কাহিনী আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, লেখক অংশুতোষ খাঁ ও শ্যামল চক্রবর্ত্
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, আগস্ট ২০০৬
7. প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিৎসা, লেখক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মৌলবাদ ও বিজ্ঞান, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ
8. সাবধান জীবাণুরা নিকটেই আছে! মৃত্যুঞ্জয়প্রসাদ গুহ, জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশন্ জানুয়ারি 2006
9. Pharmaceutical Industry in India wikipedia
10. বিশ্বায়ন ভাবনা দুর্ভাবনা, সম্পাদকঃ অমিয় বাগচী, অমিতাভ গুহ, ২০০২, প্রকাশকঃ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
11. The 21 st Century Pharmaceutical and Biotech Sector Robin Walsh
12. সবার জন্য নয় ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা dw.com
13. National Family Health Survey 65 (NFHS-4) Ministry of Health and Family Welfare 2015-16
14. What are APIs and How They Threaten India’s Status of a ‘Pharmacy of the World’, Himani Chandna, The Print 26th February ,2020
15 .The Health Workforce in India, Human Resources for Health Observer – Issue No. 16 WHO
16. Emergence of Pharmaceutical Science and Industry: 1870-1930 Chemical and Engineering News, Vol.83, Issue 25