যখন রাজ্যে পরিবর্তনের আওয়াজ উঠেছিল তখন রবিঠাকুরের একটা গান মিটিং-এ মিছিলে গাইতাম খুব। গানটা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মিছিলে, সবাই মিলে এক সাথে গাওয়া যেত বলেও হয়ত।
তখন কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভাল চলছে, আমরা অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদনের বাইরে রাস্তায় খালি গলায় এই গান গাইতে গাইতে হাঁটছি, ছোট্ট একটা মিছিল। গলায় জোর থাকায় অন্যদিনের মত আমি গানটির লিড করছিলাম। পুলিশ আটকে দিল। আমরা রবীন্দ্রসদনের সামনে বসে পড়লাম। তারপর পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি, পুলিশের স্বল্প বলপ্রয়োগ, ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম আমরা। জনা পঞ্চাশেককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল লালবাজার। মনে আছে গভীর রাতে লালবাজারের ভেতরে বসে আছি কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে, সঙ্গীদের মুক্ত করতে হবে। গেটের বাইরে ভিড়। পুলিশ একটা জায়গায় বসিয়েছে আমাদের। করা যেন কথা বলছেন পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে। আমি আর কবি বসে আছি, অপেক্ষা। কবি নানা বিষয়ে কথা বলে চলেছেন। কবির সঙ্গে ওই রাতের দীর্ঘ, একান্ত আলাপচারিতা আমার সম্পদ হয়ে আছে।
পরদিন সুমন-এর অনুষ্ঠানে ডাক। তর্ক জমে উঠেছে। পুলিশের এরকম অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য পুলিশের মুণ্ডুপাত করছি আমরা। সুমন বললেন, পুলিশ কমিশনার অনুষ্ঠান দেখে ফোন করেছেন। কিছু বলবেন। তখন পুলিশ কমিশনার ছিলেন গৌতমমোহন চক্রবর্তী। তিনি বললেন আমাকে একটা প্রশ্ন করতে চান। খুব ভদ্রতা এবং বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমি পল্লববাবুর গান শুনতে খুব ভালবাসি, কিন্তু উনি ঠিক ওইদিন, ওইসময়ে, ওইখানে, ওইভাবে ওইগানটি গাইতে গাইতেই ঘুরছিলেন কেন?’ এরকম অদ্ভুৎ প্রশ্নে কৌতুক এল। উত্তরে স্বভাবতই যা বলেছিলাম তার সারমর্ম হল, ‘মিস্টার কমিশনার, আমার গান আপনার ভালো লাগে জেনে খুব ভালো লাগল কিন্তু কোন গান কোনোদিন, কোন সময়, কোথায়, কীভাবে গাইব সেটা ঠিক করব অবশ্যই আমি, কোনো পুলিশ কমিশনার নন।’
এরপর বাদানুবাদ চলতে থাকে, সেসব পুরোনো কাসুন্দি এই লেখার বিষয় নয়। যেটা বলার তা হল, এই গান গেয়ে গেয়ে যে পরিবর্তনের কথা বলেছিলাম সে পরিবর্তন আমাদের গভীর অন্ধকারে ঠেলে নিয়ে চলেছে। মানুষের ন্যূনতম নৈতিকতার বোধকে ক্রমাগত ধংস করে চলেছে। একটা সরকার যে এরকম সর্বব্যাপী, নির্মম দুর্নীতিগ্রস্থ হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এখান থেকে বেরতে হবে। গত এক দশক ধরে আমি আমার নিজের গানে ক্রমাগত এই সকল দুর্নীতি বলে চলেছি। আমার গান গাওয়ার পেশা ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু আমি সরে আসিনি। অপেক্ষা করে আছি কবে জনগণ রবিঠাকুরের এই গানটি কন্ঠে নিয়ে আবার পরিবর্তনের পথ হাঁটবে।
‘এবার তোর মরা গাঙে’ গানটির একটি পুরোনো রেকর্ডিং আমার চ্যানেলে দিলাম। এই রেকর্ডিং-এ ব্যবহৃত গানটির যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে গোলমাল হয়েছিল তিরিশ বছর আগে। পরে কখনও বলব সেই স্মৃতি!










