ছেলেটা ছিল রোগা এবং লাজুক। এমনকি সেটা একধরনের হীনমন্যতাও হতে পারে। তাই সে একা একাই হাঁটতো। গ্রীষ্মের দগ্ধ দুপুর কিংবা বৃষ্টির উপুর ঝুপুর বিকেল। সে ঘুরে বেড়াতো একাই। যখন দারুণ গরমে ঝাঁ ঝাঁ করতো মাঠ ঘাট। সে একাই কুড়িয়ে আনতো কাঁচা মিঠে আম। ঝিনুকের খোলায় ছুলে ফেলতো ফটাফট। রুলটানা বাংলা খাতার ছেঁড়া পাতায় শিলে বাটা লাল লাল ঝালনুন। তখনই শোঁ ও ও ও করে উড়ে যেত এরোপ্লেন। শিমুল গাছের উপরদিয়ে চুর্নী নদীর ঐপারের দিকে। পকেটের সমান করে কেটে রাখা দেশলাইয়ের খাপ টাকার মতন করে গুনতে গুনতে সে ভাবতো বড়লোক হলে একদিন এরোপ্লেন চড়বে নির্ঘাত।
বর্ষার পর পরিষ্কার হয়ে আসা বিকেলে সে বসতো জল ছপ ছপ স্কুল মাঠে। চোরকাঁটাদের উপরে ফড়িং এর দাপাদাপি, উরুৎ ফুড়ুৎ চঞ্চলতা । জলের উপর দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে একটা মেয়ে। লাল ফ্রক। তার ছিপছিপে ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে ছেলেটার পা। একটা চোরকাঁটার ডাঁটি চেবাতে চেবাতে তার মনে হল একটা সাইকেল থাকলে বেশ হত।
তা সাইকেল একটা হয় তার। ক্লাস সেভেন। হাফ প্যাডেল চালাতে গিয়ে দু একটা পড়ে ছড়ে যাওয়া বাদ দিলে ভালই চলছিল নীল হারকিউলিস। বাস স্ট্যান্ডের ঢালু থেকে রেস। কিংবা হাত ছেড়ে চালাতে চালাতে দাঁড়িয়ে পরা দুই প্যাডেলে ভর দিয়ে । নীলকুঠির ঢিপিটা পার হতে হতে সেবার রূপাই বললো ফরেস্ট যাবি! ফরেস্ট?
পুরও গ্রামটা ততদিনে অনেকটুকুই কব্জায় তাদের। কিন্তু ফরেস্ট মানে তখনও সারি সারি গাছ আর বাঘ সিংহের হালুম। ডিসকভারি অনেক দূরের বস্তু, টিভি বলতে চিত্রহার আর দুপুর বেলার জননী। আর ঘুরতে যাওয়া বলতে দীঘা কিংবা পুরী। কেউ ঘুরতে গেলে সাথে করে নিয়ে আসতো অ্যালুমিনিয়াম এর বাটি, কাঠের পেন। তাতে খোদাই করে লেখা থাকতো: পুরী। ফরেস্ট ঘুরতে যেত না কেউই। তাই ফরেস্ট মানেই ঈশপের গল্প। বাঘের হালুম।
রূপাই এর কথায় চমকে ওঠে ছেলেটা। ফরেস্ট? সেটা কোথায়?
মাথার উপর সাইকেল তুলে ব্রীজ টপকে ওপারে যাওয়া সেই প্রথম।
সার সার গাছের মাঝখান দিয়ে মোরামের পথ। দুই পাশে ইউক্যালিপটাস। মেহগনি। জারুল। হলুদ ফুলের গালিচার গা ঘেঁষে সাইকেল স্ট্যান্ড করায় তারা। তাদের হাতে রিং দেওয়া সাইকেলের চাবি। রূপাই ততক্ষণে একটা অর্জুন গাছের ছালে লিখে ফেলেছে আর প্লাস আর।
ছেলেটাও লিখতে যায়। এস প্লাস …। কি যেন নামটা ওর। গালে টোল। ক্লাস সেভেন… লাল লেডিবার্ড।
সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। চুর্নীর জলে ঝিলমিল বাজারের আলো। এই প্রথম সন্ধ্যা পার করে বাড়ি ফিরছে সে।
বাড়ির রাস্তায় অবনীদের বাড়ি। সেখানে আজ খুব ভীড়। কাছা কাছি আসতেই বোঝা যায়, আজ শনি পুজো। জল চৌকির ওপরে একটা আসন পেতে পুজো। পুজো শেষে কলা পাতায় বসিয়ে প্রসাদ। ততক্ষণে রাজ্যের খিদে চেপে বসেছে ছেলেটার পেটে। উঠোনে পাতা হয়েছে চট। কলা পাতার উপর ছপ ছপ পড়ে যাচ্ছে চাল কলা, মুড়ি, খই, সিন্নি প্রসাদ। একটা হ্যাজাকে সাঁইসাঁই পাম্প করছে শ্যামলকাকু।
বাড়িতেও তখন অনেক লোক। উঠোনে গ্রামের অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। খবরের কাগজে আলতা দিয়ে লেখা হচ্ছেঃ ইনকিলাব। জিন্দাবাদ।
ছেলেটার মাথায় এসব ঢোকে না। সাইকেলটা বারান্দায় তুলতে তুলতে প্রশ্ন করে বিনোদ জেঠুকে, এইসব কী লিখতাছো জ্যেঠু?
লাল চা আর তেল লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে মাখা মুড়ি খেতে খেতে বিনোদ জ্যেঠু উত্তর দেয়ঃ সামনে ভোট তাই পোস্টার লিখতাছি বাবা।
– এইসব লেইখ্যা কি হইবো জেঠু?
– এইসব লেইখ্যা আমরা আমাদের কথা মানুষের লগে যানামু। মানুষ আমাগো ভোট দিবো। তয় আমরা জিতুম।
– তোমরা জিতলে কী হইবো?
চা শেষ করে একটা বিড়ি ধরায় বিনোদ জেঠু, – আমরা জিতলে সাম্যবাদ আইবো। হগ্যলের অধিকার সমান হইবো। বড়লোক গরীব লোক হোগ্যলে সমান হইবো, বুঝলা…
ওরা বড়লোক। ওদের দোতলা বাড়ি।
ওর গালে টোল পড়ে। ওর বাবার মোটর গাড়ী।
হয়তো পৃথিবীর সব প্রেমিকরাই সাম্যবাদী |
কি জানি কী মনে করে, বাংলা খাতার পেছন পাতায় লিখে ফেলে ছেলেটা: ইনকিলাব। জিন্দাবাদ।
এস প্লাস……