‘জিনিয়াস’ শব্দখানা বহু ব্যবহারে এমন ক্লিশে হয়ে গিয়েছে যে, লিনাস পলিং-কে স্রেফ জিনিয়াস বললে তাঁর আশ্চর্য মেধা ও সেই মেধার ব্যপ্তিকে বুঝিয়ে ওঠা যায় না। অথচ, মুশকিল, বিকল্প শব্দও এখুনি মনে পড়ছে না। তার চেয়ে বরং, আসুন, আপাতত বিশেষণ যোগ করার চেষ্টা ছেড়ে তাঁর গবেষণার একটু আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করা যাক।
ছেলেবেলার কেমিস্ট্রি বইতে পড়েছেন, দুই বা তার বেশী মৌল যুক্ত হয়ে যখন যৌগের জন্ম দেয়, তখন পরমাণুগুলো একে অপরের সাথে বন্ড তৈরীর মাধ্যমে যুক্ত থাকে। মূলত দুধরণের বন্ড – আয়োনিক, অর্থাৎ বাইরের কক্ষের ইলেকট্রন একজন ছেড়ে দিয়ে ধনাত্মক কণায় পরিণত হয়, আরেকজন সেই ইলেকট্রন নিয়ে পরিণত হয় ঋণাত্মক কণায়, আর সেই দুই কণা জুড়ে থাকে শেষমেশ আয়োনিক বন্ডের সুবাদে – আর নাহলে কোভ্যালেন্ট বন্ড, যেখানে একটি পরমাণুর বাইরের কক্ষের ইলেকট্রন আরেক পরমাণু ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে, আর সেই ভাগাভাগির টানেই পরস্পর যুক্ত থাকে।
আমরা তো জানিই, পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন, বাইরের কক্ষে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। কিন্তু, গত শতকের প্রথম দিকে, পরমাণুর উপাদান যেসব কণা, যেমন ইলেকট্রন ইত্যাদি, তাদের ব্যাপারটা বিজ্ঞানীরা আর তেমন সরল চোখে দেখতে রাজি হলেন না – কোয়ান্টাম তত্ত্ব এসে পুরোটাই গুলিয়ে দিল – ইলেকট্রন তো তার অবস্থান নিয়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল – যে ইলেকট্রন কখন কোথায় থাকে, তা-ই নিশ্চিত করে বলতে চাইলেন না নতুন তত্ত্বের বিজ্ঞানীরা, সে একেবারে কক্ষ ছেড়ে যাচ্ছে, অন্য পরমাণু তাকে লুফে নিচ্ছে, কখনও ভাগাভাগি করে জুড়ে থাকছে কোভ্যালেন্ট বন্ডে, সেটা বড্ডো আশ্চর্য শুনতে লাগছিল – কিন্তু, ফিজিক্সের সাথে তাল মিলিয়ে রসায়নশাস্ত্রের বিজ্ঞানীরা নতুন পথও খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
এমন সময়, প্রায় আচমকা, মাত্র তিরিশ বছরের এক মার্কিন তরুণ একখানা পেপার লিখে বসলেন, ১৯৩১ সালে – মুখ্য উপপাদ্য, দুটি পরমাণুর মধ্যে যে বন্ড, সেটা মোটেই পুরো ছেড়ে দেওয়া আর ধরে নেওয়ার মতো নয় (অর্থাৎ আয়োনিক বন্ডের তত্ত্ব), আবার একটি পরমাণুর কক্ষে স্থিত ইলেকট্রন আরেক পরমাণু ভাগাভাগি করে নিচ্ছে, এমনটাও নয় (অর্থাৎ কোভ্যালেন্ট বন্ডের তত্ত্ব) – আদতে, ব্যাপারটা আরেকটু জটিল, এই দুইয়ের মাঝামাঝি। আরেকটু জটিল কথাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল, কেননা, শোনা যায়, খোদ আইনস্টাইনকে যখন জার্নাল কর্তৃপক্ষ এই পেপারটি দেখে বিচার করতে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি নাকি বলেছিলেন, নাঃ, ব্যাপারটা আমার পক্ষে বড্ডো খটোমটো। কিন্তু, মোদ্দা কথাটা এই, যে, তিরিশ বছর বয়সী এই তরুণ তুর্কির, থুড়ি তরুণ মার্কিনির গবেষণাপত্র এক ঝটকায় রসায়নে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে ফেলল – তাত্ত্বিক রসায়নবিদ্যাকে বিংশ শতকের উপযোগী করে ফেলল। সেই তরুণের নাম লিনাস পলিং। এই একটি পেপারের সুবাদে তিনি বছরের সেরা তরুণ রসায়নবিদের পুরস্কার পান, সবচেয়ে অল্পবয়সী হিসেবে সেদেশের ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সে নির্বাচিত হন, ক্যালটেকে প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হন – হ্যাঁ, ওই তিরিশ বছর বয়সেই – আর এই পেপারের জন্যেই পান কেমিস্ট্রিতে নোবেল প্রাইজ, ১৯৫৪ সালে।
আপনারা যারা অলরেডি তিতিবিরক্ত হয়ে ভাবছেন, ভিটামিন বা মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল নিয়ে বলতে বসে এসব গল্প ফাঁদার মানে কী, অথবা রীতিমতো আতঙ্কিত যে, এইবার কি তবে ভিটামিনের রাসায়নিক গঠনপ্রকৃতি নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় চলে যাচ্ছি – নাঃ, বিচলিত হবেন না, একটু ধৈর্য ধরুন, প্লীজ – লিনাস পলিং ঠিক কোন পর্যায়ের বিজ্ঞানী ছিলেন, সেটার আন্দাজ না পেলে তাঁর ভিটামিনসংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্বের গুরুত্বটা ধরা যাবে না – বিভ্রান্ত অনেকেই করেন, অনেক বিজ্ঞানীও করেছেন – কিন্তু, লিনাস পলিং-কে কেবল আরো একজন বিজ্ঞানী বললে কিছুই বোঝানো যায় না, কাজেই তাঁর দায়িত্ব বা তাঁর বিভ্রান্তির অভিঘাত আরো অনেক গভীর। প্লীজ, আরেকটু সবুর করুন।
আর, আপনাদের মধ্যে যাঁরা ডক্টর্স ডায়ালগে এইসব কেমিস্ট্রির কচকচি নিয়ে আলোচনার জন্যে মনে মনে আমায় তুলোধোনা করছেন, তাঁদের বলি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এগিয়ে চলার ইতিহাসে চিকিৎসকদের সাথে প্রায় সমান অবদান রয়েছে পদার্থবিদ ও রসারনবিদদের – লুই পাস্তুর সে অর্থে ডাক্তার ছিলেন না, আর যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ দিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসার মোড় ঘুরে গেল, তার অগ্রপথিক রন্টজেন-বেকেরেল-মাদাম কুরি কারো সাথেই চিকিৎসাশাস্ত্রের যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু, আবার দেখুন বেলাইনে চলে যাচ্ছি – পলিং-এ ফিরে আসি – দেখুন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের বেশ কিছু ক্ষেত্রে লিনাস পলিং-এর অবদান অনস্বীকার্য।
সিকল সেল অ্যানিমিয়া এক বিশেষ ধরণের রক্তাল্পতা – হ্যাঁ, খুবই জটিল ধরণের রক্তাল্পতা। বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরেই লক্ষ্য করেছিলেন, এই বিশেষ রক্তাল্পতায় যাঁরা ভোগেন, তাঁদের হিমোগ্লোবিন আর পাঁচজনের চাইতে আলাদা – কোষে অক্সিজেন পৌঁছাতে গিয়ে এই হিমোগ্লোবিন কেমন একটা তাল পাকিয়ে যায়, লোহিত রক্তকণিকা বেঁকেচুরে গিয়ে সরু রক্তজালিকার মুখ বন্ধ করে ফেলে – অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার কাজের কাজ তো হচ্ছেই না, উপরন্তু রক্তসঞ্চালনই বন্ধ হওয়ার জোগাড়। পলিং সর্বপ্রথম দেখালেন সিকল হিমোগ্লোবিনের বিশেষত্ব – আর পাঁচটা হিমোগ্লোবিনের সাথে তার ইলেকট্রিকাল চার্জের ফারাক – এক ঝটকায় খুলে দিলেন নতুন পথ – মলিকিউলার বায়োলজি – যে পথ ধরে সিকল সেল অ্যানিমিয়ার সুরাহা না মিললেও, চিকিৎসাবিজ্ঞানের বহু নতুন আবিষ্কার এসেছে।
আমরা সবাই জানি, প্রোটিন তৈরী হয় অনেকগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিড পরপর জুড়ে। কিন্তু, অনেকগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিড সম্বলিত ফিতে হলেই কি প্রোটিন? শরীরে প্রোটিন কীভাবে কার্যকরী হচ্ছে, তার পেছনে শুধুমাত্র তার রাসায়নিক গঠনই নয় – আরো অনেক কিছুর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরপর অ্যামাইনো অ্যাসিড কীভাবে জুড়ে ফিতেটি তৈরী হয়, সেই রাসায়নিক কাঠামোকে যদি প্রাথমিক বা প্রাইমারি স্ট্রাকচার বলা হয়, অ্যামাইনো অ্যাসিডের ফিতেটি ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে কীভাবে থাকছে, অর্থাৎ সোজা নাকি পেঁচিয়ে নাকি গুটিয়ে, সেই সেকেন্ডারি স্ট্রাকচারও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জানিয়ে রাখা যাক, এই সেকেন্ডারি স্ট্রাকচারের ধারণাও লিনাস পলিং-এর। গতশতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের একটি, ওয়াটসন-ক্রিকের ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার, পলিং-এর সেকেন্ডারি স্ট্রাকচারের ধারণার পথ ধরেই।
বায়োলজির জগতে লিনাস পলিং-এর অবদান এখানেই শেষ নয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদ অনুসারে আমরা, অর্থাৎ মনুষ্যপ্রজাতি এসেছি, বানরজাতীয় প্রাণীর উত্তরসূরী হিসেবে – গোরিলা, শিম্পাঞ্জি, বানর সম্পর্কে আমাদের বিবর্তনতুতো বাপ-ঠাকুরদা ভাইবেরাদর। কিন্তু, আমরা এনাদের থেকে ভেন্ন হলাম কবে? উত্তর খুঁজলেন সেই পলিং-ই। চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জি-গোরিলা-বানরের রক্তের সাথে মানুষের রক্তের তুলনা করে দেখতে থাকলেন – খুঁজতে থাকলেন মিউটেশন। মিউটেশনের গতিপ্রকৃতি আর সংখ্যা গুণে নির্ধারণ করলেন – গোরিলা থেকে মানুষের আলাদা হওয়ার শুরু সেই এগারো মিলিয়ন বছর আগে থেকে – বাজারচলতি বয়ান থেকে মানববিবর্তনের টাইমলাইন পিছিয়ে গেল অনেক অনেএএক বছর – খুলে গেল মলিকিউলার ও জেনেটিক প্যালিওন্টোলজি, ইভোলিউশনারি বায়োলজি – যে পথ দিয়ে পরবর্তীতে আসবে সভ্যতার ইতিহাসের নতুন নতুন ধারণা।
কিন্তু, লিনাস পলিং মানে তো শুধু একজন অসামান্য প্রতিভাবান বিজ্ঞানীই নন। আজ যখন পড়াশোনার জগতের লোকজন রাজনীতিতে জড়াবেন কেন, এই মতামতের বহুল প্রচার, বিজ্ঞানজগতের শীর্ষে থেকেও পলিং ছিলেন অ্যাক্টিভিস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে যুদ্ধবিরোধী প্রচার তথা পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম সারিতে। পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা দেখার পর তিনি প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন, এমন নয় – আগাগোড়াই শান্তিকামী এই দূরদর্শী মানুষটা পরমাণু অস্ত্র তৈরীর ম্যানহাটান প্রজেক্টে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন প্রথমেই – পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিতর্কে অংশ নিতেন – বাকি আরো অনেক নোবেলবিজয়ীদের সংগঠিত করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে পথে নামিয়েছিলেন – মূলত তাঁর, এবং তাঁর মতো অনেকের লাগাতার প্রয়াসেই পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করা সম্ভবপর হয়েছিল – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত হাজার গবেষণার ফাঁকে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে, লাগাতার চারটি দশক। ১৯৬২ সালে, এককভাবেই, তাঁকে দেওয়া হয় নোবেল শান্তি পুরষ্কার – এককভাবে একাধিক নোবেল পুরষ্কার জয়ের কৃতিত্ব দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির নেই।
এহেন লিনাস পলিং, গতশতকের শ্রেষ্ঠতম জিনিয়াসদের একজন – জড়িয়ে পড়লেন ভিটামিন সাপ্লিমেন্টের অগাধ গুণ প্রমাণে। আর আস্তে আস্তে হারাতে থাকলেন তাঁর এতবছরের গবেষণার শেষে অর্জিত সম্মান। কিংবদন্তীর আসন থেকে তাঁর পতনকে তুলনা করা হয় মহান গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়কের আশ্চর্য জীবনের সাথে।
কিন্তু, সে তো কল্পনার নায়কের কল্পিত ট্র্যাজেডি – আর লিনাস পলিং তো রক্তমাংসের মানুষ।
(চলবে)
দ্রুত পরের অংশ চাই।
পরের পর্ব তো আজই দেওয়া হয়েছে। দ্যাখো। ??
https://thedoctorsdialogue.com/chima-linus-pauling-vitamins-3/