চেম্বারে দুজন প্রাপ্তবয়স্কা নারী আর একজন পুরুষমানুষের প্রবেশ পরবর্তী কথোপকথন।
–ডাক্তারবাবু, আমরা সদ্য বিবাহিত, এখনই সন্তান চাইনা। সেই পরামর্শের জন্যই এসেছি।
–কি নাম?
–আমি তাপসী।
–ওকে। সচেতন মানুষ তোমরা। সঠিক পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য কিছু তথ্য দরকার। যেমন বয়স বলো,
–আমার ২৩, ওর ২৯,
–ওজনটা দ্যাখো।
–কী আশ্চর্য! দুজনেই ৫৭,
–একটা কথা মন দিয়ে শোনো। প্রেগন্যান্সি এড়ানোর জন্য যেসব উপায় আছে, তার একটা হল, সেফ পিরিয়ড, মানে, একটা মাস অর্থাৎ একটা ডেট থেকে আরেকটা ডেট পর্যন্ত যে সময়, ধরে নাও সেটা ৩০দিন, এই তিরিশ দিনের মধ্যে প্রথম সাতদিন আর শেষ সাতদিন মোটামুটি সেফ টাইম ফর ফ্রি সেক্স। এই সময়টায় মেয়েদের পেটে জীবিত ডিম্বাণু থাকেইনা বলতে গেলে। তাই শুক্রাণু ভেতরে গেলেও সে নাবিক হারাবে দিশা।
–তাহলে, মাঝের সময়টা কী হবে?
–রোসো, রোসো, এক এক করে সব বলবো, বাকিটা তোমার চয়েসের উপর ছাড়বো। মাঝের সময়টা রিস্কি। তখন, তিনি সেজেগুজে বসে থাকতে পারেন, যে কোনদিন। কে বলো দেখি?
–কে? কে বসে থাকবে? আমি? আমিতো রোজই সাজি।
–হ্যাঁরে বাবা, মেয়েরাই সাজবে। ওদের বার্থ রাইট। শুধু তাই নয়, বার্থ ক্রিয়েট করবার রাইটটাও তোমাদেরই। মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়, ম্যাচিওরড ডিম্বাণু রেডি হয়ে পেটের মধ্যে বসে থাকে, অপেক্ষায় থাকে, কখন সে দলবল নিয়ে এসে ছিন্ন ভিন্ন করে তুলে নিয়ে যাবে। তাই তো ঐ সময়ে মিলিত হতে চাও অথচ যদি তারে না চাও, তাহলে সিকিউরিটি পোস্ট করতে হবে, যার কোডনেম কনডোম।
–এঃ, ওগুলো বিচ্ছিরি জিনিস। ফেলবো কোথায়?
–কারেক্ট! শুধু তাই নয়, নতুন বিয়ে হওয়া কাপল’কে কনডোম ইউজ করতে বলা ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে বলে আমি মনে করি।
–তাহলে? আর কোনো ভালো উপায় বলুন।
–বলছি, বলছি। একটা কথা বলে রাখি, প্রথমবার মা হবার জন্য ২২-২৪, এই বয়স রেঞ্জটাই বেস্ট। আর প্রেগন্যান্সি, মা হওয়া, এই ব্যাপারটা একটা মেয়ের জীবনে অনেকটা অ্যাসিড টেস্টের মতো। এটা উৎরে যাওয়া জীবনের একটা ভালো দিক। তাও, তোদের বলি, যাদের বয়স কম, বডি ওয়েট বেশি নয়, লিভারের কোনো রোগ না থেকে থাকে, তারা LDP খেতে পারে।
— LDP? কী?
— Low dose pill. কন্ট্রাসেপটিভ পিল। এগুলো খেলে তেমন ওজন বাড়েনা। ওজন, বা BMI, উচ্চতার অনুপাতে ওজনে ভারসাম্য থাকা উচিত।
–কী নিয়মে খেতে হবে?
–পিরিয়ড শুরুর তৃতীয় দিনে শুরু করে, রোজ খেতে হবে টানা একুশ দিন। তারপর ওষুধ বন্ধ। আবার পিরিয়ড শুরু হলে, তৃতীয় দিন থেকে নতুন প্যাকেট শুরু করতে হবে। এইভাবে, তুই যতগুলো মাস চাস। ধর, বড়জোর এক বছর।
–কিন্তু, ও তো পনেরোদিন অন্তর বাড়ি আসে। দুদিন করে থাকে। তাও আমায় সারা মাস, ওষুধ খেতে হবে?
–একদম, ইয়েস, সারামাস।
–তাহলে ওইগুলো কি? ঐ 72, না কি যেন বলে?
–ওগুলো ফালতু, কেবল বিপদটাকে বাড়ায়। ও হ্যাঁ, তোকে বলতে ভুলে গেছি, জেনে রাখ, সেফটি পিরিয়ডের ফেলিওর আছে। শরীর সবসময় নিয়ম মেনে চলেনা। ভেতরে ভেতরে পাল্টি খেতে পারে। চরিত্রের মতো। হয়তো একেবারে হিসেবের বাইরের দিনেও ডিম্বাণু বেরিয়ে আসতে পারে। তখন দেখা যাবে প্রেগন্যান্সি এসে গেছে। রেখে দিবি। প্রথম প্রেগন্যান্সি কক্ষণো নষ্ট করতে নেই। ফল মারাত্মক হতে পারে।
–আপনি যে বললেন, শেষ সাতদিন সেফ। তাহলে?
–বললাম না, শরীর সবসময় একই ক্যালেন্ডার ফলো করেনা। একটা ঘটনা বলি শোন। অনেকদিন আগে, একবার একটা অল্প বয়েসি মেয়ের মেডিক্যাল রিপোর্ট করতে হয়েছিল রেপ কেসের জন্য। সেটা ছিল মেয়েটার সাতাশতম দিন। তাই আমাদের মেডিক্যাল টিম আর তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু দেড়মাস পরে দেখা গেল মেয়েটা কনসিভ করে গেছে। কাজেই, বুঝলি, এই পদ্ধতিগুলো ১০০% সেফ নয়।
–বড়ি?
–হ্যাঁ, বড়ি, আই মীন ওসিপি, ১০০% সেফ, যদি পারফেক্ট নিয়ম মেনে খায়।
–তাহলে ঐ যে একটা জিনিস, লুপ, না কী যেন বলে, কপাট টি, সেটা ?
–ওহ, কপার টি, ওটা নিতে গেলে একটা সন্তান হয়ে থাকা ভালো। তার আগে ও জিনিস দেওয়ার চল আমাদের দেশে নেই। ডাক্তাররাও বারণ করে।
এবারে দ্বিতীয় মহিলাটি মুখ খুললো।
–ডাক্তারবাবু আমি শাহিন। বুঝতেই পারছেন, মুসলিম। আমি আর তাপসী কোন ছোটবেলা থেকেই সই। আমার একটা বাচ্চা আছে। আমি আর নিতে চাইনা। আমার জন্য কি অ্যাডভাইস করেন? আমাদের পরিবার কিন্তু ধর্মভীরু। আমি নিজেও এর বাইরে যেতে পারবোনা।
–বুঝেছি। তুমি সহী পদ্ধতির খোঁজে এসেছো।
–একদম ঠিক, আবার অ্যাবরশনের পাল্লায়ও পড়তে চাইনা।
–তোমার বাচ্চা নর্মাল না সিজার?
–সিজার করতে হয়েছিল। আবার যদি প্রেগন্যান্সি হয়, সেইতো সিজার হবে। সেটাই ভয়।
–ধরে নিচ্ছি তুমিও তেইশ।ধর্মভীরু হওয়া কোনো অন্যায় নয়। আমি তাই মনে করি। আমাদের সমাজে প্রকৃত নাস্তিকের সংখ্যা নগণ্য। তুমি এক কাজ করতে পারো, ঐ যে লো ডোজ পিল বললাম, ওটা দীর্ঘদিন খেতে পারো। অনেকেই পনেরো কুড়ি বছর ধরে খেয়ে যাচ্ছে।
–অনেকদিন ধরে ওষুধ খাওয়া ঠিক হবে?
–বাৎসরিক মনিটরিংএ থাকলেই হল।
–এ ছাড়া?
–আমার কিছু মাদার আছে, যারা বারবার উন্নতমানের কপার আইইউডি নিয়ে জিন্দেগী কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের অনেকেই এখন শাশুড়ি। একবার নিলে পাঁচটা বছর কেটে যাবে।
–না, কপাটি নাকি ভেতরে ঢুকে যায়, ক্যানসার হয়।
–দ্বিতীয়টা ভুল, অপপ্রচার। প্রথমটা আংশিক সত্য, তবে উন্নতমানের ডিভাইসগুলো সেফ। ভেতরে যায়না।
–আমার ক্ষেত্রে আর কি অপশন সাজেস্ট করতে পারেন?
–সেফ পিরিয়ড আর কণ্ডোম কম্বিনেশন, যেটা তাপসীকে বললাম, সেটা ফলো কর। যদি বাইচান্স এসে যায়, রেখে দিও। তোমার পরিবার ওষুধের সাহায্যে বা ওয়াশ পদ্ধতিতে আর্লি প্রেগন্যান্সি নষ্ট করতে অ্যালাউ করবেনা। যদিও, ধর্মতঃ সেটাও করবার কিছু ক্লজ সহী বলে বর্ণিত আছে। যাকগে, সে কথা বাদ দাও।
–তখন আবার সিজার?
–হ্যাঁ, শুধু সিজার নয়, তার সাথে লাইগেশন। কারণ, বলছি, দুবারের পরেও সিজার করা যেতেই পারে, কিন্তু তখন লাইফ রিস্ক অনেক বেশি। এবং জেনে রাখো, প্রাণ বাঁচানোর জন্য যেকোন স্টেপই জায়েজ।
–চিন্তা বাড়িয়ে দিলেন।
–একটা ঘটনা বলি। সেদিন একজন এসেছেন, 38, খুব কান্নাকাটি করছেন, স্বামীকে দোষারোপ করছেন। যা জানা গেল, বোরখা পরিহিতার ইউরিন পজিটিভ হয়ে গেছে হঠাৎই, প্রায় সতেরো বছর পরে। পিল টিল খেতো। তারপর বছরখানেক কোন প্রোটেকশন রাখেনি। কনফিডেন্স বেড়ে গেছল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মাস তিনেক পরেই ওদের বড় মেয়ের বিয়ে। এখন সে বেজায় কান্নাকাটি জুড়েছে। মহিলা খানিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে মনে হল। এখন, সম্মান বাঁচাতে বেচারিকে ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করতে হবে। এতদিনের ইবাদত…
সুতরাং দ্যাখো, প্র্যাকটিকাল জীবন তোমার, সিদ্ধান্তও তোমাকেই নিতে হবে। আমি সেফটি সাইডে সায় দেবো।
–কপারটি নিয়ে দুরকম মতভেদ আছে, দেখেছেন? নেটে পড়েছি।
–জানি। কোন একটা দল বলেছে, যেহেতু কপারটি নিলে সদ্য তৈরি ভ্রূণ বাচ্চার ঘরে বসতে পায়না, বেরিয়ে যায়, অতএব ওটা নাজায়েজ। দ্যাখো, এরও উত্তর আছে। তাহলে ম্যাসটারবেশন বা হস্তমৈথুনও নাজায়েজ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ জানো?
–আপনি বলুন।
–যে যুগে ইসলাম ধর্ম জন্ম নিচ্ছে, সেই সময় একজন, তার স্ত্রী যাতে গর্ভবতী না হয়ে পড়েন, তার জন্য coitus interruptus, অর্থাৎ ‘বাইরে ফেলা’ প্র্যাকটিস করতেন। সে কথা প্রফেট জানতে পেরেও বারণ করেননি। যেহেতু বারণ করেননি, তাই পদ্ধতিটা বৈধতা পেয়ে যায়। এই বৈধতাকে আমি যদি একটু বিস্তৃতক্ষেত্রে ভাবি? অন্যায় হবে?
আরো একটু শোনো, বেশ দামী একটা আইইউডি আছে, ওষুধ দিয়ে বানানো, হেভি পিরিয়ড ট্রিটমেন্টের জন্য ব্যবহার হয়, পিরিয়ড প্রায় বন্ধই থাকে, ডিম্বাণু বেরোনো বন্ধ থাকে, তাই প্রেগন্যান্সিও হবেনা। সেটাকে নাজায়েজ বলার উপায় নেই। যাদের বয়স কম, হেভি ব্লিডিংএ ভুগছে, কিছু ইউটেরাস কেটে বাদ দেওয়ার উপায় নেই, তাদের এটা অ্যাডভাইস করা হয়।
–তাহলে, যা বুঝলাম, জীবনটাকে, এইযুগের মতো করে সুন্দরভাবে কাটাবার জন্য অনেক উপায় আছে।
–আলবাত আছে। সিদ্ধান্ত আপনা আপনা। তাহলে? এতটাই থাক। অনেক কথা হল।
বলতে দ্বিধা নেই, খুবই চমৎকার ভাবে সমস্যাটা তুলে ধরে সমাধানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ধর্মের অনুষঙ্গ এসেছে।
আসবেই।
ভারতের মত গ্রীষ্মপীড়িত দেশে, বারাসতে আউটডোরে আপাদমস্তক কালো বোরখাঢাকা রোগিনীরা লাইন দেন। কারওর কারওর হাতে কালো দস্তানা। ভালো মন্দের কথা নয়, এইটি বাস্তব। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই চিকিৎসা করতে হবে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা দিতে হবে একাদশীতে নিরম্বু উপবাস করা ধর্মভীরু হিন্দু বিধবা আর কঠোর ভাবে রোজা পালন করা জনসমষ্টিকে।
জানি খুব কঠিন, কিন্তু তার মধ্যেই সবচেয়ে কাজ হয় এই রকমের ড্রাগ শিডিউল তাঁকে নির্বাচন করতে হবে।
চিকিৎসক কোনও ধর্ম প্রচারক নন। এমনকি নাস্তিক্য ধর্মের প্রচারও তাঁর কর্মসূচিতে থাকা উচিত নয়।
যা তাঁর করনীয় তা হল বাস্তবতাকে মেনে কীসে রোগীর সবচেয়ে ভালো হয় সেইটি খুঁজে বার করা। মানুষ আর তার মন সতত পরিবর্তনশীল। ডাক্তারের সুচিকিৎসা আর উজ্জ্বল পরামর্শ সেই পরিবর্তনে অনুঘটকের কাজ করতে পারে।
না করলেও ক্ষতি নেই। রোগীর ওয়েলবিয়িং যতটুকু করতে পারা যায়, ততটুকুই লাভ।