১৭৬০ সাল। উওর আমেরিকার ব্রিটিশ সেনা প্রধান স্যার জেফ্রি আহমার্স্ট চিঠি লিখলেন তাঁর অধস্তন কর্মচারী কর্নেল হেনরি বোকেটকে- “রেড ইণ্ডিয়ানদের নির্মূল করার জন্য তুমি যে পরিকল্পনার কথা বলেছো তাতে আমার আপত্তি নেই। এই অসভ্য উপজাতির মানুষগুলি দিনের পর দিন আমাদের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাহারে মারার জন্য ওদের প্রধান খাদ্য বাইসন মেরে প্রায় শেষ করে দেওয়া হয়েছে। আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে রেড ইণ্ডিয়ানদের বসতির পর বসতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু ছোটো ছোটো উপজাতি দলগুলি আদ্যিকালের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বারবার আমাদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে লোকক্ষয়ের কারণ হচ্ছে। এ অবস্থায় তোমার পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তা হবে সভ্য জগতের প্রতি আশীর্বাদ স্বরূপ।”
*****
কর্নেল হেনরি বোকেট তাকিয়ে ছিলেন ধূ ধূ প্রান্তরের দিকে। এই প্রান্তরের মধ্যেই পাতার কুঁড়েতে বসবাস করে যাযাবর রেড ইণ্ডিয়ানরা।
১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির নাবিক কলম্বাস প্রথম পা রাখেন আমেরিকার বুকে। তার আগে ইউরোপীয়-দের এই মহাদেশ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি ভারতবর্ষতে পৌঁছে গেছেন। তাই তিনি ওখানকার বাসিন্দাদের ইণ্ডিয়ান নাম দেন। এখানকার বিভিন্ন উপজাতির লোকেদের বিশ্বাস ছিল মুখে লাল রঙ মেখে থাকলে কোনও অশুভ শক্তি ক্ষতি করতে পারে না। সেই লাল রঙ মাখার কারণে আস্তে আস্তে তাদের নাম হয় রেড ইণ্ডিয়ান।
এরপর দলে দলে ইউরোপীয়রা আমেরিকায় আসতে থাকে। আমেরিকা তখন খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। সেই সম্পদ দখল করার চেষ্টা শুরু করলে ইউরোপীয়দের সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের সংঘাত শুরু হয়।
হেনরি বোকেট দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে তিনশ বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধ যেন মানস চক্ষে দেখতে পাচ্ছিলেন। গত তিনশ বছর ধরে নির্বিচারে রেড ইণ্ডিয়ানদের হত্যা করা হয়েছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধরা কেউই নিস্তার পায়নি। জোয়ান ও কিশোর ছেলেদের জ্যান্ত ধরে ক্রীতদাস বানানো হয়েছে। আদিবাসী নারীরা বারবার ধর্ষিতা হয়েছে। তাদের জনসংখ্যা এই তিনশো বছরে অর্ধেকেরও নীচে নেমে গেছে। কিন্তু তাদের সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায়নি।
হেনরি নিজের মনে হাসলেন। তিনি এই হাড় হাভাতে অর্ধ নগ্ন মানুষগুলোকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য এক পৈশাচিক পরিকল্পনা করেছেন। পরিকল্পনা সফল হলে রেড ইন্ডিয়ানদের বসতির পর বসতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ যুদ্ধ বিগ্রহের কোনও দরকারই হবে না।
****
পাদ্রী ক্রিস্টোফার ফিলিপস বললেন, ‘এখনও কিন্তু আপনি বলেননি কেন আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?’
হেনরি হাসলেন। বললেন, ‘এমন সুন্দর সকালে প্রথমেই কাজের কথা বলব?’
ফিলিপস বললেন, ‘কাজের কথাটা আগেই হয়ে যাওয়া ভালো। তারপরও যদি সকালটা সুন্দর থাকে তাহলে দুজনে বসে প্রেমালাপ করা যাবে।’
‘ফাদার, আপনি জানেন আপনার রাস্তা আর আমার রাস্তা সম্পূর্ণ আলাদা। আপনি ওই অসভ্য রেড ইণ্ডিয়ানদের স্বাস্থ্যের উন্নতি চাইছেন, ওদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে চাইছেন। অসভ্যগুলোকে মূল ধারায় আনতে চাইছেন। আর আমি ঐ অসভ্য মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে আমেরিকাকে একটা সভ্য দেশ বানাতে চাইছি।’
ফিলিপস বললেন, ‘সভ্যতা কথাটা বড্ড আপেক্ষিক। দুর্বলের রক্তে হাত রাঙানো সকলের কাছে সভ্যতার মাপকাঠি নাও হতে পারে।’
হেনরি বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে কয়েকদিন হল আমার দৃষ্টিভঙ্গিও পালটাতে শুরু করেছে। আপনি হয়ত জানেন কিছুদিন ধরে আমেরিকায় সভ্য মানুষদের কলোনিতে গুটি বসন্তের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। সুস্থ সবল মানুষ দুতিনদিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন। সম্প্রতি এক নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু দেখার পর আমার উপলব্ধি হয়েছে এই যুদ্ধ জয়, এই ক্ষমতার অহংকার এসব কত তুচ্ছ ব্যাপার! সারা জীবনে অনেক পাপ করেছি, তাই এবার বাকি জীবনে একটু পুণ্য করে নিতে চাই।’
ফিলিপস বললেন, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে আদৌ কি আমি কর্নেল হেনরি বোকেটের সাথে কথা বলছি। আমি যতদূর জানতাম সামান্য পাপ, পুণ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো লোক তিনি নন।’
হেনরি দুহাতে ফিলিপসের ডান হাত ধরলেন। ‘ফাদার ওই অসভ্য মানুষ গুলির উন্নতির জন্য আমি সত্যিই কিছু করতে চাই। ওদের সৈনিকদের সাথে আমাদের সৈনিকদের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু ওদের শিশু, নারী এদের সাথে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। আমি কিছু অর্থ, খাদ্য আর কম্বল দিয়ে ওদের সাহায্য করতে চাই। আপনাকে ওরা বিশ্বাস করে। আপনি ওদের কাছে আমার উপহার গুলি পৌঁছে দেবেন।’
*****
ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখে সিউ উপজাতির যোদ্ধা মানুষগুলি গাড়িটি ঘিরে দাঁড়াল। তাদের প্রত্যেকের হাতে বর্শা।
গাড়ি থেকে পাদ্রী ক্রিস্টোফার ফিলিপস নামলেন। তাঁকে দেখে সিউ যোদ্ধাদের মুখে হাসি ফুটল। তারা জানে এই মানুষটি তাদের বন্ধু। আন্তরিক ভাবে তাদের ভালো চান।
ফিলিপস বললেন, ‘দেখো, তোমাদের জন্য কি এনেছি!’
সিউ যোদ্ধারা গাড়ি থেকে ধরাধরি করে খাদ্যের পেটি আর কম্বল নামালো। তাদের প্রধান বললেন, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ফাদার। জিনিসগুলির সত্যিই দরকার ছিল। সাদা মানুষেরা অকারণে আমাদের প্রধান খাদ্য বুনো মোষ মেরে শেষ করে দিয়েছে। আমরা চরম খাদ্য সংকটে ভুগছি। এসময় আপনার সাহায্য আমাদের সিউ উপজাতির মানুষেরা চিরকাল মনে রাখবে।’
ফিলিপস বললেন, ‘উপহার আমি দিচ্ছি না, অন্য একজন দিচ্ছেন। তবে তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। শোনো তোমাদের সাথে একটা জরুরী কথা আছে। এসময় শহরের দিকে কেউ যেও না। সাদা চামড়ার মানুষদের মধ্যে গুটি বসন্তের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। উপজাতির মানুষেরা গুটি বসন্ত রোগে অতীতে কোনদিন আক্রান্ত হয়নি। অতএব তোমাদের মধ্যে ঐ রোগ প্রতিরোধের কোন ক্ষমতা নেই। একবার যদি ওই রোগ তোমাদের মধ্যে ঢোকে তাহলে সমস্ত উপজাতির মানুষেরাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
সিউ যোদ্ধারা ঘাড় নাড়ল। কম্বলগুলিকে তারা আঁকড়ে ধরল। তাদের নারী, বৃদ্ধ আর শিশুরা এই শীতে পাতার কুঁড়েতে খুব কষ্ট পাচ্ছে। এই নরম কম্বল গায়ে দিয়ে তাদের বড্ড আরাম হবে।
****
পর পর কয়েকদিন ধরে পাদ্রী ফিলিপস আরও কয়েকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্নেল হেনরির দেওয়া কম্বল আর খাদ্য বিতরণ করলেন। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, ঈশ্বরের কি অসীম মহিমা, হেনরির মতো একজন নিষ্ঠুর খুনিরও হৃদয়ে পরিবর্তন এসেছে!
তবে তাঁর বিশ্বাস ধাক্কা খেতে শুরু করল যখন তিনি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ার খবর পেলেন। এবং এই জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যেই তিনি খাদ্য আর কম্বল বিতরণ করেছিলেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই উত্তর আমেরিকার উপজাতিদের মধ্যে গুটি বসন্তের মহামারি ঝড়ের মত ছড়িয়ে পরে এবং প্রায় অর্ধেক আদিবাসী মারা যায়।
অবশ্য ফিলিপসকে এসব দেখে যেতে হয়নি। তিনি নিজেও কিছু দিনের মধ্যে গুটি বসন্তে মারা যান।
তিনি জেনে যেতে পারেন নি, যেই কম্বলগুলি তিনি রেড ইন্ডিয়ানদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, এবং রেড ইন্ডিয়ান শিশু ও নারীরা যেই কম্বল পরম বিশ্বাসে গায়ে দিয়েছিল, সেই কম্বলের মধ্যেই ছিল মারণ রোগের বিষ।
হেনরির নির্দেশে হাসপাতালে গুটি বসন্তে সাদা মানুষের মৃত্যুর পর তাদের কম্বল পুড়িয়ে ফেলা হত না। সেগুলি সুন্দর ভাবে গুছিয়ে তুলে দেওয়া হতো পাদ্রী ফিলিপসের হাতে।
সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথমবার নিরীহ মানুষকে মারার জন্য জৈব অস্ত্র বা বায়োটেররিজমের সাহায্য নিয়েছিলেন হেনরি। যুদ্ধের সব রকম নিয়ম কানুন লঙ্ঘন করে লক্ষ লক্ষ শিশু ও নারীদের হত্যা করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় তখনও মানুষ জানত না গুটি বসন্তের জন্য দায়ী একরকমের জীবাণু। সেসময় বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসকদের ধারণা ছিল মহামারীর জন্য দায়ী মিয়াসমা বা ‘বিষ বাষ্প’। এই ঘটনার ঠিক একশ বছর পরে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর জন্ম দেন জীবাণুতত্ত্বের।
আর এভাবেই কয়েক হাজার বছরের আদি বাসিন্দাদের হত্যা করে তাদের সমাধির উপর গড়ে উঠেছে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য দেশ – আমেরিকা।
(পাদ্রীর চরিত্রটি কাল্পনিক)
নির্মম ইতিহাস। ভালো লিখেছো দাদা।
?