প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের কুখ্যাত ট্রেঞ্চ ওয়ার। ট্রেঞ্চযুদ্ধ শুরুর পরে মারা পড়েছে দু’দলের অজস্র সৈনিক। কাঁটাতারের বেড়ার পেছনে পরিখা কেটে বসে আসে শত্রু। অনবরত চলছে গুলি, বারবার একদিক থেকে গ্রেনেড পড়ছে অন্যদিকের ট্রেঞ্চের সেনাদের মাঝখানে। কিছুদিন পরে শুরু হবে গ্যাসযুদ্ধ, পোকামাকড়ের মত মরবে ট্রেঞ্চের সেনারা।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে এসে গেল ডিসেম্বর মাস। ক্রিসমাস ১৯১৪ সমাগত-প্রায়। পোপ বেনেডিক্ট একবার বলেছিলেন বটে ক্রিসমাসে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হোক, যুদ্ধরত দেশগুলি কোনও সরকারী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেনি। কেমন করে যে ক্রিসমাস ইভ-এ ট্রেঞ্চের সৈন্যরা নিজেরাই যুদ্ধবিরতি শুরু করেছিল তা আজও এক প্রহেলিকা।
এক ইংরেজ সৈনিকের বয়ানে জানা যাচ্ছে, “প্রথমে জার্মানরা তাদের ক্যারোল গাইতে শুরু করেছিল, আর অন্যদিকে আমরাও আমাদের ক্যারল গাইতাম। তারপর আমরা শুরু করলাম ‘O Come, All Ye Faithful’, আর জার্মানরা একই স্ত্রোত্র লাতিন শব্দে গাইতে শুরু করল।”
পরের দিন সকালে কিছু জায়গায় জার্মান সৈন্যরা তাদের ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে ইংরেজিতে ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলে শত্রুসেনার মানুষদের অভ্যর্থনা করল। অন্যদিকের সৈন্যরা জার্মানদের প্রতি-অভ্যর্থনা করতে খুব সাবধানে ট্রেঞ্চ থেকে বেরোল। কয়েকজন জার্মান সৈনিক ভুল ইংরেজিতে লেখা “তোমরা গুলি কর না, আমরাও গুলি করব না” প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে ধরেছিল। এভাবেই ক্রিসমাসের দিনটা শুরু হল, আর দিনের শেষবেলায় দেখা গেল পরস্পরকে মারার জন্য উদগ্রীব শত্রুরা নিজেদের মধ্যে সিগারেট, খাবার, বোতাম আর টুপি উপহার দেওয়া-নেওয়া করছে। তারা দুই ট্রেঞ্চের মধ্যেখানে নো-ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে থাকা নিজেদের মৃত সাথীদের কবর দিচ্ছিল। ধীরে ধীরে এক দলের সৈন্যরা অন্য দলের সৈন্যদের কবর দিতে সাহায্য করতে লাগল, আর অন্যদলের মৃতের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর শোক-প্রকাশ করতে শুরু করল।
দু’দলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা, প্রায় ১০,০০০ মানুষ, নিজের দেশের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতক’ এই যুদ্ধবিরতিতে অংশ নিয়েছিল। একজন ব্রিটিশ সৈন্যের অগোছালো অবিন্যস্ত চুল ঠিকঠাক করে কেটে দিয়েছিল এক জার্মান সৈন্য, যুদ্ধের আগে সে ছিল নাপিত। কোথাও বা দুই দলের সৈনিকেরা একসাথে ক্রিসমাসের বিশেষ রেশনের শূকরছানা রোস্ট করে হো-হো হাসি আর গানের সঙ্গে মহাভোজ লাগিয়েছিল। কোথাও দুই দলের মধ্যে শুরু হয়েছিল ফুটবল—‘বল’টা হয়তো ন্যাকড়ার পুটুলি দিয়ে তৈরি। আর আস্তে আস্তে এক দেশের সৈনিক অন্য দেশের ফুটবল দলে দিব্যি ঢুকে পড়ছিল। কেউ জানে না কোন দল কোন দেশ সেদিনের খেলায় জিতেছিল, কারণ সেই খেলার স্কোর রাখার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেনি।
(২)
জিনতত্ত্ব আর বিবর্তন তত্ত্ব—এদুয়ের সার্থক মিশ্রণ হবার পরে নব্য-ডারউইনিয় বিবর্তনতত্ত্ব তিনটি স্তম্ভের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত, কোনও জীব তার নিজের সুবিধা দেখবে। দ্বিতীয়ত, কোনও জীব তার নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সুবিধা দেখবে। তৃতীয়ত, কোনও জীব অন্য অনাত্মীয় জীবের সুবিধা করে দেবে কেবলমাত্র তখনই যখন প্রত্যুপকার পাওয়া যাবে। এখানে ‘সুবিধা’ কথাটার একটা বিশেষ পারিভাষিক অর্থ আছে। ‘সুবিধা’ মানে ‘ইনক্লুসিভ ফিটনেস’ বাড়া, বা পরের প্রজন্মে বেশি বংশধরের মাধ্যমে নিজের জিন বেশি সংখ্যায় যাওয়া।
নব্য-ডারউইনিয় বিবর্তনতত্ত্ব ভুল নয়। কিন্তু তার সরল প্রয়োগ দিয়ে ১৯১৪-র ক্রিসমাসে ট্রেঞ্চের দুই শত্রুর আচরণকে ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষ অন্য পাঁচটা জীবের মতই জিনের বিস্তারের এক মাধ্যম সে নিয়ে সন্দেহ রাখার কারণ নেই। কিন্তু মানুষ আর যাই হোক, সে কেবলমাত্র জিন-বিস্তারের মাধ্যম নয়। জিনতত্ত্বের সরল প্রয়োগ দিয়ে কিছুদূর ব্যাখ্যা সম্ভব ও প্রয়োজন, কিন্তু তারপরে অন্য বহু জটিল বিষয় না ভাবলে ভুল হয়ে যায়।
অবশ্য নব্য-ডারউইনিয় বিবর্তনতত্ত্বের সরল প্রয়োগ দিয়ে দু-একজন সৈনিকের আচরণ ব্যাখ্যা করা যায়। ষোড়শ বাভারিয়ান ট্রুপের কর্পোরাল একজন জার্মান সৈনিক বলেছিল, “যুদ্ধের সময় এ জাতীয় ঘটনা ঘটা উচিৎ নয়। এদের কি জার্মান সম্মানের কোনও অনুভূতি নেই?” সেই সৈনিকের নাম ছিল অ্যাডলফ হিটলার।
হিটলার একা ছিল না। ব্রিটিশ কমান্ডার জেনারেল স্যার হোরেস স্মিথ-ডরিয়েন বিশ্বাস করত দুটি ট্রেঞ্চের সৈন্যরা যে একে অপরের কথা শুনতে পায়, অন্যের রান্নার গন্ধ পায়, হাসি আর কান্না বুঝতে পারে, এটা ক্ষতিকর। সে বলেছিল এই সান্নিধ্য সৈন্যদের মনোবলের পক্ষে ‘সবচেয়ে বড় বিপদ’। সে বিভাগীয় কমান্ডারদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল, ‘শত্রুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ নিষিদ্ধ করতে হবে।
(৩)
হিটলার আর হোরেস স্মিথ-ডরিয়েন ঠিকই জানত যে দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকলে, একে অন্যের সুখ-দুঃখের কথা জানলে, তাদের মধ্যে প্রাথমিক যে বোধ গড়ে ওঠে তার নাম শত্রুতা নয়, তার নাম বন্ধুত্ব।
মারডক উড ছিলেন ঐ ট্রেঞ্চের এক সাধারণ ব্রিটিশ সৈন্য। ১৯৩০ সালে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। তিনি বলেছিলেন, “আমি তখন থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে আমরা যদি নিজেদের মত চলতে পারতাম তাহলে আর একটিও গুলি চলত না।”
অবশ্যই সাধারণ সৈন্যরা নিজের মত চলতে পারেননি। সেনাপতি আর দেশনেতারা বিজ্ঞ, তারা জানে মানুষের সুখশান্তির চাইতে তাদের ক্ষমতায় থাকা বেশি দরকার। ওপরমহলের চাপে সেনা অফিসারেরা দ্রুত পৌঁছে যায় ফ্রন্টে। গান আর ফুটবল ম্যাচের মত ‘অনৈতিক’ কাজকর্ম বন্ধ করা হয়। ‘দেশের নিরাপত্তা’, ‘শত্রুনাশ’, ‘দেশদ্রোহী’ আর ‘বিশ্বাসঘাতকতা’-র মত শব্দ দ্রুত দখল করে নেয় ক্যারল-গানের প্রান্তর। কোর্ট মার্শাল-এর ভয়ে কয়েকজন উর্দিপরা মানুষ আবার পরস্পরকে কলের পুতুলের মতন হত্যা করতে থাকেন।
(৪)
উর্দিপরা আর উর্দি না পরা কয়েকজন মানুষ এখন পরস্পরকে হত্যা করছে। একে অপরকে ভয়ের আর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। এখনই নিজেকে আবিষ্কারের, মনুষ্যত্ব আবিষ্কারের সর্বোত্তম সুযোগ। দেখা যাক মানুষ তা কাজে লাগাতে পারে কিনা।
চিত্র পরিচিতি
১) জার্মান ট্রেঞ্চে ক্রিসমাস—শত্রুর সঙ্গে গলাগলি (চিত্রঋণ britannica.com)
২) খোশগল্পে মেতে থাকা শত্রুরা (চিত্রঋণ bridgeman blog)
৩) শত্রুদের ফুটবল খেলা (চিত্রঋণ Independent.co.uk)
তথ্যসূত্র
১) Silent Night: The Story of the World War I Christmas Truce of 1914. By Naina Bajekal. Time. December 24, 2014. https://time.com/3643889/christmas-truce-1914/
২) Christmas Truce of 1914. By History.com Editors. October 27, 2009 (Updated: December 16, 2020). https://www.history.com/topics/world-war-i/christmas-truce-of-1914