সময়টা সত্যিই খুব খারাপ। পশ্চিমবঙ্গে কোভিডের দু নম্বর ঢেউ আছড়ে পড়ার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা। আর দফায় দফায় বাড়ছে ভোটের হিংসা। কাকে নিয়ে যে বেশী চিন্তিত হব ঠিক বুঝতে পারছি না।
এরই মধ্যে এসে গেল বাংলা নতুন বছর।
নববর্ষের প্রাক্কালে খাতা খুলে দেখছি বিগত প্রায় একবছর যাবৎ আমাদের মতো স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা অতিমারী নিয়ে লিখেছি বিস্তর, যাতে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নানা রকম নজির টেনে মানুষকে আসন্ন সেকেন্ড ওয়েভের বিপদ থেকে সাবধান করা। শুধু আমরাই নই, চিকিৎসাবিজ্ঞানী থেকে সরকার সবাই চেষ্টা করেছেন সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ থেকে দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে।
কপালগুণে এরই মধ্যে এসে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন। যা কিছুটা হলেও ভরসা যুগিয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের, পরবর্তী লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়ার জন্য বাড়িয়েছে সাহস। ভ্যাকসিন নিয়ে দোদুল্যমানতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন সাধারণ মানুষ। সরকারও চেষ্টা করছেন কিভাবে আরও কমবয়সী মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা যায়।
আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছি যে সেকেণ্ড ওয়েভ সবসময়ই নিয়ে আসে মিউটেটেড ভাইরাস এবং প্রথম ওয়েভ কাটিয়ে বেঁচে থাকা ‘জনগণে’র আত্মসন্তুষ্টি। দীর্ঘকাল গৃহবন্দী মানুষের আগলছাড়া আচরণ অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করে।
একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে ঠিক এমনটাই হয়েছিল। মানুষকে ধরেবেঁধেও শেখানো যাচ্ছিল না অতিমারী থেকে বেঁচে থাকবার উপায়। তখন না ছিল এতরকম উন্নত কমিউনিকেশন সিস্টেম, না ছিল ভ্যাকসিন। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার না হওয়াতে বিজ্ঞানীরা বুঝতেই পারেননি সেই অতিমারীর পিছনে কি ধরনের জীবাণু লুকিয়ে রয়েছে। সেটি আদতে ব্যাকটেরিয়া না ভাইরাস ছিল তাও জানা গিয়েছিল অনেকদিন পর।
এইভাবে ছায়ার সাথেই যুদ্ধ করে কেটে গিয়েছিল গোটা মহামারী। একমাত্র ওষুধ ছিল অ্যাসপিরিন এবং যা প্রচুর মাত্রায় খেয়ে বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন বহু মানুষ।
মনে রাখতে হবে সময়টাও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে । ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে গোটা স্বাস্থ্যপরিষেবাটাই অপ্রতুল। দীর্ঘ চার বছর ধরে চলা সেই রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধে তখন বেহাল দেশগুলোর কোষাগারও। যুদ্ধের পিছনে পিছনে এসেছিল দুর্ভিক্ষ আর মহামারী। যার সামগ্রিক ফল কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের অবস্থা তো অনেক টাই ভালো। তাই না!
কিন্তু সেই সুযোগ আমরা নিতে পারলাম কি?
যেখানে এতদিনে আমরা জেনে গিয়েছি কিভাবে ছড়ায় এই রোগ। চিকিৎসকরা এবং সরকারি নির্দেশিকাগুলি আমাদের জানিয়ে দিয়েছে অসুস্থ হলে কি কি করতে হবে আর কি কি নয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্রুত এনে দিয়েছে ভ্যাকসিন।
যে ইঞ্জেকশনে তৈরী হয়ে যাবে সেই বহু প্রতীক্ষিত হার্ড ইমিউনিটি।
কিন্তু আমরা শুনলাম কি সব?
রাস্তাঘাটে মাস্ক পড়ার অনীহা, সোস্যাল ডিসটেন্সিং কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছামতো সামাজিক মেলামেশা এমন ভাবে বেড়ে চলেছিল এতদিন,দেখে মনে হচ্ছিল কোভিড বলে যেন কোনদিন কিছু ছিল না!
আর তার মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এসে পড়েছে নির্বাচন। যেখানে অন্য রাজ্যে ভোট এক দফায় শেষ সেখানে এই বঙ্গে আট দফা।এক্কেবারে দফারফা আর কি!
মিটিঙে, মিছিলে, শ্লোগানে, ভাষণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে কোভিড। রাস্তায় বা টেলিভিশনের কোন ছবিতেই মাস্কের আড়াল প্রায় নেই বললেই চলে। ডিসটেন্সিং আর স্যানিটাইজেশন তো অনেক দূরের গ্রহ।
তাই বিগত একবছর এতকিছুর পরেও, অম্লানবদনে আমরা কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভ আসার পথে কার্পেট বিছিয়েই রেখেছিলাম। হাসতে হাসতে মিউট্যান্ট ভাইরাস ঢুকেও পড়েছে সেই পথে।
সারা ভারত জুড়ে এই মুহূর্তে দাপাচ্ছে ভাইরাস, রোগীর সংখ্যা দৈনিক বাড়ছে হাজার থেকে লাখে।ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে কেসের নাম্বারে আমরা ব্রাজিলকে পিছিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছি। প্রথম স্থানে বসে থাকা আমেরিকাকে হারিয়ে জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেব কিনা সেটা শুধু সময়ই বলতে পারবে।
কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালগুলিও কোভিড রোগীতে পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। রোজকার আলোচনা চলছে, কিভাবে আরও বেশি সংখ্যায় বেড বাড়ানো যেতে পারে। এতে অন্যান্য জরুরী নন কোভিড রোগের চিকিৎসা যেমন ব্যাহত হবে, তেমনই বাড়বে ক্রস ইনফেকশনের সমস্যা।হাসপাতালে ভর্তি হলেই থাকবে কোভিডের ভয়।
এরই মধ্যে ভ্যাকসিনেটেড ডাক্তার এবং সিস্টাররাও কোভিড সংক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন। সেগুলি খুবই চিন্তাজনক। যদিও ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে সংক্রমণ ক্রিটিক্যাল হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু কোভিড সম্বন্ধে সারা পৃথিবী এতটাই কম জানে যে সম্পুর্ণ পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ না হলে কোন কিছুই বলা সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি দেশে চলতি দুই ভ্যাকসিনের সাথে আরো একটি ভ্যাকসিন যোগ হতে চলেছে, রাশিয়ার স্পুটনিক। এছাড়াও পাইপলাইনে রয়েছে আরো কয়েকটি ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিছু সংখ্যক ডাক্তারদের মধ্যেও রয়েছে দ্বিধাবোধ। যা খুবই স্বাভাবিক। আসলে এত কম নোটিশের মধ্যেই এগুলো এসে পড়ছে যে, লম্বা ট্রায়ালের সময় পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু কিছু করার নেই, এই মহামারীকে আপৎকালীন ভিত্তিতেই ঠেকাতে হবে আর বাঁচাতে হবে মানুষের প্রাণ।
তাই কার্যকারিতা এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে আপনি পাতার পর পাতা রচনা লিখে ফেলতে পারেন কিন্তু এই মুহূর্তে ‘মাস ভ্যাকসিনেসন (mass vaccination) ছাড়া এই অতিমারি থেকে মানুষের জীবনকে বাঁচানোর আর কোন উপায় যে হাতে নেই।এছাড়া আমাদের দেশে প্রায় ১০ কোটির উপর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়ে গিয়েছে। সেখানে কিন্তু সাইড এফেক্টের সংখ্যা অনেকটাই কম। ব্লাড ক্লটের যে কারণে সাময়িকভাবে ইউরোপে বন্ধ রাখা হয়েছিল কোভিশিল্ড, তাও আবার চালু করা হয়েছে, কোন প্রামাণ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে।
আগেও বলেছি আবার বলছি এই ভ্যাকসিনেসন নতুন মিউটেটেড ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারবে না। শুধু আটকে দিতে পারবে কোভিডকে প্রথম রাউন্ডেই। লাগামছাড়া, ক্রিটিক্যাল হবে না রোগ। ভ্যাকসিনেসনের ফলে শরীরে তৈরী হওয়া মেমোরি টি সেল ইমিউনিটি দেবে রোগীকে, ছ মাসের মেয়াদি অ্যান্টবডি শেষ হয়ে গেলেও।
তাই মাস্ক, স্যানিটাইজেশন, সোস্যাল ডিসটেন্সিং আর ভ্যাকসিনেসনকে বাদ দিয়ে মহামারিকে ঠেকানোর অন্য কোন অস্ত্র এই মূহুর্তে আমাদের হাতে নেই। শুধু গোমূত্র ছাড়া। সেটা একজন চিকিৎসক হয়ে আমি আপনাদের বলতে পারি না।
ভালো থাকবেন সবাই। সাবধানে থাকবেন।
নতুন বছরের অনেক শুভেচ্ছা রইলো।