আমাদের হাসপাতালের গা ঘেঁষে যে জলাভূমি চলে গেছে পূর্ব কলকাতা হয়ে সল্টলেকের দিকে তা ভারি দৃষ্টিনন্দন। অপারেশন থিয়েটারের লম্বা লম্বা কাঁচের জানালা দিয়ে মন খারাপ হলেই আমি তাকিয়ে থাকি সেই জলরাশির দিকে। তবে সবটাই কিন্তু জল নয়, মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো ডাঙ্গাও জেগে থাকে। সেইরকমই এক ফালি ছোট্ট জমিতে রয়েছে একটি একতলা টালির বাড়ি।
বাড়ির চারিধারে গাছগাছালি। সবুজ রঙা একটা অদ্ভুত ছায়াময় শান্ত পরিবেশ। বাড়ির গা দিয়ে নেমে গিয়েছে ঘাট। একটা ছোট্ট নৌকা বাঁধা থাকে সেখানে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোলে। কারা সে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করে তা আমি অবশ্য কখনো দেখিনি। তবে এই মহামারীর শহরে জলছবির মতো সেই চিত্রকল্প আমায়এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়।
এই অপারেশন থিয়েটারে অনেক দিন কেটেছে আমার। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। আবার অনেক দিন মাঝরাতে শুরু করে কাজ শেষ করতে করতে কখন যেন কাকডাকা নতুন ভোর এসে পড়েছে।
এই ভাবেই জীবন চলে আমাদের মত ডাক্তারদের। মেঘে মেঘে বেলা কখন বয়ে যায় খেয়াল থাকে না।
সেদিন তুমুল ঝড় চলছিল বাইরে। মুহুর্মুহু বজ্রপাত।
জানালার কাঁচ দিয়ে অনবরত নেমে আসছিলো জলের ধারা। আমি রিমঝিমের ঘরে, লম্বা কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আটতলার এই সিঙ্গল রুম থেকেও সেই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি দেখা যায়। যার গা দিয়ে চলে গিয়েছে বাসন্তী হাইওয়ে।
দিন কয়েক আগেই আমাদের আউটডোরে রিমঝিম তার মা-বাবাকে নিয়ে হাজির হয়। তখনই জানা যায় যে রিমঝিম ক্লাস ইলেভেনে পড়া হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল একটি মেয়ের নাম। সদ্য আইসিএসই পরীক্ষায় ৯৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে।
কিছুদিন ধরে ওর হাঁটাচলাতে একটা অসুবিধা বোধ করে রিমঝিম। আর চোখের দৃষ্টির মধ্যে আচমকাই এসে পড়ে একটা অস্বচ্ছ ভাব। মাথার এম আর আই স্ক্যান করে দেখা যায়, মেয়েটির মস্তিষ্কের বাঁ দিকের নিলয়ে (ventricle), বাসা বেঁধেছে একটি টিউমার। যা ব্রেন ফ্লুইডের চলনকে (circulation) আটকে,চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কের ভিতর। মাঝেমাঝেই অসুস্থ করে দিচ্ছে ওকে।
টিউমারটির চেহারা যেন অনেকটা গুবরে পোকার মতো। আর সেই পোকাটাই মাঝে মাঝে কামড়াচ্ছে রিমঝিমকে। অবশ করে দিচ্ছে ওর সমস্ত অনূভুতি।
এর একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন। কিন্তু যে জায়গায় রয়েছে সেই টিউমার সেখান থেকে তাকে বের করে আনা সহজ কম্ম নয়। অনেক সময় দেখা যায় টিউমারটি হয়তো বেরিয়ে এলো, কিন্তু তার সাথে মস্তিষ্কে আঘাত লাগার ফলে প্যারালাইসিসের মতো অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল রোগীর। আর সে অসুবিধা নিয়ে কাটাতে হলো তাকে বাকি জীবনটা।
অপারেশন যে লাগবে এবং এছাড়া যে আর কোন পথ নেই, সেটা জানিয়ে দেওয়া হলো বাবা মাকে। রিমঝিমকে আলাদা ভাবে বোঝানো হলো তার অসুখের কথা, অপারেশন এবং তার পরবর্তী জটিলতার সম্ভাবনার কাহিনী।
সামান্য হেসে মেয়েটি মেনেও নিল সবকিছু। বুঝলো কতটা কে জানে,ভাবলাম আমরা। যদিও হাসবার সময় আমরা লক্ষ্য করলাম টিউমারের প্রভাবে ওর মুখের ডান দিকে ইতিমধ্যেই প্যারালাইসিস শুরু হয়ে গেছে।
যথাসময়ে রিমঝিমের অপারেশন হয়ে হয়ে গেল।
লম্বা পাঁচ ঘন্টার সার্জারি। কম্পিউটারের ন্যাভিগেশন সঠিক পথনির্দেশ দিল সার্জেনের স্ক্যালপেলকে। যাতে সর্বনিম্ন আঘাত লাগে মস্তিষ্কের।
এই অতিমারীর জ্বালায় স্বাভাবিক চিকিৎসা পরিষেবা অনেকটাই ব্যাহত এখন। কলকাতা শহরে সংক্রমণ ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় হাসপাতালের বেডের ভান্ডারে টান পড়েছে। ডাক্তার, সিস্টার অথবা অন্য সব স্বাস্থ্যকর্মীদের টেনে নেওয়া হচ্ছে অতিমারীর মোকাবিলায়। কিন্তু অন্যান্য জটিল অসুখ তো আর সে অপেক্ষায় বসে নেই। তারাও গজাচ্ছে তাদের মত করে। যাদের চিকিৎসা একটু অপেক্ষা করতে পারে, তাদেরকে ধরানো হচ্ছে ওয়েটিং লিস্ট। আর যাদেরটা এখন এই মুহূর্তে করতেই হবে, তাদের দেওয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার।
রিমঝিমের অসুখটা একদমই সেই রকম। বেশি অপেক্ষা করলে মৃত্যু দরজায় এসে যখন তখন কড়া নাড়তে পারে। অতএব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে ওর অপারেশন।
এই সংক্রমণের বাজারে আবার আচমকাই বেড়ে গেছে মস্তিষ্কে স্ট্রোক জাতীয় ব্যাধি। প্রায়শই ইমার্জেন্সি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হচ্ছে কোভিড পজেটিভ রোগীদের। এতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ছে সার্জেন তথা থিয়েটার স্টাফদের। তা ঘটলে আরো ব্যাহত হচ্ছে অন্যান্য জটিল অসুখের সার্জিক্যাল পরিষেবা।
ডাক্তারদের মধ্যে সার্জেনদের সংখ্যায় এমনিতেই কম। নিউরোসার্জন তো প্রায় হাতেগোনা কয়েকজন।
তাই এদেরকে সংক্রমণ থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু উপায় কি, অতিমারী এমন আকাশ ফুঁড়ে চলেছে, সবাইকে সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যস্ত হতে হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই।
তবে এর মধ্যে অল্পবিস্তর আশার আলো দেখা যাচ্ছে।প্রতিদিন সারাদেশে সুস্থতার সংখ্যা অনেকটাই বাড়ছে সংক্রমণের থেকে। মহারাষ্ট্র, কেরালা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, ছত্তিশগড়ের মত সংক্রমণপীড়িত রাজ্যগুলি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে একে একে। আমাদের রাজ্যও খুব শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে আশা করা যায়। ছোটখাটো ভুলত্রুটি ভুলে এখন একত্রিত হয়ে কাজ করার সময়। কোন রাজনৈতিক হঠকারিতা যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
ভ্যাকসিনের অভাব অচিরেই মিটিয়ে ফেলা দরকার। গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে ভ্যাকসিন পরিষেবা। শুধুমাত্র শহরগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে আর চলবে না। পরবর্তী ওয়েভগুলি থেকে বাঁচার জন্যে এটা এই মূহুর্তে আমাদের আশু কর্তব্য।
এই অতিমারীতে প্রায় প্রত্যেকের পরিচিত মানুষ মারা গেছেন। রোজ কান পাতলেই ডাক্তারদের মৃত্যুর খবর শোনা যাচ্ছে। এসব শুনে ক্ষণিকের জন্য কেমন স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। তারপর আবার ফিরে যাই নিজেদের প্রাত্যহিক কাজে, অপারেশন থিয়েটারে অথবা কোভিড ওয়ার্ড রাউন্ডে। মৃত্যু এখন এতোটাই গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান তো ছাড়লে চলবে না।কোভিডের পাশাপাশি চিকিৎসা করে যেতে হবে অন্যান্য জটিল রোগের । নিজেদের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকলেও। দ্য শো মাস্ট গো অন!!
বাইরে এখন আবার বৃষ্টি বাড়ছে। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক।
রিমঝিমের অপারেশন পরবর্তী স্ক্যানের রিপোর্ট খুব ভালো। সমূলে উৎপাটিত হয়েছে পোকার মতো সেই টিউমারটি। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ বার করতে গিয়ে শরীরের ডান দিক প্যারালাইজড হয়ে গেছে রিমঝিমের। আর তার সাথে চলে গেছে বাকশক্তি। যদিও আমাদের সিনিয়ারের আশা এই দুর্বলতা সাময়িক। অনেকাংশেই ফিরে আসতে পারে স্নায়ুর জোর অথবা কথা বলার ক্ষমতা।
আমরাও তাই রাউন্ডে এসে রোজ খানিকক্ষণ গল্প করে যাই ওর সাথে। রিমঝিম খালি হাসে আর কেমন আছিস জিজ্ঞাসা করলে বাঁ হাত দিয়ে ‘হাই ফাইভ’ দেয়। আমার তখন কেন জানি না, নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়েযায়।
এখন ঘরে রিমঝিম, ওর অ্যাটেনডেন্ট আর আমি রয়েছি। বাইরে তুমুল ঝড়, কালো হয়ে যাওয়া আকাশে বিদ্যুতের শিখা মাঝে মাঝেই তুলির টান দিয়ে চলেছে। আপাতশান্ত ঝিলের জলরাশিতে আচমকাই ছোট ছোট ঢেউ ওঠা শুরু হয়েছে। কালবৈশাখীর তাণ্ডবের কথা আঁচ করে নৌকাটা কে যেন খুলে নিয়ে গিয়েছে কখন। অন্ধকারে রোজ আমার মন ভালো করে দেওয়া বাড়িটাও এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। আমার সাথে রিমঝিমও আকাশ দেখছে চিন্তিত মুখে।
কড় কড় করে কাছে কানফাটা একটা বাজ পড়লো।
“এই…,এই…..!”
আমার আকাশ দেখা বন্ধ হলো। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম রিমঝিমের ঠোঁট কাঁপছে। কথা বলার চেষ্টা করছে ও। পরীক্ষা করে দেখলাম ডান পা আর ডান হাত অল্প অল্প নড়া শুরু করেছে। আমার সিনিয়রের কথা মনে পড়ে গেল।
কয়েকদিন পরের ঘটনা। আজ আবার পরিষ্কার আকাশ। কালোমেঘের চিহ্নমাত্র নেই। মৃদুমন্দ বাতাসে সেই এক চিলতে বাড়ির এক টুকরো ঘাটে একটুখানি নৌকোটা
শালপাতার মতো ভাসছে। গাছের শীতল ছায়ায় শান্ত হয়ে আছে জলরাশি।
আজ রিমঝিমের ছুটি। হুইল চেয়ারে করে লিফটের দিকে মা বাবার সাথে চলেছে ও। ডানহাতে জোর বাড়ানোর জন্য স্কুইজ বল। আমাকে দেখে একটু দাঁড়ালো হুইলচেয়ার।
“আমি বাড়ি যাচ্ছি।” পরিষ্কার উচ্চারণ আর তার সাথে উপরি পাওনা এক গাল হাসি।
আমি ওদের লিফট অবধি এগিয়ে দিয়ে, ধীরে ধীরে
আবার অপারেশন থিয়েটারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বাইরে গাছের ডালে কোথাও একটা দোয়েল শিস দিয়ে উঠলো।❤️