শীতের দুপুর। বাড়ির গোটা ছাদ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে মিঠে রোদ্দুর। একটা শতরঞ্চি বিছিয়ে বেশ জমিয়ে বসে আছি।আচমকাই দেখি একটা সাদা রঙের হুলো বিড়াল ছাদের রেলিঙে বসে অবাক চোখে আমায় দেখছে। চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্নটা ছুঁড়েই দিল বিড়ালটি। “দুধ কাটলে ছানা হয়,আর ছানি কাটলে?”
এর উত্তরে কি বলবো বুঝতে না পেরে খানিক হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম।
“জানতাম বলতে পারবে না। এক কুড়ি বয়স কমতি হয়।” বলেই ফ্যাঁচ করে মুচকি হেসে এক লাফ মেরে পাশে ডোডোদের বাড়ির রান্নাঘরে সেঁধিয়ে গেল।
আমি বোকার মতো তার যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“ক্লাসে এসে বসো।একদম পড়ালেখায় মন নেই তোমাদের।”
গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখি বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট ইস্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই সুধাময় বাবু। ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া রোগাটে চেহারার মানুষটি, ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে কি একটা মন দিয়ে লিখে চলেছেন। আর লিখেই হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন। যেমন ক্লাস টেনের বাংলা পিরিয়ডে ভাবসম্প্রসারণ দিয়ে চলে যেতেন।
আমি কাছে গিয়ে দেখলাম, কি একটা হেঁয়ালি লেখা আছে।
“দুই বছরের অতিমারীতে
যুদ্ধকরা ডাকতার,
ক্যামনে হয় পজিটিভ?
ছিল কোথায়, ফাঁক তার?”
শতরঞ্চিতে বসে স্লেট পেন্সিলে উত্তর লিখতে যাবো, হঠাৎ দেখি সব কিছু উধাও। রোদ্দুর, ছাদ, ব্ল্যাকবোর্ড সব,……সওব কিছু।
স্বপ্নভাঙা মাঝরাত্তিরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম অন্ধকার এক ঘরে। একাকী। দেখলাম পূবদিকের কাঁচের জানালার একটা পাল্লা অজান্তেই কখন খুলে গিয়েছে। সেই খোলা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে শীতের কুয়াশা। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, মেঘলা আকাশের গায়ে উঁকি মারছে একফালি চাঁদ।
যাহ্, ভুলেই গিয়েছিলাম বলতে। আমি তো এখন কোভিডাচ্ছন্ন।যার সূত্রে আমার এই নিভৃতযাপন শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন যাবৎ।
মাসের শুরুটা কিন্তু মোটেই সেরকম ছিল না। বছরের শেষে হাসপাতালে ছুটি জমে গিয়েছিল বেশ খানিক। ঠিক করেছিলাম এই সুযোগে চোখের অপারেশনটা করিয়ে নেবো।
অতিমারীর দু বছর ধরেই চোখের সমস্যা বাড়ছিল ক্রমাগত। এমনই যে দৈনন্দিন চিকিৎসার কাজ করতে অসুবিধায় পড়ছিলাম বেশ। আমার রেটিনা-বিশেষজ্ঞ বন্ধু শান্তনু আর ক্যাটারাক্ট চিকিৎসক ব্যানার্জি সাহেবের সাথে আলোচনা মাফিক অপারেশানের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায়। প্রথমে বাঁ আর তার চারদিন পরেই ডান চোখ।
কিন্তু আপনি যদি নিজে চিকিৎসক হন, আর অপারেশনের স্টেপগুলি বিলক্ষণ জানেন,তাহলে এটাও জানেন কোথায় গড়বড় হতে পারে? যদিও তার সম্ভাবনা শতকরা হিসাবে হয়তো কিছুই নয়, কিন্তু যার হয় তার ক্ষেত্রে তো কোন হিসাব মেলে না, তাই না!
তবে হলফ করে বলতে পারি, অপারেশানের অনুভূতি আমার কাছে কষ্টদায়ক মনে হয়নি। একটু অস্বস্তিকর তো বটেই, কিন্তু অবশ্যই সহ্য করার মতো। শুধু সার্জারি চলাকালীন মনে হচ্ছিল, মাইক্রোস্কোপের লাইট যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত আলো নিয়ে আমার চোখে ঢুকে পড়েছে। সেই রামধনুর সাতরঙা আলো যেন সম্মোহিত করে রাখছে আমার যাবতীয় সত্ত্বাকে। সেই ভাবনার মাঝে চোখের তারার ঠিক মধ্যিখানে ঝকমক করে উঠছে সার্জিক্যাল ব্লেড, আর আপনি বুঝতে পারছেন কাটাকুটি শুরু হয়ে গেল। Phaco মেশিনের যান্ত্রিক শব্দ শুনিয়ে দিচ্ছে জন্মগত চোখের ছানিপড়া লেন্সটির বেরিয়ে যাওয়ার গল্প। আর তার পরেই নতুন লেন্স ভাঁজ হয়ে ঢুকে পড়ছে পুরনো লেন্সের ছেড়ে যাওয়া ফাঁকা জায়গায়।
“অপারেশন শেষ পার্থ, নো কমপ্লিকেশন।” সার্জনের গলা শুনে আবার ফিরে আসা বাস্তব দুনিয়ায়। টেবিল থেকে নামতে নামতে ভাবছি, one done, other to go.
দ্বিতীয় অপারেশনটাও মিটে গেল ঠিকঠাক। চোখে দেখতেও পাচ্ছি বেশ। হঠাৎ করে চোখে ঢুকে পড়া অনেকটা আলোই শুধু যা বিরক্ত করছে একটু। সূর্যের আলো যে এতটাই উজ্জ্বল, ছানি পড়া চোখের তাতে খেয়াল ছিল না অনেকদিন! মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে গেলে, সেটাও আশা করছি নিশ্চিত কেটে যাবে সময়ের সাথে সাথে।
এসব শেষে হাসপাতালে যোগ দিয়েছি। তিন চার দিন কাজ শুরু করেছি সবে।
মেয়ে তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল দু এক দিনের জন্য।বাড়ি ফিরে এসে খুক খুক করে কাশছিল। ওর একটু মরশুমি সর্দিকাশি হয়। তাই পাত্তা দিই নি একদম। তা ছাড়া কলকাতায় তখনও কোভিড সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ হুড়মুড় করে এমন বাড়তে শুরু করেনি।
আর ঠিক সেখানেই হয়ে গেল হিসেবের ভুল। দু’দিনের মাথায় সে হঠাৎ বললে গন্ধ পাচ্ছে না একদম । তবে তার আর কোন অস্বস্তি নেই।
যা বোঝার বুঝে গেলাম আমি। এখন তাহলে শিরে সংক্রান্তি! হাসপাতালে দু বছর ধরে অতিমারীরতে মুখে মাস্ক সেঁটে কাজ করে যাওয়া ডাক্তারকে তবে বাড়ি বয়ে এসে দু গোল দিয়ে গেল কোভিড!
দু’গোল বলছি এই কারণে, মেয়ের সাথে আমারও ততক্ষণে গা হাত পা ব্যথা আর মৃদু জ্বর এসে পড়েছে। পি সি আর রিপোর্টে দু জনেই পজিটিভ। বাড়িতে নিভৃতবাস শুরু হয়ে গেল আমাদের।শুধু একমাত্র স্বস্তি ছিল আমার স্ত্রী সোমার সংক্রমণ না হওয়া। এক যোগে দু জনকেই সেবা করে গিয়েছে সে। আর আমার পিতৃদত্ত বাড়িটিতে নিভৃত যাপনের জন্য ঘরের অভাব না থাকাটাও বাঁচিয়ে দিয়ে গেল এযাত্রা।
পাঁচ দিনের মাথায় আচমকাই গন্ধের বোধ চলে গেল। তার সাথে বিদায় নিল স্বাদ। কি খাচ্ছি একেবারেই বুঝতে পারছিলাম না কয়েকদিন। টেবিলে রাখা রামের বোতলে নাক ঢুকিয়েও কোন গন্ধ খুঁজে পাই নি। হে রাম!! তবে তুমিও নির্গন্ধ হলে!
কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য স্বাদ, গন্ধ ফিরে এলো। তবে খুব ধীরে। অক্সিজেন লেভেলের সমস্যা আমার হয়নি। চূড়ান্ত ক্লান্তি আর মাথার যন্ত্রণা বিছানায় ফেলে রেখেছিল বেশ কয়েকদিন। কেবলই অনুভূতি হচ্ছিল যেন ভাইরাস মাথায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।যাইহোক একদিকে দু চোখের অপারেশন উপরন্তু কোভিডের সংক্রমণ একটু অসুবিধায় ফেলে দিয়েছিল আমায়। তবে সুস্থ হয়ে মনে হচ্ছে সংক্রমণটা আরেকটু পরে হলেই ভালো হত। এই ছুটকো ওমিক্রনটাকে পেতাম। স্বাদ গন্ধ নিয়ে যাওয়া ডেল্টাটাকে সামলাতে হতো না।
তবে হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পড়ে দেখছি, এখন ইমার্জেন্সিতে যত রোগী আসছে প্রায় সবই পজিটিভ। আর বেশিরভাগ উপসর্গহীন।
সৌরভ নামে বছর তিরিশের একটি অ্যাক্সিডেন্টের রোগী ভর্তি হল কয়েক রাত আগে।। মস্তিষ্কে রক্তপাতের ফলে অজ্ঞান। গভীর রাতেই অপারেশন করে বার করে দেওয়া হল রক্ত। সে ছেলেটিও দেখা গেল, কোভিড পজিটিভ।
অপারেশনের পর তার স্থান হয়েছে কোভিড আই সি ইউ-তে।তাকে সেখানে দেখতে গিয়ে, দেখতে পাচ্ছি কোভিড আই সি ইউ-তে যাঁরা ভর্তি রয়েছেন তাঁরা বেশিরভাগই বয়স্ক রোগী। অন্য ওয়েভের মতো অপেক্ষাকৃত স্বল্পবয়সী রোগীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে কম। তবে শুধু সংখ্যার দিক থেকে খুব অল্পসময়ের মধ্যে অনেক মানুষকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা বেশি থাকার দরুণ মৃত্যু হারটা কিন্তু অবাক করে দিয়ে যেতে পারে!
তবে ওমিক্রনের এই ঢেউ সম্ভবত চলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। হিসেব মতো ফেব্রুয়ারিতেই কেসের সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু রয়ে যাবে পরবর্তী ওয়েভের আশঙ্কা।
মনে রাখতে হবে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে ভ্যাক্সিন না পৌঁছে দিতে পারলে, ভ্যাক্সিনেটেড মানুষেরাও বিপদমুক্ত নন।ভাইরাস যে হারে মিউটেট করছে কোন ওয়েভে কে সংক্রামিত হয়ে পরবেন কেউ জানে না।
এই কথা যখন লিখছি তখন আফ্রিকার মাত্র দশ শতাংশ মানুষের ডাবল ভ্যাক্সিনেশনের খবর জানাচ্ছে WHO।
তাই আমাদের দেশেতো বটেই, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে সারা পৃথিবী জুড়ে সমস্ত ছোট ছোট গরীব দেশেই পৌঁছে দিতে হবে ভ্যাক্সিন। এই অসম লড়াইয়ে সবাই না বাঁচলে আপনিও বাঁচবেন না।
আর মাস্ক মুখে না লাগিয়ে বাইরে বেরোলে, অপেক্ষা করে বসে থাকবে কোভিড । আপনি ভাইরাসকে দেখতে না পেলেও সে কিন্তু আপনাকে দেখতে পাচ্ছে, আর মিউটেট করে যাচ্ছে, আপনার শরীরে ঢোকার জন্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন যত মিউটেট করে স্পাইক প্রোটিনে অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স বদলাচ্ছে ভাইরাস, তত বাড়ছে তার সংক্রমণ করার শক্তি আর কমছে মারণক্ষমতা। সর্বশেষ ভ্যারিয়েশন অফ কনসার্ন (VOC) ওমিক্রন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেলে, মৃত্যুহার কম হলেও, অনেক মানুষ মারা যেতে পারেন।
গোদা কথায় সেটাই হচ্ছে বিপদ।
শেষে বলি আমাদের সেই অপারেশনের রোগী সৌরভও উঠে বসেছে এই কদিনে। কথা বলার চেষ্টা করছে, যাবতীয় দুর্বলতা কাটিয়ে।
আমিও চোখের অপারেশন আর কোভিডাঘাত কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক কাজের ছন্দে ঢুকে পড়ছি ধীরে ধীরে।
তাই বিড়ালের কথা মতো,ছানি কাটিয়ে এক কুড়ি বয়স কমে গেল কিনা জানি না, তবে কোভিড হয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে বেশ কিছুদিন বয়স বেড়ে, একটা কাটাকুটি খেলা হয়ে গেল জীবনের সঙ্গে।
সুধাময়বাবুর জন্য স্লেট পেন্সিলে সেই উত্তরটাই না হয় লিখে রাখবো।
তাই আজ এই পর্যন্ত থাক। আবার একদিন ফিরে আসবো অন্য দিনলিপি নিয়ে।
সাবধানে থাকবেন সক্কলে।