লড়াই টা চালিয়ে যেতেই হবে। জানি কঠিন খুব, তবুও। রোজ চলে যাচ্ছেন কত মানুষ।
বেড, অক্সিজেন, জীবনদায়ী ওষুধের অভাব চতুর্দিকে।
এটা সত্যি, লক ডাউনের ভ্রুকুটি ধীরে ধীরে চাপে ফেলবে অর্থনীতিকেও। কিন্তু কিছু করার নেই।’চেইন ব্রেক’ তো করতেই হবে।
জানুয়ারিতে ‘করোনা মুক্ত ভারতের’ স্লোগানটি যে কতটা ক্ষতিকারক হয়ে ফিরে এসেছে সেটা এখন আমরা অক্ষরে অক্ষরে বুঝতে পারছি।
ডাবল মিউট্যান্ট ভাইরাস এসে উলঙ্গ করে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে। অথচ সময় পড়ে ছিল দ্বিতীয় তরঙ্গের অভিঘাত সামলানোর জন্য যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়ার।
আসলে আমরা ১০০ বছরের পুরনো ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ য়ের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি। সেকেন্ড ওয়েভ যেখানে মৃত্যুহার বাড়িয়ে ছিল সবচেয়ে বেশী।
সবাই নয়, আমরা ডাক্তার আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কিন্তু সারা বছর ধরে শুনিয়ে গিয়েছি সেই সাবধানতার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা থেকে সাধারণ মানুষ কেউই কর্ণপাত করেন নি।
‘জনগণ’ ঘুরে বেড়িয়েছেন মাস্কহীন হয়ে গর্বে বুক ফুলিয়ে। আর রাজনৈতিক নেতারা নেমে পড়েছেন ভোট যুদ্ধে।বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান আর কুম্ভমেলার মতো জনসমাগমে। আবাহন জানানো হয়েছে কোভিডকে। সরকার অতিরিক্ত আত্মসন্তুষ্ট হয়ে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন জিনোম সিকোয়েন্সিং, যে পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়ে যায় নতুন মিউট্যান্ট ভাইরাস।
আদ্যিকালের স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়েই যখন সামলে দেওয়া গেছে প্রথম ঢেউ তখন আর কি দরকার তার উন্নতির। এই ছিল সবার ধ্যানধারণা।
ফলত যা হওয়ার ছিল তাই হচ্ছে। ডাবল মিউট্যান্ট, B.1.617 উন্মাদের মতো তাণ্ডব চালাচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে। আর তার জুড়িদার হয়েছে ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতা। প্রচুর প্রাণ চলে যাচ্ছে অকালে।
সহকর্মী চিকিৎসক রাও অংশীদার হয়েছেন এই মৃত্যুমিছিলে। রোজ কিছু না কিছু খারাপ খবর পাওয়া যাচ্ছে ঘুম ভাঙলেই। আজ সেভাবেই চলে গেলেন আমাদের এক চিকিৎসক দাদা, ডাঃ গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। ইনটেনসিভ কেয়ারে অনেক লড়াইয়ের পর।
এক লহমায় কত পুরনো কথা মনে পড়ে গেল।
ওয়ার্ড রাউন্ডে হালকা হাসিঠাট্টা। সিনিয়রের অভিজ্ঞতা জুনিয়রের সাথে ভাগ করে নেওয়া।
অতীত হয়ে গেল এক মুহূর্তে।
হাসপাতালে দৈনিক কাজের সাথে এখন যুক্ত হয়ে গেছে কোভিড ডিউটি। সবাইকেই নিজের বিভাগ ছেড়ে যোগ দিতে হয়েছে অতিমারীর চিকিৎসায়।
এছাড়াও সারাদিন ধরেই আসছে নিজের পরিচিত রোগী থেকে অপরিচিতের ফোন কল।হোয়াটসঅ্যাপেই প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছি চিকিৎসার। সেখানেই সি টি স্ক্যান আর রক্তের রিপোর্ট চেক করে দিতে হচ্ছে। যতটা পারছি সবাই চেষ্টা করছি মানুষকে সাহায্য করবার।
শুধু দুটো জায়গাতেই আটকে যাচ্ছি আমরা।
বেড আর অক্সিজেন। বেডের এই চূড়ান্ত আকালে বিভিন্ন ফোন নাম্বার ফরওয়ার্ড করা ছাড়া আর কিছু উপায় থাকছে না। হাসপাতালে যে বেড বাড়িয়েও সামলানো যাচ্ছে না রোগী।
ইমার্জেন্সিতে সার দিয়ে বসে আছেন কোভিড পেশেন্টরা। কেউ কেউ অক্সিজেন বাড়িতে জোগাড় করে নিতে পারবেন বলে জানাচ্ছেন। তাঁদের সেভাবেই চিকিৎসা চলছে। তবে বেশির ভাগই অপারগ।
কিন্তু অক্সিজেনের অপ্রতুলতার একটা কারণ মনে হয় কিছু মানুষের অন্যায় ভাবে গুদামে মাল মজুত করে রাখা।
আমি হাসপাতাল নয় এলাকার কথা বলছি শুধুমাত্র। সরকারকে এ ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে।
যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা এই অতিমারীর বাজারে
অন্যায় মুনাফা লুটতে না পারে।
সবাইকে দাঁতে দাঁত চেপে এই সময়টা পেরিয়ে যেতে হবে। যাঁরা সুস্থ আছেন সাবধানতা অবলম্বন করে যতটা পারবেন অন্যদের সাহায্য করুন।
সরাসরি সাহায্য করতে না পারলেও অন্তত কথা বলুন তাদের সঙ্গে। মানসিক ভরসা কিন্তু রোগ সারাতে সাহায্য করে।
সাধ্য থাকলে করুন আর্থিক সহায়তা। সম্ভব হলে পাশের বাড়ির অসুস্থ পরিবারের ওষুধ পথ্যের বন্দোবস্ত করুন। বিপদের দিনেই যে মানুষ চেনা যায়।
প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে না দাঁড়াতে পারলে আমরা কিন্তু পারবো না করোনা কে হারাতে।
হাসপাতলের চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের লড়াইটা সমাজের সর্বস্তরে সমস্ত মানুষের লড়াই হয়ে উঠুক।
চলুন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই অসম যুদ্ধে সামিল হই সবাই। শেষ হাসিটা আমাদের জন্যেই তোলা থাক।