না।
ঠিক এক্ষুনি ভয় পাওয়ার দরকার নেই। কারণ এটা ভারতের একটা বড় রাজ্যের কোভিড ভাইরাসের উত্থানের লেখচিত্র হলেও আমাদের প্রদেশের নয়।
আমাদের সাধের বাংলায় পৌঁছাতে এর আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। আগের বারের অভিজ্ঞতা তেমনটাই বলছে আপাতত। কেরল, মহারাষ্ট্র ঘুরে আপনার আমার শহরে কোভিডের প্রথম ঢেউ আসতে লেগেছিল কয়েক সপ্তাহ। তাই এইবার হয়তো কয়েক মাস লাগতে চলেছে। কিন্তু এসে পৌঁছাবার সম্ভাবনা বাড়ছে রোজ। কালকেই মহারাষ্ট্রে নতুন কোভিড রোগীর সংখ্যা তের হাজার পেরিয়েছে। নাগপুরে শুরু হতে চলেছে আবার ‘লকডাউন’।
পাল্লা দিয়ে কোভিড বাড়ছে পাঞ্জাব, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ , গুজরাট আর ছত্তিসগড়ে। রাজধানী দিল্লি অথবা হরিয়ানাও পিছিয়ে নেই বিশেষ। একমাত্র কেরালা বেশ কিছুদিন কেসের সংখ্যা বাড়িয়ে এখন কমতির দিকে।
আর সারা পৃথিবীর কোভিড ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সেখানেও রং বদলে দিচ্ছে সময়। প্রথম ওয়েভে ত্রস্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে এখন। ইউ কে, স্পেন কিংবা পর্তুগাল, সব জায়গা থেকেই আসছে ভালো খবর। কিন্তু অপরদিকে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার। চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি , পোল্যান্ড থেকে শুরু করে এস্তোনিয়ার মতো ছোট ছোট দেশগুলিতেও মাথাচাড়া দিচ্ছে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ, যার গভীরতা নাকি প্রথম বারের চেয়েও অনেক বেশি।
বলা হচ্ছে কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে অনর্থক বিতর্ক বিপদে ফেলে দিচ্ছে এইসব ছোট ছোট দেশগুলিকে। ভ্যাকসিন শহরে পৌঁছে গেলেও কোন ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরী তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। আদৌ ভ্যাকসিন দিয়ে কোন লাভ আছে কিনা , তা নিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না গবেষণা।
এইসব কারণেই বাড়ছে মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন এড়িয়ে যাওয়ার নানা ফন্দিফিকির, যার পোশাকি নাম ‘ভ্যাকসিন হেসিটেন্সি’, যা কিছু দিন আগে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল। দিল্লি, মুম্বাইয়ের বড় বড় হাসপাতালের ডাক্তাররাও ছিলেন সমান দোষে দুষ্ট, যদিও তা কেটেছে অবশেষে।
এর প্রভাবে হু হু করে বাড়ছে সে সব দেশে কোভিডের সংখ্যা। সংরক্ষিত ইম্পোর্টেড ভ্যাকসিন পড়ে থাকছে ফ্রিজের অন্ধকারে। আর ইউ কে-র মিউট্যান্ট ভাইরাস মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক জনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে, গোটা ইউরোপ জুড়ে।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রাজিল। সে দেশের দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন কোভিডকে খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়ার। মহামারীর প্রথম দিন থেকেই যিনি মাস্ক ব্যবহার অথবা সোস্যাল ডিসটেন্সিং এর প্রবল বিরোধী। ভ্যাকসিন নিয়েও তার উবাচ সমালোচিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও তাড়িয়েছেন পদ থেকে, সুপরামর্শ দেওয়ার অজুহাতে। ফলত ব্রাজিলের মিউট্যান্ট কোভিড ভাইরাস P1 দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা দেশে। প্রথম ওয়েভের চেয়েও মারাত্মক আকার নিয়েছে দ্বিতীয় তরঙ্গাভিঘাত। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেখানে সংক্রমণ আর মৃত্যুর হার। বলা হচ্ছে ব্রাজিল এই মুহূর্তে কোভিড ভাইরাসের পরীক্ষাগার। মিউট্যান্ট প্রজাতি তৈরির কারখানা।
এসব ছেড়ে নিজের দেশে কথায় ফিরে আসা যাক। জানুয়ারী মাসে শুরু হয়ে যাওয়া ভ্যাকসিনেশন, আমাদের দেশে কিন্তু শম্বুক গতিতে চলছে। অযৌক্তিক বিতর্ক, ভয়, ভগ্ন স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কোন কিছুকেই ছাপিয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না আমাদের দেশজুড়ে এই সার্বিক টীকাকরণ কর্মসূচি।
ফলতঃ ভ্যাকসিন দেওয়ার তালিকায় আমাদের দেশের স্থান বাংলাদেশ এবং শ্রীলংকার পরে। যেখানে প্রতি ১০০জন দেশবাসীর মধ্যে আমরা মাত্র ১.৯ জন-কে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দিতে পেরেছি, সেখানে ইউ কে তাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ আর ইজরায়েল তাদের দেশবাসীর ১০০ শতাংশকে ভ্যাকসিনের অন্ততপক্ষে একটি ডোজ দিয়ে দিতে পেরেছে।
লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে আমাদের সবার।
যাঁরা ভ্যাকসিন নিতে চাইছেন না তাঁদের একটা কথা বুঝতে হবে, প্রায় ১০০ বছর পুরনো মহামারীতে (১৯১৮ স্প্যানিশ ফ্লু), আমাদের দেশের মৃত্যু সংখ্যা ছিল এক থেকে দুই কোটির মধ্যে। এই অকল্পনীয় মৃত্যু মিছিলের অন্যতম কারণ ছিল প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন না থাকা। আর আজ ভ্যাকসিন হাতে পেয়েও আমরা বিভিন্ন কারণে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
যেখানে পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেথায় এখনো নানা কারণে পৌঁছাতে পারেনি ভ্যাকসিন। কপালগুণে অথবা সরকারের বদান্যতায় পড়ে পাওয়া ওষুধকে হেলাফেলা করার ফল ভুগতে হবে না তো আমাদের? এরপর সংক্রমণ অথবা মৃত্যু হার বাড়লে জনতার কিন্তু কাউকে দোষ দেওয়ার উপায় থাকবে না।
বলা হচ্ছে মিউট্যান্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কাজ করবে না। তাই ভ্যাকসিন নিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ভ্যাকসিন নিলে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে শরীরে তা পরবর্তীকালে মিউট্যান্ট ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেও বাঁচাবে আপনাকে। ভাইরাস ধরলেও সাধারণ জ্বর সর্দি কাশির উপর দিয়ে পার পেয়ে যাবেন আপনি, মারাত্মক হবে না কোন মতেই।
তাই সুযোগ পাচ্ছেন যখন কালবিলম্ব না করে ভ্যাকসিন নিয়ে নিন। কবে কোথায় আপনার জন্য ঘাপটি মেরে রয়েছে মিউট্যান্ট ভাইরাস, তা খোঁজার আর প্রয়োজন পড়বে না তখন। মাস্ক আর স্যানিটাইজেশনই বাঁচিয়ে রাখবে আপনাকে, অন্য ওয়েভগুলোতে।
একই সঙ্গে সরকারের কাছে আবেদন রাখবো, এই ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামকে আরো ছড়িয়ে দিতে প্রত্যন্ত জায়গায়। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের সীমানার বাইরে। মোবাইল ভ্যানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন ছড়িয়ে পড়ুক দূর দূরান্তে। যাতে গ্রামেগঞ্জে বসে সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে পারেন নিজের সুবিধামতো।
তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের হাসপাতালেও শুরু হয়েছে ২৪ ঘন্টার ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম। সারাদিন সারারাত ধরে চলছে টিকাকরণ। বয়স্ক রা দল বেঁধে আসছেন মাঝরাতেও। আশা করি কলকাতার অন্য হাসপাতালগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে এই পরিষেবা।
সামনে নির্বাচন আসছে আমাদের রাজ্যে। সোশ্যাল ডিসটেনসিং, মাস্ক আর স্যানিটাইজেশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলবে গরমাগরম প্রচার। রাজনৈতিক দলগুলো মানবে না কোন নিয়মকানুন। মিটিং মিছিলে লুকিয়ে থাকবে ভাইরাস।
সেকেন্ড ওয়েভ তৈরি করার একদম আদর্শ পরিস্থিতি। ঢেউ ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
তাই সমস্ত রকম বিতর্ক ঝেড়ে ফেলে যারাই সুযোগ পাচ্ছেন ভ্যাকসিন নিয়ে ফেলুন চটপট। ঢেউ আসার আগেই শরীরে তৈরি করে ফেলুন লড়াই করার প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি। আমাদের সকলের ইমিউনিটি থেকেই সারবে রোগ আর বাঁচবে দেশ। সেকেন্ড ওয়েভকে ঠেকানোর এটাই একমাত্র পথ।